কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশ
৬ জুলাই ২০২০ ১৮:৩০
মানব সভ্যতার জন্য কোভিড-১৯ এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চায়নার উবেই প্রদেশের উহানে প্রথম কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় যা ক্রমেই সারাবিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। চলমান মহামারিতে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব উদ্ভুত সংকট মোকাবেলায় কঠিন সময় পার করছে। তথাপি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ বিমান, স্থল ও নৌবন্দরসহ শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ৮ ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। ২৬শে মার্চ হতে সারা দেশে লকডাউন কার্যকর করা হয়।
কোভিড-১৯, স্বল্প আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য, অন্ন ও অর্থনীতির সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা, প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা, ১ কোটি রেশন কার্ডের বিপরীতে খাদ্য সহায়তা, প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগণকে ত্রাণ সহায়তাসহ ৩০০ কোটি টাকার কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীগণ সাধারণ মানুষের প্রতি খাদ্য সহায়তাসহ নানাবিধ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন যা দুর্যোগ মোকাবেলায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
মহামারি চলাকালীন ত্রাণ বিতরন ও লাশ দাফনসহ নানাবিধ কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে অনেক নেতাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। তাদের সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। কোভিড-১৯ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কোন দেশই এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে এই মহামারি মোকাবেলা করতে পারবে না। সেটি মাথায় রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্থবহ কৌশল ও বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে এবং বৈশ্বিক দায়িত্ববোধের প্রেক্ষাপটে সার্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বনেতাদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং বৈশ্বিক সম্মেলনে পাঁচ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ তহবিলে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার প্রদান করেন এবং একই সাথে দক্ষিণ এশিয়াতেও তহবিল গঠনের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
করোনা মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্নিঝড় ‘আমপান’ আঘাত হানে। মাননীয় প্রধাণমন্ত্রীর সঠিক পরকিল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ ঘূর্নিঝড় সফলতার সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় এবং ৩ রা জুন ব্রিটিশ ডেইলি গার্ডিয়ান পত্রিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রসংশা করা হয়। এছাড়াও বিশ্বের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ফোর্বস কোভিড মোকাবেলায় জননেত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে।
উন্নত বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাও যখন মহামারি মোকাবেলায় বিপর্যস্ত তখন আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ ও অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়েও মহামারি মোকাবেলা করে যাচ্ছি। যদিও গত এক যুগে বর্তমান সরকারের আমলে স্বাস্থ্য খাতের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং জনগণের স্বাস্থ্য সূচক বাড়তে থাকে এবং আন্তর্জাতিক নানা খেতাব অর্জিত হয়েছে। তবুও জনবহুল দেশ বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতে আরও মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনায়ও সরকার নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাসপাতালের অবকাঠামোগত দিক ও রোগীর সংখ্যাধিক্যের কথা চিন্তা করে সারাদেশে হাসপাতালসমূহকে কোভিড ও নন-কোভিড; এ দুভাগে বিভক্ত করে রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী সরবরাহ করা ও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একই সাথে কোভিড রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসরণ করে মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘চিকিৎসা গাইডলাইন’ প্রস্তুত করা হয়।
মহামারি মোকাবেলায় লোকবল সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। সময়ের সাথে বেসরকারি হাসপাতালসমূহকে কোভিড চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১টি RT-PCR ল্যাব হতে পর্যায়ক্রমে ৬৮টি ল্যাব স্থাপন করা হয়। একই সাথে ভেন্টিলেটর, হাই-ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা, অক্সিজেন, আইসিইউ বেডসহ আইসোলেশন সেন্টারসহ কোভিড চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতাল সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমনকি চিকিৎসার সকল খরচ সরকার বহন করছেন। সরকারের যথাযথ গৃহিত পদক্ষেপের কারণেই আমাদের দেশে মৃত্যুহার অনেক কম, এমনকি বিগত প্রায় ১ মাস ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা একই মাত্রায় বজায় রয়েছে, কোন কোন জেলায় দৃশ্যমান উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।
স্বাস্থ্যখাতকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সকল সময়েই প্রধান্য দিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
মহামারি মোকাবেলায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীগণ নিজেদের জীবনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে রেখে নানা প্রতিকূলতার ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্বপালনে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে ইতিমধ্যে ৭০-এর অধিক সহকর্মী চিকিৎসককে আমরা হারিয়েছি। এরই মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাদেরই একজন সহকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় যা খুবই মর্মান্তিক ও সকল চিকিৎসকের জন্য কষ্টদায়ক। প্রাণ হারানো সকল সহকর্মীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ও প্রিয়জন হারানো পরিবারের জন্য রইলো সমবেদনা।
এরই মধ্যে মাস্ক কেলেংকারী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসকবান্ধব নয় এমন কিছু সিদ্ধান্তে যদিও সকল চিকিৎসক মর্মাহত ও হতাশ কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসকগণ তাদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ হতে বিন্দুমাত্র পিছু হটেনি। চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিন্দন ও কৃতজ্ঞতা। ইতোমধ্যে চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সাধুবাদ জানিয়েছেন, এদেশের জনগণও কৃতজ্ঞতার সাথে দূর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসকদের অবদানকে স্মরণ রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে স্বাচিপ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে টেলিমেডিসিন ও কিছু জেলায় ভ্রাম্যমান চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেই সাথে সারাদেশে করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকগণের সাথে কেন্দ্রিয়/স্থানীয় স্বাচিপ নেতৃবৃন্দ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তবে আমাদের পুরোপুরি সফল হতে গেলে স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করে লাল ফিতার দৌরাত্ম কমাতে হবে এবং দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগনের জন্য আশির্বাদ। তার সঠিক নির্দেশনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আমরা মহামারি মোকাবেলায় সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছি। এই বৈশ্বিক দূর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগ তখনই সফল হবে যখন জনগণ সক্রিয়ভাবে সহোযোগিতা করবে। জনগণকে সরকার নির্দেশিত সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে তবেই সংক্রমণের হার কমে আসবে, আমরা ফিরে পাবো আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ধারা।
বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়…।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।