এই লড়াইয়ে হেরে গেলেন মোহাম্মদ নাসিম
১৩ জুন ২০২০ ১৬:৪৬
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম একজন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন । কখনোই অপশক্তির কাছে আপোষ করেননি। বরং সকল লড়াই সংগ্রাম সামনে থেকে মোকাবেলা করে গেছেন। কিন্তু তিনি জীবনযুদ্ধে আটদিন লড়াই শনিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শ্যামলী বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে গত ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। ওই দিনই তাঁর করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ৪ জুন তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন ভোরে তিনি স্ট্রোক করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়।এরপর দুই দফায় ৭২ ঘণ্টায় করে পর্যবেক্ষণে রাখে মেডিকেল বোর্ড। এর মধ্যেই পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি তাঁর শরীরে।
কয়েক দিন স্থিতিশীল থাকলেও গত বৃহস্পতিবার রক্তচাপ অস্বাভাবিক ওঠা নামা করতে থাকে নাসিমের। এরপর গতকাল শুক্রবার পরিস্থিতি আরো জটিল হতে থাকে। হৃদ্যন্ত্রে জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু আমরা আশা করেছিলেন, মোহাম্মদ নাসিম সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। এই সংকটকালীন অবস্থায় মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের চলা যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিনা।
সিরাজগঞ্জ-১ আসন (কাজীপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) থেকে তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের হুইপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দলের মুখপাত্র হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রাজনীতির সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম সম্পৃক্ত হন ষাটের দশকে। শুরুর দিকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ করতে শুরু করেন। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালের দোসরা এপ্রিল, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায়। তার পিতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী।
উনিশশো পঁচাত্তর সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় আরো তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তাঁর পিতা এম মনসুর আলী হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।
উনিশশো একাশি সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে মোহাম্মদ নাসিম যুব সম্পাদক হন। তখন থেকেই কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসেন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তীতে ১৯৮৭ তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তার আগের বছর, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। আওয়ামী লীগের ৯২ ও ৯৭ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১২ সালে কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়।
রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমকে অনেকবার কারাবন্দী হতে হয়েছে। প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে, যখন তিনি এইচএসসি পড়ছিলেন। সেই সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পিতা এম মনসুর আলীর সঙ্গে কারাগারে যেতে হয় মোহাম্মদ নাসিমকেও। একবছর পরে তিনি ছাড়া পান।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল মোহাম্মদ নাসিমকে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিযানে আরো অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই সময় অবৈধভাবে এক কোটি ২৬ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন ও ২০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত ২০০৭ সালে মোহাম্মদ নাসিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত ওই সাজা ও মামলা বাতিল করে দেন।
কিন্তু মামলায় সাজা হওয়ার কারণে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মোহাম্মদ নাসিম। সেই আসনে তার ছেলে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। মামলা ও সাজা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। এরপর তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করা হয়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকেন।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রী না হলেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলের মুখপাত্র হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মোহাম্মদ নাসিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হন। তার পূর্বেই ঝিনাইদহ এলাকায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, খুনখারাপির অভয়ারণ্য ছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই সময় অনেক সন্ত্রাসী আত্মসমর্পণ করেন। আর এই এলাকাকে মোহাম্মদ নাসিম সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ মুক্ত করেন। যেকারণে এই অঞ্চলের জনসাধারণ আজও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
মোহাম্মদ নাসিমের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাকে বিমোহিত করে। শুধু তাই নয়, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার পর সারাদেশে পরিবহন চাঁদাবাজি বন্ধ করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এরশাদ, খালেদা বিরোধী সকল আন্দোলনে সাহসের সাথে রাজপথে লড়াই করেছেন। তার এই লড়াই আমাদেরকে সাহস যোগায়। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর আমরা একজন বর্ষীয়ান, আদর্শবান, সাহসী নেতাকে হারালাম। যা কখনোই এই দেশের রাজনীতিতে পূরণ হওয়ার নয়। তার মৃত্যুতে সব মহলে শোকের ছায়া পড়ে গেছে। আজ হৃদয় জুড়ে শোকের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বিভিন্ন সময় মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের সান্নিধ্যে পেয়েছি। ২০১৬ সালে ঝিনাইদহে পুরোহিত হত্যার পরের দিন মোহাম্মদ নাসিম ভাই ঝিনাইদহে আসেন। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। একা মঞ্চে উঠতে পারছিলেন। তারপর আমার কাধে ভর করে মঞ্চে ওঠেন। সেই স্মৃতি কখনোই ভোলার নয়।
মোহাম্মদ নাসিম ভাই এদেশের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে রাজনীতির কিংবদন্তী হিসেবে বেঁচে থাকবেন। মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের অবদান এদেশের মানুষের চিরদিন স্মরণ করবে। মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ভাল থাকবেন নাসিম ভাই।
লেখক: সাইদুল করিম মিন্টু, সাধারণ সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ