Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আত্মহত্যার মোড়কে হত্যা


২১ জুন ২০২০ ১৬:৫১

মানব সমাজের বিবর্তন হয়, বিবর্তন হয় সামাজিক রীতিনীতির, মূল্যবোধের। সামাজিক রীতিনীতির, মূল্যবোধের বিবর্তন সব সময় ইতিবাচক হয় তা নয়। সময়ের সাথে সাথে সমাজের অপরাধেরও বিবর্তন ঘটে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীদের পালাবার নজির রয়েছে সেই আদিম যুগ থেকেই। একটি নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণে তাই রাষ্ট্রের যেমন গোজামিলের আইন সংস্কার জরুরি তেমনি জরুরি সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধের ধরণ বিশ্লেষণ করা। অবশ্য রাষ্ট্র আসলে সেটি চায় কিনা তা আগে বিবেচ্য। অনেক সময় রাষ্ট্র অপরাধীদের পক্ষ না নিলেও অপক্ষমতার বিশেষ প্রভাবে অপরাধীদের এক ধরনের সেইফ এক্সিট দেয়।

সোজা বাংলায় রাষ্ট্র নীরব থেকে অপরাধীদের পালাবার সুযোগ করে দেয়। এতে একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কারণ অপরাধী এক প্রকার নিশ্চিত সেইফ এক্সিট এর সূত্র ধরেই অপরাধের পূর্বপরিকল্পনা করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অপরাধের (কেবল হত্যার) নতুন ট্রেন্ড বা চল হলো আত্মহত্যার মোড়কে হত্যা। সবচেয়ে বিস্ময়কর রহস্য হলো রাষ্ট্রের এ বিষয়ে এক প্রকার নীরব ভূমিকা পালন।

আত্মহত্যাকারীর পরিচয় মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে বলিউডের অভিনেতা যাই হোক না কেন। এর নজির বাংলাদেশসহ পাশের দেশ ভারত; সবখানেই এক। প্রতিদ্বন্দ্বী মেধার হোক, ক্ষমতার হোক, চাকুরীর হোক, অর্থের হোক, ক্যারিয়ারের হোক… সরিয়ে দেওয়া খুব সহজ আজ। হত্যা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে তার নিজ ঘরের ফ্যানের সাথে লটকিয়ে দিন। তারপর বাজারে ছড়িয়ে দিন সে মাদকাসক্ত ছিল কিংবা হতাশা ও মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল। প্রথম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলে দ্বিতীয়টি একেবারে খাপে খাপ মিলিয়ে দেওয়া যায়। বিশেষত, ভারত ও বাংলাদেশের মত কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশে যেখানে মানসিক রোগ এক ধরনের ট্যাবু।

হতাশা ও মানসিক চাপ প্রত্যেক মানুষের জীবনে একেবারেই সহজাত প্রবৃত্তি। একজন মানুষ হতাশ হলেই তিনি আত্মহত্যা করবেন এমন নয়। এটি ধ্রুব সত্য। অথচ এই গোঁজামিল দিয়ে হত্যাকে আত্মহত্যা মোড়কে ঢেকে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। আমরা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নই, তবে সংবাদের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করলে এই বিষয় সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব।

ঘটনা বিশ্লেষণ ১:
গত ১৪ জুন ২০২০ ভারতে বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেন। মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাসা থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অথচ, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুশান্তের মতো এমন অভিনেতা আত্মহত্যা করতেই পারেন না। এ ঘটনার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করেছেন সুশান্তের পরিবার। তারা বলেন, কয়েক দিন আগে সুশান্ত সিংয়ের সাবেক ম্যানেজার দিশা সালিয়ান আত্মহত্যা করেছেন বলে যে দাবি জানানো হয়েছে, সেটাও আসলে হত্যাকাণ্ড।

কেবল পরিবার নয়, বলিউডের অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত মনে করেন, সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যা করেননি, ওকে পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে। কঙ্গনা বলেন, ‘সুশান্তের মৃত্যু আমার মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে কিছু ব্যক্তি যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন, সুশান্ত মানসিকভাবে দুর্বল ছিল, ও অবসাদে ভুগছিল। যে ছেলে স্ট্যানফোর্ডের স্কলারশিপ পায়, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্স পরীক্ষায় র‍্যাংক করে, সেই ছেলে কি সত্যিই এত দুর্বল হতে পারে?’

পরিবার ও সহকর্মীদের দাবি যে একেবারেই ভিত্তিহীন নয় তার কিছু প্রমাণও মিলেছে গত দিন চারেকের সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনা থেকে । যেখানে এমন কিছু তথ্য নজরে এসেছে যে, সুশান্তকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে বলেও হতে পারে।

পুলিশের হাতে উঠে আসা কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য থেকে জানা যায় যে, অভিনেতা মারা যাওয়ার ঠিক আগের রাত থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কমপ্লেক্সের সব সিসিটিভি। আগের রাতে ফ্ল্যাটে এসেছিল সুশান্তের কয়েকজন বন্ধুও। ভেতর থেকে শোনা যায় হৈ হুল্লোড় করার শব্দ, যা সাধারণত ডিপ্রেশনে থাকার কোনো ইঙ্গিত নয়। মারা যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগেও তিনি বাইরে বেরিয়ে ছিলেন। ছিলেন খোশ মেজাজে, পাশাপাশি থাকা কয়েকজনের সাথে কথাও বলেন, “গরমটা আজ একটু বেশিই। এমনকি গলায় ফাঁস লাগানো বস্তুটিতে অভিনেতার শুধুমাত্র বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনী এবং কনিষ্ঠা ছাড়া আর কোনো আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। কিন্তু অভিনেতা বাহাতি ছিলেন না। সুতরাং বাম হাতে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণত এই প্রকারের সুইসাইডে মৃত্যুর সময় চোখ বড় বড় এবং হাত মুঠো করা অবস্থায় থাকে, যার একটিও অভিনেতার সাথে মিলছে না। তার সাথে পাওয়া যাচ্ছে না দরজার ডুপ্লিকেট চাবিটিও। তবে কি এটা সত্যিই সুইসাইড নাকি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করা মার্ডার?! তদন্ত চালাচ্ছে মুম্বাই পুলিশ। ধন্ধ মাখানো গন্ধ কিন্তু একটা থেকেই যাচ্ছে…।

এছাড়া পুলিশের দেওয়া সুশান্তের ক্রাইম সিনের ছবিগুলোকে বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুশান্ত আত্মহত্যা করেননি, তাকে শান্ত মাথায় খুন করা হয়েছে- এই দাবিতে দেয়া হয়েছে নীচের যুক্তিগুলি।

১. আত্মহত্যাকারী মৃত্যুকালীন সময়ে কিন্তু বাঁচার চেষ্টা করে। যার ফলে চোখ স্বাভাবিকের তুলনায় বড় থাকবে।

২. জিহ্বা বের হয়ে আসবে। সাথে লালা থাকবে।

৩. গলায় দড়ির চিহ্ন থাকবে ইংরেজি অক্ষর “V” এর মতো। কিন্তু এখানে আছে “O” এর মতো যা কাওকে মেরে ঝুলিয়ে দিলে হয়।

৪. আত্মহত্যায় মূলত মানুষ মারা যায় শ্বাস রোধ হয়ে নয়। মারা যায় ঘাড় ভেঙে মস্তিষ্কে আঘাত হওয়ার কারণে। যার জন্যে ঘাড় ভাঙা থাকবে। কিন্তু যা এখানে একদম স্বাভাবিক আছে।

৫. আগেই বলেছি বাঁচার চেষ্টা করবে যার ফলে হাতের মুষ্টি বন্ধ করা থাকবে। কিন্তু যা এখানে একদম স্বাভাবিক আছে।

৬. একজন ফাঁসিতে আত্মহননকারী চেহারা থাকে বীভৎস। ছবি দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে অজ্ঞান করে শ্বাস রোধ করে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

মৃত্যুর দুই ঘন্টা আগে বাড়ির লোকের সাথে কথা হয়েছিল। তারা জানিয়েছেন, আত্মহত্যা করবে এমন কোনো কথা বুঝতে পারেননি। আর সুশান্তের প্রতিবেশীরাও সরাসরি খুনের অভিযোগ করেছেন।

সুশান্তের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে পুলিশ জানিয়েছে, আত্মহত্যাই করেছেন সুশান্ত। তার শরীরে মাদক কিংবা বিষ পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, গলায় ফাঁস দেওয়ার ফলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে সুশান্ত’র মৃত্যু হয়েছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, সুশান্তের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার কারনে অক্সিজেন স্বল্পতায় মারা গেছেন। এই অক্সিজেন ঘাটতির কারণ সুশান্ত নিজে নাকি অপরাধী তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন? মানে এটি সুইসাইড না হয়ে হোমোসাইড হবার সম্ভাবনা থেকে যায়…।

ঘটনা বিশ্লেষণ ২:
সুশান্তের ঘটনার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত সংবাদ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীকের আত্মহত্যার ঘটনার। নিজ বাসার সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে পরিবারকে জানানো হয়। পরিবারের অনুপস্থিতে লাশ নামিয়ে মর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। পরিবার মর্গ থেকে লাশ আনতে যাবার আগেই পুলিশ পরিবারের বয়ান না শুনে অপমৃত্যু মামলা করেন। এমনকি লাশ ময়নাতদন্ত না করে পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দেয়া হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের লেকচারার হিসেবে আবেদনের পর থেকে বিভাগের কিছু শিক্ষকের নানাভাবে তাকে নম্বর কম দেওয়া, সুপারভাইজার না দেওয়াসহ নানা ইস্যু তৈরি করে তাকে শিক্ষাগত জীবনে বঞ্চিত করতে থাকে- এই বিষয়ে পরিবার আগে থেকেই অবগত ছিল। এমন কি প্রতীককে শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষার অনুমতি পত্র না দেওয়া ও অনার্সে প্রথম হওয়া ছাত্রকে মাস্টার্সে ৭ম করা হয়। এ নিয়ে প্রতীকের মধ্যে হতাশা ছিল। আর সে কারণেই পরিবার তাকে জিআরই দিয়ে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেন। জিআরই পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে সে যখন আমেরিকা যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সেই সময় সিলেট থেকে খবর পান প্রতীকের পরিবার যে, প্রতীক নিজ বাসার সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।

পরিবার লাশ আনতে গেলে জানানো হয় শিক্ষাগত জীবনে ফলাফল খারাপ করায় হতাশায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরিবার সেটি মেনে নিয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনা দাতা শিক্ষকদের দায়ী করলে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক প্রতীককে মাদকাশক্ত বলে প্রচার করতে থাকে। যদিও পুলিশের তদন্ত রিপোর্টে প্রতীককে মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো হয়। তবে এর জন্য কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি পুলিশ।

ঠিক তেমনি শিক্ষকদের দেওয়া মাদকাশক্ত তকমাও ভুল প্রমাণ করে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। মৃত্যুর দুই দিন আগেও পারিবারিক উৎসবে হাস্যোজ্জ্বল প্রতীকের চোখে মুখে কোন বিষাদ দেখতে পায়নি প্রতীকের পরিবার। মাস খানেকের মধ্যে স্বপ্নের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে যে ছেলে সে কেন হতাশায় আত্মহত্যা করবে? এ প্রশ্নের উত্তর ততদিন মিলেনি যতদিন প্রতীকের পরিবারের হাতে প্রতীকের সুরতহাল সময়ের ঝুলন্ত ছবি না পৌঁছায়। যে ছবির সাথে সুরতহাল প্রতিবেদনের বিশাল গড়মিল খুঁজে পান প্রতীকের বাবা মো. তৌহিদুজ্জামান। যিনি পরবর্তীতে এই অমিলগুলো তুলে ধরে তার একমাত্র সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে চিফ মেট্রোপলিটন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, আদালত, সিলেট এ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রতীক হত্যার পুনঃতদন্তের আবেদন করেন। কিন্তু প্রতীক হত্যার প্রায় দেড় বছর ও আদালতে পুনঃতদন্তের আবেদনের প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে বিষয়ে আদালত কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি।

প্রতীকের বাবা পুলিশ বুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে নতুন করে পুনঃতদন্তের আবেদন করেছিলেন। কেন প্রতীকের পরিবার প্রতীকের হত্যাকে আত্মহত্যা বলে মানতে পারেননি তার সাথে সুশান্তের শেষ সময়ের অর্থাৎ সুরৎহাল প্রতিবেদনের সময়কার ছবির বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। প্রতীকের ছবি ও সুরতহাল প্রতিবেদনের গড়মিলগুলো লক্ষ্য করলেই বোঝা সম্ভব হবে।

প্রতীকের ছবিতে দেখা যায় যে, মৃতের দুই হাত গলায় ফাঁসের কাপড়ে লাগানো, ফাঁসের কাপড় গলার এক পাশে থুথুনিতে লাগানো, ফাঁসের কাপড়ের গিট মাথার উপরে, বাম পা চেয়ারে লাগানো, মৃতের শরীরের প্রায় ৪০ ভাগ চেয়ারে ভর দেওয়া, মৃতের দুটো চোখই বন্ধ ও জিহ্বা মুখ হতে বের হয়ে দাঁতে কামড় দেওয়া নাই।

কেননা আত্মহত্যার প্রধান আলামতগুলো মৃত প্রতীকের ঝুলন্ত লাশের তোলা ছবিতে দেখা যায়নি-

১. ফাঁসের সময় চেয়ার সরে না যাওয়া।

২. ফাঁসের কাপড় গলার মাঝখান দিয়ে গিয়ে বৃত্তাকার হয়ে ঘাড়ের উপরে গিট না থাকা এবং ফাঁসের কারণে ঘাড় একটু বাঁকা হয়ে না থাকা।

৩. মৃতের জিহ্বা মুখ হতে বের না হওয়া এবং জিহ্বায় দাঁতের কামড় পরিদৃষ্ট না হওয়া।

৪. চোখ দুটো খোলা ও ছানাবড়া না থাকা।

প্রতীকের বাবা বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা মৃতের উপরিউক্ত অবস্থা দেখার পর স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা কোন আত্মহত্যার ঘটনা নয়, এটা হত্যার ঘটনা। কেননা এখানে আত্মহত্যার কোন আলামত পরিদৃষ্ট হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার তদন্তকালে সঠিক বিষয়ে মন্তব্য ও তদন্ত না করে সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা করেছেন।

তদন্তকারী কর্মকতা কর্তৃক মৃতের লাশের তোলা ছবি এবং লাশ নামানোর পর তার প্রস্তুতকৃত সুরতহাল রিপোর্টের প্রাপ্ত গরমিলগুলো হলো:

(ক) মৃতের লাশ নামানোর পূর্বে তোলা ছবিতে মৃতের দুটি চোখ বন্ধ দেখা যায়। অথচ সুরতহাল রিপোর্টে একটি চোখ খোলা ও অপরটি বন্ধ লেখা হয়েছে।

(খ) সুরতহাল রিপোর্টে লেখা আছে, মৃতের ডান হাত অর্ধবাঁকা হয়ে পেটের উপর আছে। অথচ ছবিতে মৃতের দুই হাতই বাঁকা হয়ে গলার পাশে ফাঁসের কাপড়ে আটকানো ছিল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাম হাতের দুটি আঙ্গুল ফুলে গাঢ় নীল হয়ে আছে।

(গ) সুরতহাল রিপোর্টে লেখা আছে, মৃতের মুখ অর্ধ খোলা এবং জিহ্বায় কামড় দেওয়া। অথচ মৃতের ঝুলন্ত ছবিতে দেখা যায় মৃতের ঠোঁট দুটি একটু ফাঁকা কিন্তু মুখ বন্ধ রয়েছে। মৃতের জিহ্বা বের হয়নি এবং দাঁতে কামড় দেওয়া দৃশ্যমান নয়। প্রকৃতপক্ষে আঘাতের কারনে মৃতের ঠোঁট ফোলা ও রক্তাভ দেখা যায়।

(ঘ) সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, মৃতের ডান পায়ের পাতা চেয়ারে লেগে থাকার কারনে কালো দাগ আছে। যা সম্পূর্ন বানোয়াট। প্রকৃতপক্ষে ছবিতে মৃতের ডান পা নয় বরং বাম পা প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁকা অবস্থায় চেয়ারের মাঝখানে পরে আছে। আর যে কালো দাগের কথা বলা হয়েছে তা আঘাতের চিহ্ন বহন করছে। আঘাতের কারনে বাম পা ও এর গোড়ালি মোচড়ানো ও ভাঙ্গা দেখা যায়। বাম পা ও গোড়ালি ভাঙ্গা না থাকলে মৃত্যু যন্ত্রনার সময় পা সোজা হয়ে সে দাড়িয়ে যেত।

(ঙ) যেভাবে ফাঁসের কাপড় গলার উপরে অর্থাৎ থুথুনিতে এবং দুটি হাত ফাঁসের কাপড়ের সাথে আটকানো, মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করার সময় উক্ত ফাঁস অবশ্যই খুলে যেত।

(চ) যে পাতলা জাতীয় কাপড় দিয়ে থুথুনিতে লাগানো ফাঁস প্রায় ৮৫ কেজি ওজনের একটি লোক মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট ও নড়াচড়া কালে তার ভার বহনে যথেষ্ট নয়, তা অবশ্যই ছিঁড়ে যেত।

(ছ) একটি অবাক করার মতো বিষয় যে, ছবিতে ফাঁসের কাপড় এতই দূর্বল ছিল যে তাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য মৃতের শরীরের প্রায় ৪০ (চল্লিশ) ভাগ চেয়ারের উপর ভর দেওয়া ছিল তা ছবিতে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাহলে এটি ফাঁসের ঘটনা নয়। হত্যা করে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসের নাটক সাজানো হয়েছে।

(জ) সুরতহাল রিপোর্টে নাক ও মুখ দিয়ে সাদা পানি বের হওয়ার তথ্য বিভ্রান্তিকর। ছবিতে এমনটি দৃশ্যমান নয়।

(ঝ) তদন্তকারী কর্মকর্তা মৃতের ভবনের নীচ তলার গেইটে স্থাপিত সিসি টিভির ফুটেজ পরীক্ষার কথা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। ২৭/০৩/১৯ইং তারিখে প্রতীকের বাবা নিজে সিসি টিভির ফুটেজ পরীক্ষাকালে দেখেন ঘটনার ১৩/০১/১৯ইং ও ১৪/০১/১৯ইং তারিখের ফুটেজ শূণ্য অথচ ঐ তারিখের আগে ও পরের ফুটেজ রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ১৩/০১/১৯ইং রাত আনুমানিক ১০টা হতে রাত ২টার মধ্যে ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করেছেন। ভবনের কেয়ার টেকার রাহুল জানায়, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৩/০১/১৯ইং রাত ৯টার দিকে প্রতিক তার মৃত অবস্থায় পাওয়া হাফ প্যান্টটি পড়ে বাসা হতে বের হয় কিন্তু প্রতিক ঠিক কয়টায় বাসায় ফিরে আসে সে তা জানাতে পারেনি। তদন্তকারী কর্মকর্তা যেহেতু বলেছেন, ১৩/০১/১৯ইং আনুমানিক রাত ১০টা হতে ঘটনার সূত্রপাত। তাহলে এই সমীকরন মিলে যায় যে, প্রতিককে বাইরে থেকে মেরে এনে তার বাসার ফাঁসে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই প্রতীকের পরিবারের সন্দেহ। কেননা সিসি টিভির এই প্রকার লুকোচুরি এর ইঙ্গিত দেয়।

মৃতের তোলা ছবি ও পরে প্রস্তুতকৃত সুরতহাল রিপোর্টের অসংগতি ও গরমিল এবং সিসি টিভির ফুটেজ না থাকার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটাই পরিস্কার হয় যে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। যাকে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে সেই তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রতীক আত্মহত্যা করেছে এটি প্রতীকের পরিবার না মেনে আবেগতাড়িত হয়ে ছবি ও সুরতহাল রিপোর্টের গড়মিলের অভিযোগ করেছে যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয় বলে দাবি করেছে প্রতীকের পরিবার। এমন কি সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট লেখা রয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা সুরতহাল প্রতিবেদন লেখার সময় ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন লেখার সময় চিকিৎসক কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিংবা ভীত হয়ে প্রতিবেদনে তথ্য গোপন করেছিলেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন প্রতীকের পরিবার।

উল্লেখ্য যে, বিগত সময়গুলোতে দেখা গেছে যে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আত্মহত্যা হিসেবে তদন্ত শেষ হওয়া একাধিক মামলার ফের তদন্ত করে দেখেছে এর অনেক ঘটনাই ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পুলিশি তদন্ত ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল আত্মহত্যা। যেমন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দিয়াজের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর প্রথম ময়নাতদন্তে বলা হয়, এটি আত্মহত্যা। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আসে শ্বাসরোধে মৃত্যু। সেই কারনে প্রতীকের পরিবার পিবিআই এর মাধ্যমে নতুন করে পুনঃতদন্তের আবেদন করেছিলেন।

অন্যদিকে বলিউড অভিনেতা সুশান্তের পরিবার দাবি করেছে, সুশান্ত আত্মহত্যা করেনি। সুশান্তকে হত্যা করা হয়েছে। তারা সুশান্তের মৃত্যুতে সিবিআই তদন্ত করা হোক বলে দাবি করেছেন।

ঘটনা ১ এবং ঘটনা ২ কেবল বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা নয়। আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা রোজ ঘটছে। আত্মহত্যার মোড়কে হত্যা- সমাজে সংগঠিত অপরাধের নতুন এক চল। এই চলকে কঠোর হাতে রুখে দিতে হবে আমাদের।

সুশান্ত ও প্রতীকের মৃত্যু আত্মহত্যার মোড়কে হত্যা হোক বা না হোক, তার মৃত্যুর তদন্তের দাবি শুধু পরিবারের দাবি না হোক। বলিউডের একজন তরুণ প্রতিভাবান অভিনেতা কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া মেধাবী ছাত্রের অকাল মৃত্যুর বিষয়ে স্বচ্ছ ও প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য পুনঃতদন্তের দাবি- দেশের দাবি হোক। তবেই কেবল একটি নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

লেখক: চেয়ারপার্সন, কমিউনিকেশন ডিজওরডার্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর