Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা পরবর্তী নিউ নরমাল বাংলাদেশ: সংকটের বিপরীতে সম্ভাবনা


৬ জুলাই ২০২০ ২১:৩৯

নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ সৃষ্ট অতিমারীতে বিপর্যস্ত বিশ্ব, এবং বলা হয়ে থাকে সভ্যতার ইতিহাসে এমন দুঃসময় আর আসেনি। প্রাথমিক অবস্থায় একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বিপন্নবোধ করছে। সেই সাথে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতি স্বজন হারনোর বেদনা নিয়ে ভবিষ্যত চিন্তায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে উঠছে এবং উঠবে। চলমান বাস্তবতা মানিয়ে নিতে ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় যে নিউ নরমাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তা পৃথিবীর চেহারায় স্থায়ী পরিবর্তন আনবে। কিন্তু সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যক্তিমানুষের আচরণগত অভিযোজন বিশ্বব্যাপী সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে আমূল পরিবর্তন আনবে তা অবশ্যই ইতিবাচক এবং বিশ্বাস করি করোনা পরবর্তী পৃথিবী একদিন করোনার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাবে।

বিজ্ঞাপন

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লবের, ২য় শিল্পবিপ্লব ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর আর ৩য় শিল্পবিপ্লব ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে যা শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বিপ্লব বা ৪র্থ শিল্পবিপ্লব। ডিজিটাল এ বিপ্লবে আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা থেকে রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থায় সব কিছুই পরিবর্তন হওয়ার কথা গাণিতিক হারে। চলমান বিশ্বসভ্যতায় কাঙ্ক্ষিত ৪র্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে ফিউচারিষ্টদের যত ভাবনা ছিল কোভিড-১৯ সব হিসাব নিকাশ নতুনভাবে করতে বাধ্য করছে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে ডাটা ও সেন্সর বেইজড ইনক্লুসিভ ভবিষ্যৎ এভাবে তরান্বিত হবে, সেটা শুধু ফিউচারিষ্টরা নয়, সাইন্সফিকশন গল্পকাররাও বোধকরি স্বপ্নেও ভাবেননি।

বিজ্ঞাপন

কোভিডের অ্যান্টিভাইরাস নিয়ে যতই তোড়জোড় শুরু হোক না কেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে কোভিড টিকে থাকবে আগামী সভ্যতার সমান্তরালে হয়তো অন্য ফরমেটে, তাই সকল অতিমারী প্রতিরোধে সাসটেইনাবল ইনক্লুসিভ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষই অভিযোজিত হবে সকল প্রকার সংকটের বিপরীতে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। আশার কথা, গ্লোবাল ভিলেজে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো চাইলেও বোধকরি বেশিদিন খুব বেশি পিছিয়ে থাকতে পারবে না চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দুনিয়ায়। কেননা টেকনো জায়ান্টরা তাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যাপি শক্তিশালী ব্যাকবোন তৈরি করবে, যেমন ৩য় বিশ্বের দেশগুলোতে জাপানী গাড়ি ব্যবসার স্বার্থে জাপানই রাস্তা তৈরির সহায়তা দেয়। প্রয়োজন শুধুই রাষ্ট্রের পলিসি সাপোর্ট, যা অতিশয় সহজলভ্য হয়ে উঠবে প্রায় সব দেশে। অবশ্য ব্যতিক্রম হিসেবে কোন দেশে ন্যূনতম সেনসিবল সরকার যদি না থাকে তবে বলতেও পারে ‘সাবমেরিন ক্যাবল সব তথ্য চুরি করে নেবে’, যদিও এই রিস্ক আগামীতে আরও কমবে। এআই, আইওটি, বিগ ডাটা, মেশিন লার্নিং, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, ন্যানো ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এমনকি বাঙালি বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান আবিস্কৃত অধরা কনা নিয়ন্ত্রণ করবে নয়া সভ্যতার গতিপথ।

কোভিড-১৯’র প্রভাবে বিশ্ব বাস্তবতায় ভবিষ্যত বাংলাদেশের চেহারা নিয়ে ভাবাটা খুব জরুরী। ব্যক্তি মানুষের যাপিত জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, কৃষি ও খাদ্য, পরিবেশ, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, বিনোদন, শিল্প-সাহিত্য- এমন কোন খাত বাদ থাকবে না যার খোল-নলচে পাল্টাবে না। জীবনদর্শন, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনা, দেশপ্রেম, দায়িত্ববো, সবকিছুর প্যারাডাইম শিফট হবে অভাবনীয়ভাবে। ভাবনা-চেতনার সকল স্তরে অনিবার্য পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।

তাই কোভিড পরবর্তী বাংলাদেশ বা সমাগত ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে দেশের সকল সেক্টরের ভবিষ্যতের জন্য নতুনভাবে বিশেষজ্ঞদের ভাবতে হবে এবং তদানুযায়ী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে কর্তাব্যক্তিদের। কোভিড পরবর্তী লিগ্যাসি তৈরিতে এখনই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে মনে করি নিম্নোক্ত সেক্টরসমূহে কোভিডের প্রভাব অবিশ্বম্ভাবী এবং প্রস্তুতি নেবার এখনই সময়:

১. ব্যক্তি মানুষের আচরণ, যাপিত জীবন ও নয়া সমাজ
২. দেশের অর্থনীতিতে সংকট ও সম্ভাবনা
৩. কোভিড পরবর্তী রাজনীতি
৪. পরিবর্তিত পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান
৫. ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে দেশের শিল্পায়ন
৬. নিউ নরমাল এডুকেশন
৭. কৃষিমুখী সভ্যতার জাগরণ
৮. পরিবেশবান্ধব স্বদেশ-সভ্যতা
৯. আগামীর কর্মসংস্থান-সঙ্কটের মধ্যেই অসীম সম্ভাবনা
১০. গণস্বাস্থ্য ও আগামীর স্বাস্থ্যসেবা
১১. বিনোদন ও প্যাশনের বিবর্তন
১২. করোনা পরবর্তী গ্রামীন অর্থনীতি ও সংস্কৃতি
১৩. কোভিড পরবর্তী প্রশাসন
১৪. আগামী দিনের শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চা
১৫. আগামীর পর্যটন
১৬. পরিবর্তিত পৃথিবীতে ধর্মচর্চা
১৭. আগামীর নগর পরিকল্পনা ও স্পেস ম্যানেজমেন্ট
১৮. কোভিড পরবর্তী মিডিয়া
১৯. নয়া উদ্যোক্তা ও আগামীর বাণিজ্য
২০. নয়া দুনিয়ার তথ্য-প্রযুক্তি

বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে পুনর্ভাবনা করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরী। আমি আমার মতো করে কয়েকটি অনুচ্ছেদে অতিশয় সংক্ষেপে পরিবর্তিত কাঠামো নিয়ে কিছু ভাবনা শেয়ার করতে চাই।

স্থায়ীভাবে বদলে যাচ্ছে মানুষ ও তার যাপিত জীবন:
করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নতুন শব্দ বোধকরি “স্যোসাল ডিসট্যান্স”। যদিও অনেকেই এই টার্মোলজি মানতে রাজি নয়, তারা ফিজিক্যাল ডিসট্যাসিং শব্দে বেশি আগ্রহী। তবে বাংলাদেশের মতো সর্ব্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ডিসট্যাসিং নিশ্চিত করাটা দুরূহ, তবুও যতটুকু হচ্ছে সেটাই কেউ কল্পনা করেনি আগে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একত্রে থাকবে, একে অন্যের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে এটিই মানবধর্ম। করোনা এই মানবধর্মকে তরান্বিত করছে কিন্তু প্রক্রিয়াটি এতটাই আত্মরক্ষামূলক যা সামাজিক রীতি-নীতিকে উল্টে দিচ্ছে, ফলশ্রুতিতে নিজেকে মানুষ হিসেবে অথবা অমানুষ হিসেবে প্রমান করার সুযোগ এসেছে। সামষ্টিক বিবেচনায় আমি সময়টাকে সম্ভাবনাময় মনে করি যা উত্তরাধুনিকতাকেও চ্যালেঞ্জ করবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হবে ভার্চুয়াল ও একচুয়াল ওয়ার্ল্ডে মানুষের দ্বৈত উপস্থিতি, এমনকি ঘুমিয়ে থাকলেও কানেক্টেড থাকবে সেন্ট্রাল ডাটা বেইজে। রাউন্ড দ্যা ক্লক সার্ভাইলেন্স এথিকস নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। রাষ্ট্র সিটিজেন প্রাইভেসি নিশ্চিতকরণের কথা বললেও স্রষ্টার কাছে যেমন ফাঁকি দেয়া যায় না তেমনি অথরিটি বা নানা রঙের সংস্থা সে চেষ্টাটাই চালাবে।

১. মানুষকেই সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাববে মানুষ, এড়িয়ে চলবে একে অন্যকে। এখন বিচ্ছিন্ন থাকাটাই বেঁচে থাকা তবে সেটা হবে কনসাস লিভিং। হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি যুগের অবসান হয়েছে ইতোমধ্যেই। ব্রজেস্বর চরিত্রের শুচিবায়ুগ্রস্থতাই স্বভাবিকতায় পরিণত হবে। মনখারাপ বা হাসি-আনন্দের ইম্প্রেশন ঢাকা পড়বে মাস্কের নীচে। লাইফস্টাইলের সাথে মানুষের ইন্টারেকশন স্টাইল পাল্টে যাবে। নাক-দাঁত পরিণত হবে গোপনাঙ্গে। বাঙালির চিরায়ত আড্ডা রূপান্তরিত হবে ভার্চুয়াল আড্ডায়।

২. হেলদিয়ার ডিজিটাল লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত হতে হবে সবাইকে, যার গতি হবে জ্যামিতিক হারে। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শেখাতে ১০ বছর সময় লেগেছে ইউনিসেফের, আর করোনা তা শিখিয়েছে মাত্র কয়েক মাসে। বিভিন্ন অ্যাপ আর রোবোটিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়বে বিদ্যুৎ গতিতে। ই-কমার্সের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবা ঘরে বসেই পাবে সবাই। কায়িক শ্রম সংকুচিত হবে এবং ব্যক্তি মানুষ সকলেই হয়ে উঠবে পার্ট অব সিস্টেম। টেকনোলজি এডাপ্টেশন করতে যে সামান্য সময় লাগবে তা নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। যেমন মফস্বল আইনজীবি সমিতিসমূহ ভার্চুয়াল আদালতের বিরোধিতা করলেও আমাদের সামনে জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে রাইড শেয়ার। মেট্রিক অর আন্ডার মেট্রিক লক্ষ লক্ষ তরুণ সকলের অজান্তেই নিজের পেশা গড়ে নিয়েছেন উবার, পাঠাও এর মাধ্যমে। সেখানে আইনজীবিরা তো লার্নেড গ্রাজুয়েট, তাদের প্রযুক্তি আত্মস্থতে সময় আদতে লাগবেই না।

৩. আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিতে বাসার তেল, নুন ফুরিয়ে গেলে প্রতিবেশীর দরজায় নিঃসঙ্কচে কড়া নাড়তো মানুষ, ভালো রান্না বা ট্রে ভর্তি শবেবরাতের হালুয়া রুটি যাবে না আর পাশের বাড়ি। চিরতরে হারিয়ে যাবে এই সম্প্রীতিবোধ। বিপরীতে পারিবারিক চাহিদার সাপ্লাই চেইন হয়ে উঠবে নিরবচ্ছিন্ন।

৪. হোম অ্যাসিসট্যান্ট বা গৃহপরিচারিকা জামানার শুভ সমাপ্তি ঘটলো অভাবনীয় ভাবে। ‘এসো নিজে করি’ প্রতিষ্ঠা পাবে সব পরিবারে। “পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ”- ধর্ম যেখানে বাধ্য করতে ব্যর্থ, করোনা সেখানে অব্যর্থ। ওয়েস্টার্ন সমাজের মতো ঘরে-বাইরে সকল কাজেই সমানভাবে অংশ নেবে নারী-পুরুষ।

৫. “অতিথি নারায়ণ” যুগের অবসান হবে দুনিয়া থেকে। মামা-ভাগ্নে, চাচা-ভাতিজা সম্পর্কের নস্টালজিয়া আর ফিরে আসবে না। জন্মদিন, মুখেভাত, মুসলমানীসহ সকল সেলিব্রেশন, পারিবারিক উৎসব-আনন্দ আয়োজন সবকিছুই হারিয়ে যাবে বা সংকুচিত হবে অবিশ্বাস্যভাবে।

৬. নানা জাতীয় দিবস, ঈদ-পূজা-নববর্ষ-নবান্ন উৎসব, এমনকি বিয়ে-সাদীর জৌলশপূর্ণ অনুষ্ঠানও সীমিত আকার পাবে ভিন্নমাত্রায়। মহল্লার বা এপার্টমেন্টের কমিউনিটি হল/সেন্টারগুলোর পরিনতি হবে গ্রামের হারিয়ে যাওয়া কাচারি ঘরের মতো। প্রি-কোভিড সময়ের কমিউনিটি কালচার পোস্ট কোভিডে এসে অনেক গতিময় হবে কেননা সময় তখন ভার্চুয়াল কমিউনিটির।

৭. বিনোদনের প্যারাডাইম শিফ্ট মেনে নিতে হবে সবাইকে। ওপেন এয়ার কনসার্ট, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্ষাবরণ-বসন্তবরণসহ সকল উম্মুক্ত আয়োজন উপভোগ করতে হবে ঘরে বসেই, লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে। খাঁ খাঁ করবে রমানার বটমূল, চারুকলার বকুলতলা, রবীন্দ্র সরোবর এমনকি টিএসসি চত্বরও। অমর একুশে বইমেলার স্থানে রকমারি ডটকমে বন্দী হবে আমাদের বই কেনা। সিনেমা হলের জায়গা দখল করেছে যে সিনেপ্লেক্স তার ভবিষ্যৎও অজানা। ছায়ানট বা ঢাকা থিয়েটারের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

৮. বিদায় ঘন্টা বাজবে বাবুগিরির। কোভিড আমাদের ক্ষুদ্রতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বাহুল্যবর্জিত হবে পারিবারিক জীবন। নীড এসেসমেন্ট হবে টু দা পয়েন্ট। কোভিড এবার মানুষের সক্ষমতা ও বাগম্বাড়িতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে ফলে অপচয় কমাতে বাধ্য হবে সবাই। বেসিক লিভিংয়ের উপর দাড়িয়ে স্মার্ট লিভিংয়ে উন্নীত হতে সচেষ্ট হবে সবাই। লাখ টাকার কোরবানীর গরু কিনে ফুটানী দেখানোর দিন শেষ। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা সুরক্ষা দেয়নি এবার অভিজাত শ্রেণিকে। শ্রেণিবিভাজনের বেলুন ফুটো করে দিয়েছে করোনা।

৯. খাদ্যাভ্যাসে আসবে আমূল পরিবর্তন। যা খাবে, যতটুকু খাবে তা হবে পুষ্টিকর। প্রকৃতির কাছে নতজানু হতে হবে সবাইকে, প্লান্ট বেইজড গ্রীন লিভিং কাঙ্ক্ষিত হবে সবার। জাঙ্ক ফুড, প্রসেসড ফুড এমনকি রেস্টুরেন্টের খাবার নির্ভরতা আশংকাজনকভাবে কমে যাবে। পসার বাড়বে অর্গানিক ফুডের। সবার কিচেন হয়ে উঠবে স্বাস্থ্যকর। নাক সিঁটকানো মসলাময় ভারতীয় রন্ধন পদ্ধতি বিশ্বময় জনপ্রিয় হবে।

১০. মানুষের ফিজিক্যাল মোবিলিটি ক্রমহ্রাসমান হবে এবং এটি সফস্টিকেশন লিভিংয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে। স্মার্ট লিভিং মডেল জনপ্রিয় হবে। ব্যক্তি ব্যয়ের অনেক খাত লুপ্ত হবে। বিপরীতে যুক্ত হবে নতুন নতুন খাত। যেমন বিয়ে-সাদী, সামাজিকতা, নিত্য পরিভ্রমন, পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট/কাজের মানুষ, নানা পরিসেবা প্রভৃতির মতো খাতে অপব্যয় হ্রাস পাবে এবং প্রযুক্তি সহজলভ্য হবে, বিপরীতে প্রযুক্তির পরিধি এতটাই বাড়বে যে মাসিক খরচে রাখতে হবে বড় বরাদ্দ। তবে লেনদেন হয়ে যাবে ক্যাশলেস। জরুরী ব্যবস্থাপনায় কৌশলী হয়ে উঠবে সকল নাগরিক।

১১. ডাটা এক্সসেস বা ডাটা প্রাপ্তি মৌলিক অধিকারে যুক্ত হবে, সেই সাথে মুক্ত তথ্যের উম্মুক্ত দুনিয়ায় নীতি-নৈতিকতা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হবে। শুধু আজকের নয়, আমার আগামীকালের ভাবনাকে আমার আগে নির্ধারণ করবে এলগারিদম, কনসাস লিভিং তা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সেটা একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন হবে। জীবনবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা- এমন অনেক টার্মোলজির প্যারাডাইম শিফট হবে, তবে তা অবশ্যই কল্যাণকর ভবিষ্যতের জন্য। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সকল প্রকার অধিকারের নয়া অর্গানোগ্রাম তৈরি হবে।

১২. বদলে যাবে মানুষের বাসস্থান ভাবনা। জীবাণুমুক্ত জীবন গড়তে দূর্গ হয়ে উঠবে প্রতিটি গৃহ। নিবিড়তম সময় কাটাবে সবাই পরিবারের সাথে, সভ্যতার ইতিহাসে যা আগে এতটা কখনও দেখা যায় নি। তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে ‘অফিস ফ্রম হোম’ ধারণাটি আমাদের দেশেও বিগত কয়েক বছর ধরে আলোচিত হচ্ছিল, অনেকে যুক্তও ছিল। কোভিড সেটিকে নগরের প্রতি ঘরে প্রতিষ্ঠা করবে। সকল পেশাজীবিদের ঘরের ইন্টোরিয়রে পরিবর্তন আসবে। সকল গৃহে আলাদা রুমে অফিস কক্ষ না হলেও একটা কর্ণার করতে হবে ওয়ার্ক স্টেশনের জন্য। তবে ড্রয়িং রুম, গেস্ট রুম, সার্ভেন্ট রুমের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। হোম গার্ডেনিং জনপ্রিয় হবে, সবাই সর্ব্বোচ্চ সময় থাকতে চাইবে সবুজের সাথে।

১৩. অসততা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজের দিকে দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাবে আগামী। হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে ই-গভর্নেন্স এবং সমন্বিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফাঁকি দেওয়া বেশ দুরূহ হবে। সিঁদেল চোর থেকে ব্যাংক ডাকাত সবার জন্য কঠিন হবে আগামী। দার্শনিকভাবে অপরাধমুক্ত বিশ্ব সম্ভব নয় তবে ‘অপরাধ’ এর সংজ্ঞা পরিবর্তিত হবে। কোভিডের প্রাথমিক ধাক্কায় অনেককেই পেটের খিদে টেনে নিয়ে যাবে অপরাধের চোরাগলিতে। আপত দৃষ্টিতে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, চুরি-ছিনতাই বা অমানবিক আচরণ বাড়লেও আদতে মানুষ হয়ে উঠবে অনেক সহনশীল, মানবিক ও দায়িত্বপূর্ণ। যেমন- যে মানুষটি কুকুর ভয় পায়, প্যান্ডেমিককালে সেই দায়িত্ব নেয় একপাল কুকুরের খাদ্য জোগানের।

১৪. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ভাবনায় আমূল পরিবর্তন আসবে। ব্যায়াম ও যোগাব্যায়াম নিত্য অনুষঙ্গ হবে মানুষের। সকল খাবার গ্রহণ করবে ক্যালরী চার্ট অনুযায়ী। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ডাটা রাউন্ড দ্যা ক্লক অটো কানেক্টেড থাকবে সেন্ট্রাল হেলথ ডাটা বেইজে। অস্বাস্থ্যকর কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই আপনাকে সতর্ক করবে সেন্ট্রাল টেকনোলজি। চাইলেও অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন কঠিন হবে। মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পাবে। সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যায় করণীয় নির্ধারণে নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে, ক্রিটিকাল কন্ডিশন ছাড়া মানুষ হাসপাতালমুখী হবে না, অধিকাংশ সাধারণ রোগ-বালাইয়ের চিকিৎসা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ঘরে বসেই পাবে মানুষ।

১৫. ব্যক্তি মানুষের পরিবেশ ভাবনায় র‍্যাডিক্যাল পরিবর্তন আসবে। প্রাণিজগতের সকল প্রাণি ইকো ফ্রেন্ডলি শুধু মানুষ ছাড়া। ইতোমধ্যেই সভ্যতার নামে আমরা পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত ঘটিয়েছি প্রায় ৮৩ শতাংশ প্রাণি এবং ৫০ শতাংশ উদ্ভিদের, যার অর্ধেকই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে গত ৫০ বছরে। পৃথিবীর উপর মানুষের মতো সমান অধিকার ছিল গোটা প্রাণিজগতের, প্রাক কোভিড সময়ে আমরা তা হরণ করেছি, তাই বলা হয়ে থাকে কোভিড আসলে প্রকৃতির প্রতিশোধ যার ফলে রিকনস্ট্রাক্ট হবে পৃথিবী। পোস্ট কোভিড সময়ে মানুষের সকল ভাবনা ও আচরণ হবে পরিবেশবান্ধব।

ইতিহাস বলে, যতবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে মানুষের, ততবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষ। কিন্তু মানুষকে এবার এমনভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে যাতে পাল্টে যাবে সভ্যতার গতিপথ। এই অভিযোজনে কোলেটারাল ড্যামেজ হবে অনেক, যা মেনে নিতে হবে সবাইকে- যারা টিকে থাকবে তাদের হাতেই নির্মিত হবে নয়া সভ্যতা। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় কোভিড-১৯ যদি পৃথিবীতে নাও আসতো তবুও এই পরিবর্তনটি অনিবার্য ছিল, হয়তো সময় লাগতো আরও কিছুটা। আমি আশাবাদী মানুষ, বিশ্বাস করি সংকট যতই তীব্র হোক না কেন বদলে যাওয়া বিশ্বে বাংলাদেশও আত্মমর্যাদা আনিয়ে এগিয়ে চলবে সময়ের সাথে।

পোস্ট কোভিড সময়ে পরিবর্তিত স্বদেশ ভাবনায় হাজারও বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে কিন্তু তা কতটুকু সাসটেইনাবল ও ইনক্লুসিভ হবে সেটাই মূখ্য বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে শুধু ব্যক্তি মানুষের যাপিত জীবনে করোনার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আমার সামান্য ভাবনা শেয়ার করলাম। আগামী কয়েকটা পর্বে সামষ্টিক প্রভাবের কিছু বিষয় নিয়ে মতপ্রকাশের ইচ্ছা আছে।

৪র্থ শিল্পবিপ্লব করোনাকাল করোনাকালীন জীবন কোভিড-১৯ নিউ নরমাল সুমন জাহিদ

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর