গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ: বিবেচ্য বিষয় ও সংকটসমূহ
৫ জুলাই ২০২০ ২৩:০৪
দক্ষিণ এশিয়ার আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াও অনেক সমস্যার সমাধান স্থানীয়ভাবে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় করা হয়। দ্রুত বিরোধ সমাধানের প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রয়োগ এই অঞ্চলে বহু বছর ধরে চলে আসছে। এই অনানুষ্ঠানিক বিচার পদ্ধতি বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানে কিভাবে কাজ করে এবং অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া প্রান্তিক মানুষের জন্য কীভাবে আরও অংশগ্রহণমূলক করা যায়, তা নিয়েই এই আলোচনা।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে বহমান। সংবিধান নিজেই এই প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে আসছে। সংবিধান সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রত্যেকটা রূপেই ন্যায়ের কথা বলে। জনগণের জন্য ন্যায় বিচার সাংবিধানিক নির্দেশ কিন্তু সংবিধানে বিচারিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে যার মাঝে বহু মানুষের ভিড় এবং দীর্ঘসূত্রিতা উল্লেখযোগ্য।
অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি অনেক বেশি সহজ এবং কার্যকরী মনে হলেও এর সমস্যাও আছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রায়শই যথেচ্ছা কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়। আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ায় নিয়মতান্ত্রিকতার উপর বেশি গুরুত্ব দিলেও তার কার্যকারিতা ও মানুষের কাছে পৌঁছানো নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। যদি আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকাই সেখানে বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, অনিয়ন্ত্রিত কাজের চাপ এবং কর্মচারী-কর্মকর্তার অভাব উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে মানুষের এই দীর্ঘসূত্রিতায় অনাগ্রহ আছে এবং অনেকে এই আইনি প্রক্রিয়ার খরচ টানতে অক্ষম। এছাড়া তারা জানে না কোন প্রক্রিয়ায় লড়াই করে ন্যায় বিচার আদায় করতে হয়। এজন্য স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান বেশি কার্যকর মনে করে এ অঞ্চলের জনগণ। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত এবং পাকিস্তান; এসকল অঞ্চলের গ্রামীণ সমস্যাগুলো যেমন নারী নির্যাতন, উত্তরাধিকার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, যৌতুক, বিবাহ বিচ্ছেদ, মহিলা ও শিশুদের ক্ষেত্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং ভূমি বিরোধ; যা ফৌজদারি সমস্যার থেকে বেশি সামাজিক সমস্যা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় সমাধান করা হয়।
বাংলাদেশের গ্রাম্য আদালত ও বিচারের ন্যায্যতা
বাংলাদেশের উপনিবেশবাদ থেকে পাওয়া এক প্রতিকূল বিচার ব্যবস্থার উত্তরাধিকার ধারণ করে চলছে, যা আনুষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চলে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সমাজের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয় এবং এই অক্ষমতা নিয়ে কারো বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই। এ বিচারব্যবস্থার খরচ প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ বহন করতে পারে না। এছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, নিয়মতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে গরীব মানুষের ক্ষেত্রে বিচারকদের অনিরপেক্ষ আচরণের মতো বহু অনিয়ম লক্ষণীয়।
আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাঝে সমন্বয় করতে বাংলাদেশ ২০০৬ সালে ‘গ্রাম্য আদালত আইন’দিয়ে শালিস ব্যবস্থা সংশোধন করে। ২০০৬ সালের এ আইন মোতাবেক স্থানীয় সরকারের নিম্নস্তরের একটি ধাপ হিসেবে প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে একটি গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় অনানুষ্ঠানিক বিরোধ সমাধান প্রক্রিয়া একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে একটি বিকল্প পথ তৈরি হয়। আদর্শিকভাবে এই গ্রাম্য আদালত প্রচলিত শালিস ব্যবস্থা (যা সাধারণের জন্য অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর) এবং নিয়মতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার (আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া) একটি অসাধারণ সমন্বয়।
তবে সংশোধন সত্ত্বেও এই গ্রাম আদালত যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য কতটুক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। গরীব মানুষগুলো সমাজের মূলধারা থেকে আলাদা এবং বৈষম্যের শিকার, যে কারণে তারা এই অনানুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। যদিও তারা কখনো সুযোগ পায় তখন আবার ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির মত নানা কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। উপরন্তু, প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এর কার্যকারীতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেখানে গ্রাম আদালতের ক্ষমতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সেখানে তার সক্ষমতা বাস্তবিক অর্থে খুবই অপর্যাপ্ত। নিয়ম অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর উপজেলা পরিষদে রিপোর্ট প্রদান করার কথা, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। অন্যান্য কাজের চাপেই ইউনিয়ন পরিষদ অনেক ব্যস্ত থাকে, তাদের বিচারিক রায়ের হিসেব এবং প্রত্যেক ছয় মাসে ফর্মাল রিপোর্ট তৈরির মতো যথেষ্ট জনবল নেই।
ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ভারতের পঞ্চায়েতের ভূমিকা
বাংলাদেশের মতোই একই ধরণের সমস্যাগুলো ভারতে পঞ্চায়েত বৈঠকে সমাধান করা হয়। দেশটির সংবিধানে ৪০নং অনুচ্ছেদে এ রাজ্যগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তারা যেন পঞ্চায়েতদের সংগঠিত করে এবং তাদের নিজস্ব সরকারের অঙ্গ হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। দেশটিতে নতুন নতুন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অমীমাংসিত মামলার দীর্ঘ তালিকা ভারতীয় আদালতের প্রধান দুটি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রিতা প্রধান অন্তরায়। যে কারণে গরীব এবং প্রান্তিক মানুষ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার চেয়ে পঞ্চায়েতের কাছে বেশি আস্থা পায়। এই বিচারকার্যের সদস্যদের প্রতীকী সম্মাননা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের পরিশ্রমের মূল্যায়ন করা হয়। পারিবারিক সহিংসতার বিষয়গুলোও পঞ্চায়েতে সমাধান করা হয়।
নেপালের অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা
নেপালে প্রচলিত বিরোধ নিষ্পত্তির দীর্ঘ ইতিহাস দেখা যায়। সেখানে ১০২ রকমের ভিন্ন বর্ণ এবং নৃগোষ্ঠী রয়েছে তার পাশাপাশি ৯২ ধরণের আলাদা ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। এ রকম বৈচিত্র্য বিরোধ নিষ্পত্তির সমাধানের পথকেও বিস্তৃত করে যেখানে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের নিজস্ব সমাধান পদ্ধতিও বিদ্যমান। রানা শাসনামলে প্রথাগত বিচার ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে তাতে এই পদ্ধতি একেবারে হারিয়ে যায়নি। বর্তমানে এই ব্যবস্থাকে আমরা উদীয়মান আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থা বলতে পারি যেখানে গ্রাম্য বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার সাথে একটা সমন্বয় ঘটেছে। সরকার মধ্যস্থ আইন (The Mediation Act) বাস্তবায়নের মাধ্যমে উভয় প্রক্রিয়ার মাঝে সমন্বয় করতে একটা ঐক্য আনার চেষ্টা করছে।
তবে খুব অল্প সংখ্যক গ্রামে এই সমন্বয় লক্ষ করা যায়। বরং সেখানের বিরোধগুলো প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ‘গ্রাম উন্নয়ন কমিটির’ (Village Development Committee) সম্পাদক দ্বারাই সমাধান করা হয়ে থাকে। সম্প্রদায়গুলোতে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ‘গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’ (VDC) এমন কিছু বিরোধ নিষ্পত্তি করে যেখানে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কখনো পৌঁছাতেই পারবে না। যেমন, ছোটখাটো শারীরিক আঘাত, মৌখিক আক্রমণ, পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি, সম্প্রদায় কর্তৃক কোন ব্যক্তিকে ত্যাজ্যকরণ এবং স্থানীয় উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিরোধসমূহ।
পাকিস্তানে বহুমাত্রিক বিচার ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা
পাকিস্তানে একইসাথে বহুমাত্রিক বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান আবার সেখানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও বেশ প্রভাবশালী। পঞ্চায়েত বিচার ব্যবস্থায় উভয় লিঙ্গের অধিকারের প্রতি সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয় না, এখানে নারী ও শিশুকে সমঝোতা ও ক্ষতিপূরণের একটি সরঞ্জাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমন অনিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থায় কতটুকু নিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা রয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই অনিশ্চিত। পাকিস্তানের এই প্রথাগত চর্চিত বিচার ব্যবস্থায় গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান। এখানে যেমন লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে তেমনি পঞ্চায়েতদের স্বজনপ্রীতিও লক্ষণীয়।
যাই হোক, দেশগুলোতে আনুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের অনেক ধরণের দুর্বলতা অতিক্রম করা সম্ভব। যেখানে ২০১৬ সালে সংসদে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন তৈরি করা হয় সেখানে এ আইন কার্যকর করা নিয়ে স্থানীয় সরকারের উদ্যোগ প্রায় শূন্য। এখানে অর্থনীতির বিষয়াবলী বিচার ব্যবস্থার সাথে অনেকটা সংযুক্ত এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন অধিক কার্যকর বিচার ব্যবস্থা হতে পারে, ফলশ্রুতিতে আদালত, সম্পৃক্ত সকলে এমনকি অর্থনীতিও উপকৃত হবে।
তৃণমূলের বিচার ব্যবস্থা কিভাবে কার্যকর করা যেতে পারে
স্থানীয় সরকারের অধীনে গ্রাম্য বিচার বিভাগে আইনি কর্মসংস্থানের আরও বেশি সুযোগ সুবিধা উন্মুক্তকরণ এবং আইনি প্রক্রিয়ায় প্রবেশের অধিক মাধ্যম তৈরি করতে হবে, যেখানে তাদের নিজস্ব সম্পত্তিকে অধিক ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরি হয়। কোনো ব্যক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত নীতিমালাগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেখানে গ্রামীণ সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে, একইসাথে তাদের সমস্যাগুলো আইনি কর্মকর্তাগণ ন্যায্য সালিশির নামে শুনতে পারে।
যদিও এখনও এই প্রক্রিয়ায় নারীরা কম গুরুত্ব পায় তবে গ্রামের দরিদ্র মহিলা এবং অসহায় গোষ্ঠীই গ্রাম আদালতের মূল লক্ষ্য। এই আদালতগুলো নারীবান্ধব হওয়া খুবই জরুরী। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও বিচারক প্যানেলসহ গ্রাম্য আদালতের প্রত্যেক কর্মকর্তা কর্মচারীর লিঙ্গ নিরপেক্ষ ব্যবহার করা দরকার, অন্তত একজন নারীকে বিচারক প্যানেলে মনোনয়ন দেয়ার নিয়ম থাকতে হবে, বিশেষ করে যে সকল কেসে নারীরা সম্পৃক্ত।
গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থায় ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষে নীতিনির্ধারকরা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অস্বীকৃতি জানানোসহ তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করতে পারবেন, অধিবেশনগুলো জনসম্মুখে ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করবে এবং প্রয়োজনে বিচারক প্যানেলের কাউকে রদবদলের ক্ষমতা দিতে হবে। সিদ্ধান্তগুলো প্রয়োগের জন্য আদালতকে সুবিন্যস্ত করতে হবে এবং আদালতের নীতিমালার সাথে মৌলিক অধিকারগুলোর সমন্বয় ঘটাতে হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতাগুলো বিচারিক তদারকির আওতাধীন থাকা এবং আদালত সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক সহায়তার বিধান নিশ্চিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
[ “Access to justice for marginalised rural victims across South Asia: Issues and challenge” শীর্ষক লেখাটি ৮জুন ২০২০ তারিখে London School of Economics (blogs.lse.ac.uk) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবন্ধটি “Journal of Contemporary South Asia”তে ২৬ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত “Rural dispute resolution in Bangaldesh: How do village court safeguard justice?” নামক প্রবন্ধ থেকে অভিযোজন করা হয়েছে]
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
অনুবাদ: ফয়সাল, শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়