Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংখ্যার বাইরে বাজেট: কিছু মিসিং লিঙ্কস এবং সহজ দিকনির্দেশনা


১৪ জুন ২০২০ ১৮:১২

প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট এদেশের সাংবাদিক, মিডিয়া, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, থিংক ট্যাঙ্ক এবং ‘তথাকথিত’ সোশ্যাল মিডিয়া চিন্তাবিদদের জন্য এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ‘উৎসব’ হিসেবে আবর্তিত হয়। টেলিভিশনে প্রায় শতাধিক টক শো, বেশ কয়েকটি ফেসবুক প্লাটফর্মে হাজার হাজার সংলাপ এবং কয়েক হাজার সংবাদপত্রের আরটিকেলস (এটিসহ) কেবলমাত্র এই একটি বিশেষ ইস্যু (জাতীয় বাজেট) সম্পর্কে লক্ষ্য করা যায় এমাসে।
আমি জুন মাসে টিভি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোগ্রামগুলিতে অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে ১০ ব্যক্তির (অর্থনীতিবিদ/নীতিনির্ধারক) নাম বলতে পারি যাদের আপনি নিজের জীবন এবং সন্তানের চেয়ে বেশি দেখতে পাবেন এই মাসে যদি আপনি ৭০ শতাংশ অনুষ্ঠানও অনুসরণ করে থাকেন। তাদের কেউ কেউ দেশের এই জরুরি সময়ে বাজেটের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অমূল্য মতামত জানাতে এক দিনে ৬ টি টক শোতেও অংশ নিয়ে থাকেন এবং ফেসবুকে প্রত্যেকটির স্ক্রিনশট আপলোড করেন এটুকু বুঝানোর জন্য যে তারা কতটা জরুরি অবদান রাখছেন দেশের জন্য। সন্ধেহাতীতভাবে এর সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যবহুল কাজ।

পেশাগত কারণে গত ৩-৪ বছরে এই বাজেটের প্রোগ্রামগুলির অনেকগুলিতে অংশগ্রহন করে আমি যে বিষয়গুলো বেশি শুনেছি তার মাঝে কিছু হল- ‘এই বাজেট উচ্চাকাঙ্ক্ষী”, ‘বাজেট ভালো হয়ছে তবে বাস্তবায়নই আসল চ্যালেঞ্জ’, ‘শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন’, ‘কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে’ এবং ‘সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ যথেষ্ট নয়’। কিছু থিঙ্কট্যাঙ্ক বাজেট ঘোষণার ঠিক ৭২ ঘন্টা আগ থেকে দিন রাত সবাইকে নিয়ে কাজ করেন এবং তারপরে তারা ১০০ পৃষ্ঠার উপর ‘সংক্ষিপ্ত বাজেট ধারণা’ প্রদান করেন!

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে, বাজেটকে কেন্দ্র করে যে বলয়টিতে বহুমাত্রিক জ্ঞান এবং ‘পলিসি ডায়ালগস’ উৎপন্ন হয়ে তার সবই গলতে শুরু হয় এবং আরও তিন সপ্তাহের মধ্যে এগুলি চিরতরে হারিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটির একটি ‘পুনরায় চালু করুন এবং পুনরাবৃত্তি করুন’ বোতাম রয়েছে যা পরের বছর জুনে আবার চাপ দেওয়া হবে। সত্যি বলতে, আমি গত তিন বছরে বেশ কয়েকটি টিভি শোতে অংশ নিয়েছিলাম এবং খুব কমই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি প্রতিবছর, বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছিলাম। এমনকি প্রোগ্রামগুলির আমন্ত্রিত বিশেসজ্ঞদের মুখগুলিও এক ছিল, কেবল আলোচনাই নয় (যদিও আমরা তিনটি পৃথক বাজেট নিয়ে আলোচনা করেছি প্রত্যেক বছরেই)। এই ‘জাতীয় অনুভূতির’ পুনরাবৃত্তির সম্ভবত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কম বেশি বাজেট প্রতি বছর প্রায় একই হয় (কিছুটা এখানে কিছুটা ওখানে সামঞ্জস্য করা হয়, কিছু সংখ্যার এদিকওদিক পুনর্বিন্যাস হয়)। দ্বিতীয়ত, বিশেষজ্ঞরা ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বা ডিমিনিশিং মারজিনাল ইউটিলিটির (যা যত ব্যাবহার করবেন তার তত গুরুত্ব কমবে) ধারনাটি উপেক্ষা করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে একই বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে পারেন বছরের পর বছর।

শেষ পর্যন্ত, নীতি নির্ধারক, থিংক ট্যাঙ্ক, অর্থনীতিবিদ এবং সুশিল সমাজের এই প্রচেষ্টা, পরামর্শ, প্রস্তাবনা, ভাল অনুভূতি, খারাপ অনুভূতি এবং হতাশা আমাকে একটি প্রবাদ মনে করিয়ে দেয়, ‘ডাক্তার আসার পূর্বে রোগীটি মারা গেলো’। আমি কেন এটা বলছি? সরকার আগের বছরের ডিসেম্বের অথবা একই বছরের জানুয়ারি থেকে বাজেটের পরিকল্পনা ও রূপরেখা গঠন করা শুরু করে এবং মন্ত্রণালয় এবং দায়িত্বশিল অংশীদারদের সমন্বয়ে বাজেটের খসড়া তৈরির কাজ শুরু করে। কয়েক মাস প্রস্তুতির পরে অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট ঘোষণা করেন জুনে। আমি অবাক হই যে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ‘জুন গ্লোরি’ (আলোচনা, পরামর্শ, ইনপুট এবং দিকনির্দেশনা) জানুয়ারিতে বা এমনকি আগের বছরের ডিসেম্বরে না এসে কেন এত দেরিতে আসে? এই মূল্যবান ইনপুটগুলো যদি ৪-৫ মাস আগে থেকেই সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হত তবে সরকারের সুযোগ থাকতো কিছু ইনপুট কাজে লাগানোর।

আমি মিডিয়াকে দোষ দিতে পারি না, কারণ মিডিয়ার ব্যবসাই হল চলমান ইভেন্টগুলির প্রতিনিধিত্ব এবং প্রচার করার উপর ভিত্তি করে। মিডিয়ার পক্ষে এটি যথেষ্ট ন্যায্য যে তারা বাজেটের বিষয়ে জুনেই অনেক সক্রিয় থাকবে। তবে, কেন নীতি নির্ধারক, চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরাও জুনে ‘হাইপার একটিভ’ হয়ে উঠবেন? তারা কি মিডিয়ার মত একই উদ্দেশ্যকে ধারন করেন (কভারেজ পাওয়া) জনগণের সামনে বার বার উপস্থিত হয়ে, জনগণকে জানানো যে তারা দেশের জন্য অবিচল কাজ করে যাচ্ছেন? যদি তা না হয় তবে কেন কারও বা কোনও সংস্থার কাছ থেকে বছেরের শুরুর দিক থেকেই কোনও ইনপুট পাওয়া যাচ্ছে না? আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এই থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো, গবেষণা সংস্থাগুলো, নীতি নির্ধারকমন্ডল এবং অর্থনীতিবিদগণ অবশ্যই ৪ মাস আগেই পরবর্তী বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার, জনগণ এবং সরকারের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে পারেন এবং মিডিয়াকে জড়িত করার সক্ষমতা রাখেন।

আমি এই নিবন্ধটিতে সংক্ষেপে এই বছরের বাজেটের শিক্ষা খাত এবং স্বাস্থ্য খাতকে ফোকাস করব। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়লকে ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগকে ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগকে ৮ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখন এই বরাদ্দের ধরণ তিনটি স্পষ্ট সংকেত দেয়:

১. প্রাথমিক শিক্ষায় এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দুই দশকের সাফল্যের পরেও বাংলাদেশ এখনও তার বার্ষিক শিক্ষা বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে আগ্রহী।

২. মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষাকে একই স্তরে বিবেচনা করা হচ্ছে কারণ এই উভয় স্তরই একসাথে বরাদ্দ পাচ্ছে। যা মোট শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাজেটের ৫০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় এবং হাই স্কুল পর্যায়কে আলাদা করে চিন্তা করা হচ্ছে না। গাণিতিকভাবে চিন্তা করলে, অনেকগুলো ভিন্ন ধরনের এলিমেন্টকে অথবা সাবসেটকে (মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়) ইউনিভারসাল সেটের (শিক্ষার) একটি এলিমেন্ট বা একটি সাবসেট হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

৩. কারিগরি শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে চূড়ান্তভাবে অবহেলা করা হয়েছে। অথচ, উভয়ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা সমাজের সব থেকে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির। কিন্তু শিক্ষার এই বিভাগটির জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট মোট শিক্ষা বাজেটের ১০ শতাংশেরও কম।

প্রশ্ন হল, একটি দেশ এবং তার অর্থনীতি ঠিক কতটুকু দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে উচ্চতর অগ্রাধিকার দেওয়ায় অটল থাকবে? যেখানে অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না (বাংলাদেশে চাকরির প্রবৃদ্ধির হার তার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় গত ৪-৫ বছর ধরে হ্রাস পাচ্ছে)। আমি মনে করি আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় চলে এসেছে, হয়তো আরও বছর পাঁচেক আগেই এসেছে। কারিগরি শিক্ষাকে ক্রমবর্ধমান এবং উচ্চশিক্ষার সমতুল্য করার সময়ও হয়ে গেছে এবং তার কারণ আমি পরে ব্যাখ্যা করব।

এখন, আসুন আমরা স্বাস্থ্য খাতে সামান্য আলোকপাত করি। বাংলাদেশ গত দুই দশক থেকে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির শেয়ার হিসেবে ১ শতাংশেরও নিচে ব্যয় করছে। তাই আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এবং বিশ্বে জনস্বাস্থ্য খাতে সর্বনিম্ন ব্যয় করা দেশগুলোর একটি। আমারা স্বাস্থ্য খাতে তা সত্ত্বেও, অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বিভিন্ন সূচকগুলিতে বিগত ২ দশকে ভাল করেছি। এই উন্নত পারফরম্যান্সের ফলাফলগুলি প্রাথমিক ও বেসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে আহরিত, যেমন শিশুদের টিকাদান, মাতৃস্বাস্থ্য যত্ন এবং সাধারণ রোগ নিরাময়। বাংলাদেশে জনসাধারনের আউট অফ পকেট স্বাস্থ্য ব্যয় ৭৫ শতাংশ (যা সার্ভিস ব্যবহারের সময় একজন রোগীর দ্বারা সরাসরি প্রদান করা হয় এবং কোনও বীমা কভারেজ দ্বারা পরিশোধিত হয় না)। এটি বিশ্বব্যাপী যে গড় রয়েছে (১৮ শতাংশ) তার তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারত, শ্রীলংকা এবং নেপালের তুলনায়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। এ অবস্থা তুলে ধরে যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা বেসরকারি হাসপাতাল এর সেবার উপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ সেবাগুলো শহর বা উপশহর অঞ্চলগুলোর বেসরকারি হাসপাতালে পাওয়া যায় যার ব্যয়ভার সেবাগ্রাহকদেরই বহন করতে হয়। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বুলেটিন (২০১৮) অনুসারে স্বাস্থ্য কর্মীদের এদেশে একটি গুরুতর সংকট রয়েছে যা তাৎক্ষনিকভাবে সমাধান করা প্রয়োজন। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে, প্রতি ১ হাজার ৫৮১ জনের জন্য কেবল একজন ডাক্তার রয়েছে। ডি.জি.এইচ.এসের অধীনে কাজ করা মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংখ্যা ১ জনেরও কম প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য এবং আবাসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২ জন করে। এই পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।

দিনশেষে, একজন সাধারণ নাগরিক এই সমস্ত সংখ্যা এবং বরাদ্দ সম্পর্কে চিন্তা করে না। বরং একজন সাধারণ নাগরিক যে সেবাগুলি গ্রহণ করে সে সম্পর্কে যত্নশীল। সুতরাং, বড় বাজেট, উচ্চাভিলাষী বাজেট এবং অনেক ভালো বাজেট সাধারণ নাগরিকের জন্য প্রায় শূন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ যদি সে তার প্রাপ্য সেবাগুলি না পায়। তাই বাজেটের অপ্টিমাম বা যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নীতিনির্ধারক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের কাছ থেকে গাইডলাইন অনুসন্ধান করা উচিত। একইভাবে, বিশেষজ্ঞগোষ্ঠীর বাজেট পর্যালোচনায় সংখ্যার খেলা, পারসেন্টেজের দক্ষতার পুনরাবৃত্তি না করে এবং ‘বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে’ এ ধরণের কথা না বলে, সরকারকে চ্যালেঞ্জগুলি বলা এবং কীভাবে সেগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে তার রূপরেখাও বলার কাজটি শুরু করতে হবে। নিঃসন্দেহে এ কাজগুলো জুন মাসের বেশ আগে থেকে করাটা জরুরি।

উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে আমার কিছু সহজ পরামর্শ:

১. সাধারণ শিক্ষার মত একই গুরুত্বসহ কারিগরি শিক্ষার প্রসার করতে হবে। এর জন্য পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের উন্নতি করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বল্প সময়ের (crash course) ইন্ডাস্ট্রিভিত্তিক দক্ষতা কোর্সের পরিমাণ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষকের মান উন্নয়ন করা, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং তাদের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। এই মুহুর্তে কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্পগুলো দাতাদের অর্থায়িত উন্নয়ন কর্মসূচির উপর বেশি নির্ভরশীল। সময় এসেছে সরকারের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলোতে নিজের নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার। কারিগরি শিক্ষা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা হতে পারে। সরকার তার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মানের কাজ শুরু করেছে। এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলিতে উৎপাদনের জন্য দক্ষ শ্রমশক্তির সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কেবলমাত্র কারিগরি প্রশিক্ষণই ভবিষ্যতে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলির জন্য দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে (যা আমি গত বছর (২০১৯) করেছি প্রফেশনাল কারণে) চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ের স্পেশাল ইকনমিক জোনে ২ মাসের উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৩০ হাজার দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল, তবে সেখানে ২ মাসে মাত্র ৪ হাজার জনকে নিয়োগ করা হয়েছিল দক্ষ কর্মীর উপস্থিতির অভাবে। অর্থাৎ প্রায় ২৬ হাজার চাকরির সুযোগ খালি থেকে যায়। বেতন স্কেল ছিল ১৬ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টকার মধ্যে, যা বাজারের মূল্যমানে আকর্ষণীয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, বাজেটে দেখা যাচ্ছে যে সরকার কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করছে না। স্পেশাল ইকনমিক জোনগুলোতে দক্ষ ও দ্রুততার সাথে কাজ করার জন্য, কারগরি প্রশিক্ষণে আরও বেশি বিনিয়োগ করে এই শিক্ষাটিকে সঠিক ট্র্যাকে তুলে ধরতে হবে। এত ক্ষুদ্র বরাদ্দের মাধ্যমে এগুলি কীভাবে ঘটবে? সুতরাং, সরকার বেসরকারি খাত এবং এনজিওগুলির সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করতে পারে স্পেশাল ইকনমিক জোনগুলোতে দক্ষ শ্রমিকদের বার্ষিক চাহিদা এবং প্রয়োজনীয় পেশাগুলিরও ফরকাস্ট করার জন্য। এভাবে প্রতিবছর দক্ষ কর্মীর চাহিদা বুঝে, কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রতি বছরের বাজেট জব মার্কেটের কর্মীর মোট চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা যেতে পারে।

২. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাকে পৃথক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ এবং কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। আন্ডারগ্র্যাড স্তরের সব শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে ৩ মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ বা শিক্ষানবিশ কর্মসূচী বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শেষ বর্ষে অদ্ধায়নরত শিক্ষার্থীদের ৩ মাস ধরে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। আমি বলছি না যে প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং প্রতিটি জেলার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এটি প্রথমেই সম্ভব, তবে কমপক্ষে ১৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৫ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (যারা এ প্রস্তাবিত পদ্ধতিটিকে বর্তমানে বাধ্যতামূলক নিয়ম হিসাবে অনুসরন করছেন না) দিয়ে শুরু করা উচিত। এই উদ্যোগ দুটি সমস্যার সমাধান করবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের ফার্স্ট হ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ভিত্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ তৈরি যার মাধ্যমে তারা ডিগ্রি শেষ করে চাকরির বাজারের জন্য আরও ভাল প্রস্তুতি নিতে পারবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রির প্রফেশনালদের সাথে এমন একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে সক্ষম হবে যা ডিগ্রির পাশাপাশি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সম্পদ হতে পারে। অতএব, বেসরকারি ও সরকাররি খাতের নিয়োগকর্তারা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি বৃহত্তর ইন্টার্নশিপ অথবা এপ্রেন্টিসশিপ প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারে। এরকম প্রজেক্ট আলাদা বাজেটের দাবি রাখে। যেসব নিয়োগকারি প্রতিষ্ঠান এই প্রোগ্রামে সরকারের পার্টনার হবে তাদের সরকার ইনসেনটিভ অফার করতে পারে। মনে রাখা দরকার, চাকরি পাওয়া প্রায়সই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সগুলিতে কী পড়াশুনা করি এবং কোন ডিগ্রি পাব শুধুমাত্র তার উপর নির্ভর করে না। নেটওয়ার্কিং এবং ইন্ডাস্ট্রি ভিত্তিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত জরুরি যা প্রস্তাবিত প্রোগ্রামগুলোর মত প্রোগ্রাম দ্বারা প্রমোট করা সম্ভব।

৩. টারশিয়ারি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারের আরও বেশি পরিমাণে (যা খরচ হচ্ছে তার উপর জিডিপির আরও ১ শতাংশ অতিরিক্ত) ব্যয় করা উচিত। হার্ট, ফুসফুস, কিডনি, রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কিত রোগগুলি বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান। এই রোগগুলি মোকাবেলায় সরকারি হাসপাতালের আরও সরঞ্জাম এবং লোকবল থাকতে হবে। কোভিড-১৯ প্রমান করেছে, যে টারশিয়ারি স্বাস্থ্যসেবাকে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার দেওযইয়া এখন সময়ের দাবি।

৪. কোভিড-১৯ এর এই সংকটের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকট সরাসরি উঠে এসেছে। সরকার বর্তমানে বেকার (এইচএসসি পর্যন্ত ন্যূনতম শিক্ষা আছে যাদের) বা করোনাকালে বেকার হয়ে পড়া ১ লাখ যুবক-যুবতীর প্রশিক্ষণের জন্য একটি ‘এমারজেন্সি হেল্‌থ ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ শুরু করতে পারে; যা স্বাস্থ্যকর্মী বৃদ্ধি করতে এবং বেকারদেরও চাকরি সন্ধান করতে সহায়তা করবে। এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামটি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রাথমিক দক্ষতা অর্জনে মোট ২০০ ঘন্টার ক্রাশ কোর্স প্রদান করবে। প্রশিক্ষণ শেষে দক্ষ কর্মীদের প্রথমে স্বল্প মেয়াদী চুক্তিসহ বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হবে (১ বছরের জন্য)। তারপর ‘অন জব’ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং পারফরম্যান্স যাচাইয়ের ভিত্তিতে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের চাকরিতে বহাল রাখা হবে। কর্মী ঘাটতিতে ভুগতে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলি সরকারের সাথে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং এন.জি.ও গুলি প্রশিক্ষণের ও বেতনের অর্থায়নে সহায়তা করতে পারে।

দিনের শেষে জাতীয় বাজেট আমার আপনার বাজেটের চেয়ে আলাদা কিছু নয়, যখন আমরা বাজার করতে কারওয়ানবাজার বা নিউমার্কেট যাই। পরিবারের সদস্যদের খুশি করার জন্য জিনিস কিনে দেওয়ার জন্য আমাদের পকেটে কিছু অর্থ থাকে এবং বাজারে যাওয়ার আগে আমাকে সেই অর্থ উপার্জন করতে হবে। একইভাবে, জাতীয় বাজেট হল এমন এক অর্থ যা নাগরিকদের ওয়েলফেয়ার কিনতে সরকারের পকেটে থাকে। সুতরাং, নাগরিকদের ওয়েলফেয়ার কেনার ক্ষমতা পাওয়ার জন্য সরকারের সেই অর্থ উপার্জন করতে হয়। সরকারের মূল উপার্জনের উৎস হল ট্যাক্স বা করের অর্থ যা সে নাগরিকদের থেকে পায়।  আরেকটি উপায় হল ঋণ নেওয়া। আর যেহেতু নাগরিকরা সরকারের কাছ থেকে সেবা উপভোগ করে তাদের কর আদায় করা যুক্তিযুক্ত। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের ট্যাক্স রেভিনিউ জিডিপির শতকরা ভাগ হিসাবে ৬-৯ শতাংশে এ ঘোরাঘুরি করছে। যার ফলশ্রুতিতে সরকার কীভাবে তার নাগরিকদের আরও উন্নত সেবা দিবে তা নিয়ে সমস্যা থেকেই যায়। অনেকটা আমি অনেক কিছু বাজার করে বাসায় এনে সবাইকে খুশি করতে চাই, কিন্তু আমার আয় কম।

ইদানিং যে দেশগুলির সাথে আমরা বাংলাদেশের সবকিছু খুব বেশি তুলনা করার চেষ্টা করি সেগুলি হল জার্মানি, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ড। জার্মানিতে জিডিপির শতকরা ভাগ হিসাবে ট্যাক্স রেভিনিউ ১২ শতাংশ (জার্মানির জিডিপি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তাই এই ১২ শতাংশ আসলে বিশাল), কানাডায় এটি ১২ শতাংশের উপরে (এটি বিশ্বের দশম বৃহত্তম জিডিপি সুতরাং এটিও বেশ বড় আয়) এবং নিউজিল্যান্ডে এটি ২৮ শতাংশের উপরে। প্রতিবেশি দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত সর্বনিম্ন। ব্যায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এই ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতকে কমপক্ষে ১৫-১৬ শতাংশে পুশ করতে হবে।

এখানে, দুটি প্রশ্ন আসে। প্রথমত, নাগরিকরা কি সঠিকভাবে ট্যাক্স দেয়? দ্বিতীয়ত, নাগরিকরা যদি জরুরি ও মানসম্মত সেবা না পায় এবং ভবিষ্যতেও পাবে কিনা সন্দেহ করে তবে তারা কেন সঠিকভাবে ট্যাক্স দেবে? প্রথম প্রশ্নের সন্দেহের জন্য, সরকার নাগরিকদের ওয়েলফেয়ার অপ্টিমাইজ করার ইকুইলিব্রিয়াম অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারন আমি এবং আপনি সঠিক পরিমাণে কর দেই না, তাই সরকারকের আয়ে বিশাল ঘাটতি থাকে। দ্বিতীয় প্রশ্নটির ক্ষেত্রে, নাগরিকরা নিম্নমানের এবং কম পরিমাণে সরকারি সেবার সাথে আপোষ করে ফেলে এবং সঠিকভাবে কর প্রদান করে না, তাই কর প্রদানের সুবিধা ভোগের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসের সাথে সরকারকে জবাবদিহি করতে পারে না। সুতরাং, নাগরিকরাও তাদের ওয়েলফেয়ার অপ্টিমাইজ করার ইকুইলিব্রিয়ামে পৌঁছাতে পারে না। এই ‘লুপটি বা বৃত্তটি’ আরও অনেক বছর অব্যাহত থাকতে পারে; শক্তিশালী ইন্সটিটিউশন; নাগরিক দায়িত্বশীলতা, সরকার আর জনগনের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি করতে না পারলে।

লেখক- গবেষক, ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন ইকোনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স

২০২০-২১ অর্থবছর ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বাজেট


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর