দীর্ঘ ১৩ বছর পর এবারই প্রথম বাজেটের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নেই। এ নিয়ে কিছুটা মন খারাপ ছিল। তবে দিনের শেষভাগে অফিসের কাজ শেষ করে বসলাম নতুন বাজেট দেখতে। একবার দেখেই বুঝলাম সেই গতানুগতিকতা এবং নির্দিষ্টতার অভাব। চলে গেলাম বাজেটের শেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাজস্ব খাতে। এই একটা জায়গা যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নির্দেশনা থাকে।
শুরু করি বাজেটের শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকেই। বাজেটে কথা বলার ওপর বাড়তি শুল্ক বসানো হয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত এক পত্রিকা থেকে বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার। তার মানে গড় হিসেবে প্রায় সবার হাতেই মোবাইল। এ কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সহজ উপায় হিসেবে খাতটি বেছে নিলেও তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কিন্তু ভয়াবহই হবে।
ভাবেন তো, দুঃসহ করোনার অসহনীয় দিনগুলোতে পারিবারিক বা সামাজিক দূরত্বে থেকে যদি কারও খবর নিতে চান তো বাড়তি টাকা গুনতে হবে। করোনা সংক্রান্ত কারণে নির্দিষ্ট ফোন নম্বরগুলোতে একনাগাড়ে ফোন করে সময়, শক্তি ও বিলের ভারে আপনি ক্লান্ত হলেও অপারেটর ফোন স্ক্রিনে কত টাকা বাড়তি দিতে হবে তা বলতে সময় নেবে সেকেন্ডেরও কম। অনলাইন অফিস, ক্লাস আরও কত কি! অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার কারণে দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ চাকরিহারা হবে। এছাড়া, ব্যবসা বাণিজ্যেও এর ভয়াল প্রভাব তো আছেই। এই সময় আপামর জনসাধারণের অতি প্রয়োজনীয় এই জায়গায় হাত দেওয়া কি ঠিক হয়েছে!
সামনের দিনগুলোতে আমাদের সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা আইসিটি খাত। ‘অফিস ফ্রম হোম’ই হবে স্বাভাবিক নিয়ম। আইসিটি কেন্দ্রিক কাজকর্ম বা ব্যবসার চাহিদা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে এবং যাবে। অনলাইনভিত্তিক কাজে বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে আমাদের মেয়েরাও। তার মানে অবাধ ইন্টারনেট সুবিধা, কারিগরি দক্ষতা, কম্পিউটার বিষয়ক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ের সমন্বয় করাই ছিল মূল জায়গা। সারাদেশে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এখন অতি দরকারি। কিন্তু এ ধরণের নির্দেশনা কোথায়?
অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া বা স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার মতো দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতে নতুন ও কঠিন সিদ্ধান্ত আশা করেছিল সবাই। হ্যাঁ, গত তিন মাসে অপরিকল্পিতভাবে হলেও স্বাস্থ্যখাতে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কতটুকু দীর্ঘস্থায়ী? বরাদ্দ বিষয় নয়। বছর শেষে সব মন্ত্রণালয়েরই খরচ করতে না পারায় বরাদ্দ ফিরে যাওয়ার গল্প আছে। তাই সবচেয়ে বড় প্রয়োজনটি ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরার। যদিও অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, কোভিড-১৯ মোকাবিলার অভিজ্ঞতায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। এরপর কথার ফুলঝুরিতে আটকে গেছেন।
তিন মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সব পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয়নি। যাও বা হয়েছে তার মান নিয়ে রয়েছে একাধিক প্রশ্ন। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বললেন, দীর্ঘ ছুটির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পাঠক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের যোগানও আছে। ভালো, কিন্তু কী হবে? বাচ্চাদের স্কুলের বিষয়ে, যথেষ্ট ভেবে মাঠে নামতে হবে। একদিকে স্বাস্থ্য সচেতনতা। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বাসায় থেকে তাদের মনের পরিবর্তন। জানেন তো অস্ট্রেলিয়ায় একদিন পরেই স্কুল বন্ধ করতে হয়েছে। এসব নিয়ে কি কোনো গবেষণা হচ্ছে? বাজেট এক বছরের আয়-ব্যয়ের বাইরে রাজনৈতিক দলিলও। কোথায় সেই দর্শন?
ব্র্যাকের সবশেষ জরিপ বলছে, এই করোনায় কৃষি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত। এরই মধ্যে সরকার কৃষককে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। সার, বীজের অবাধ সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করাসহ বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য পাওনা, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা খুঁজে বের করা নিয়ে কোনো নির্দেশনা বরাবরের মতো চোখে পড়ল না। আমাদের কৃষিকে আরও উন্নত ও স্ট্যান্ডার্ড মানে নিয়ে যেতে দরকার প্রচুর দক্ষ জনবল ও গবেষণা। এটা নিয়ে ভাবা ও নির্দেশনার দরকার ছিল মনে হয়।
তৈরি পোশাক খাত। এই খাত নিয়ে আমার তেমন বলার কিছু নেই। ৪০ বছর ধরে শিল্পটি অপরিকল্পিত থাকলেও নিজেদের সুবিধা নিতে তাদের কখনও ভুল হয় না। শ্রমিকের দোহাই দিয়ে বরাবর খাতটি সরকারকে চাপে ফেলে। অথচ এই সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। সেই স্বপ্নকে সামনে রেখে কিছু তরুণ নিরলস খেটে যাচ্ছে। গত ১২ বছরে দেশে অনেকগুলো স্টার্টআপও তৈরি হয়েছে। করোনার ধাক্কায় সেসব এখন নড়বড়ে অবস্থায়। অথচ ৪০ বছর পরেও দাঁড়াতে না পারা শিল্পকে ভর্তুকি না দিয়ে সরকারের কি অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় হয়নি?
করোনায় প্রথম প্রণোদনা পেয়েছে তৈরি পোশাক খাত। আজ বাজেটে দেখা গেল রফতানিতে নগদ প্রণোদনা ১ শতাংশ অব্যাহত রয়েছে। আবার সেই সাথে উৎসে কর কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যে শ্রমিকের কথা বিবেচনা করে সরকার সবসময় মাথা নুইয়ে থাকে, সেই তাদের ছাঁটাই কি বন্ধ হয়েছে? ধারাবাহিক বেতন ভাতা পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত হয়েছে?
সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় জায়গা ব্যাংক খাত। চলতি অর্থবছরেই নির্ধারিত অংক থেকেও অনেক বেশি ধার নিয়েছে সরকার। আবার আগামি অর্থবছরেও ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তাহলে সরকার এভাবে টাকা নিলে বেসরকারি খাতের কী দশা হবে? ওদিকে, ঋণ খেলাপিদের নিয়েও কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে শিল্প, সার্ভিস সেক্টর, এসএমই খাতে প্রণোদনা দিয়েছেন। এছাড়া সরকারি আরও কয়েকটি ব্যাংক ও এনজিওর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠিকে প্রশিক্ষণসহ নানা কাজে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া করোনাকে কেন্দ্র করে ৫০ লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে কথা থেকেই যায়। বাস্তবায়নে যারা থাকবেন তারা কি সেই সুবিধাভোগীর কাছে তা সুষ্ঠুভাবে পৌঁছাবেন? অতীত অভিজ্ঞতা তো ভয়াবহ!
ফিরে আসি রাজস্ব খাতে। এরইমধ্যে চলতি অর্থবছরেই আদায়ে ঘাটতি পড়েছে অনেক। সেই ঘাটতি নিয়েই অর্থমন্ত্রী নতুন যে হিসেব নির্ধারণ করেছেন তা কিছুটা স্বপ্নের মতোই। এর মধ্যেও দুই একটি নতুন খাত বের করেছেন। দিয়েছেন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। কিন্তু এত কম পরিমাণ টাকা সাদা হয় যে, এই সুবিধা দেওয়া না দেওয়ার কোনো মানে দাঁড়ায় না। স্বাভাবিক সময়েই ব্যবসায়ীরা কর মওকুফের জন্য ধর্ণা দিতে থাকে। এই করোনাকালীন সময়ে ব্যবসায়ীরা কি আদৌ কোনো ট্যাক্স দেবে? কৌশল কী?
করোনা থেকে মোটামুটি মুক্তিও কবে মিলবে তা কেউ জানে না। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে কয়েকবছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। উৎপাদন বাড়ানো, ব্যবসা চাঙা করা বা খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষগুলোর কাজ জোটানো যেখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সেখানে অর্থমন্ত্রী কোন বিবেচনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে নির্ধারণ করলেন তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। বাস্তবতার সঙ্গে এই লক্ষ্যমাত্রার কোনো বাস্তবতাই নেই।
সবাই তাকিয়ে ছিল বাজেট হবে করোনা মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বাজেট। গুরুত্ব পাবে করোনা মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে। কিন্তু পুরনো ধারাবাহিকতায় বাজেটে একগাদা প্রতিশ্রুতিই দেখা গেল। এই সময়ে দুনিয়াজুড়ে সবচেয়ে পরিচিত শব্দ ‘ভার্চুয়াল’। অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা বা এই সংস্থার আধুনিকীকরণে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘ভার্চুয়াল ইকোনমি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই শব্দটির সংমিশ্রণ করলে অর্থমন্ত্রীর গতানুগতিক বাজেটের সঙ্গে বেমানান লাগে। কারণ, এ যে পুরনো বইয়ে শুধুই নতুন মলাট!
লেখক: প্রজেক্ট ম্যানেজার, ইএসডিজি4বিডি, বিডিওএসএন