মন চায় পাহাড় তুলে আছাড় মারি!
৬ জুলাই ২০২০ ২০:৫৩
ফেসবুকে কারো কারো বিভিন্ন বিষয়ে বিপ্লবী পোস্ট দেখে অনেক আগে শোনা একটি চুটকি মনে পড়ছে। একদিন এক লোক একটি উঁচু পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছিলেন। আরেক লোক অনেকক্ষণ সেটা দেখে কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। অন্যের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল একটু বেশিই থাকে। তিনি ভাবুক ব্যক্তির কাছে গিয়ে বললেন, কিছু মনে না করলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?
ভাবতে ভাবতেই তিনি জবাব দিলেন। করুন?
– আপনি কি কিছু নিয়ে বিশেষ চিন্তিত?
– হুম।
– কি নিয়ে?
– আমার মন চায়, এই পাহাড়টা তুইলা আছাড় মারি।
– ভালো তো। মারুন না। এখানে কেউ বাঁধা দেওয়ার নেই।
– ভাইরে শক্তিতে যে কুলায় না!
কিছু করতে হলে শুধু ইচ্ছা থাকলেই হবে না। সামর্থও থাকতে হবে। ফেসবুকে যারা ঝড় তোলেন তারা খারাপ কিছু সহ্য করতে পারেন না। তারা শুধু ভালোর প্রত্যাশা করেন। কিন্তু পৃথিবীতে ভালো-খারাপের দ্বন্দ্ব তো নতুন কিছু নয়। ভালো চাই, খারাপ করি।
পৃথিবীতে হয়তো ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। সংখ্যায় খারাপ মানুষ কম। কিন্তু সংখ্যাগুরু ভালো মানুষেরা হলেন, নির্বিরোধ এবং নিষ্ক্রিয়। সংখ্যালঘু খারাপ মানুষ আবার সক্রিয় এবং যা খুশি তাই করে ফেলতে পারেন। তাই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভালো মানুষের চেয়ে খারাপ মানুষের হাতেই বেশি থাকে বা চলে যায়।
ভালো মানুষ যদি ক্ষমতাবান হয়ে একটি খারাপ কাজ করেন তাহলে ভালো মানুষেরা একযোগে তার বিরোধিতা করেন, হৈচৈ করেন। খারাপ মানুষেরা খারাপ করলে, হয়তো মৃদু সমালোচনা করেন, তবে তাড়াতাড়ি তা ভুলেও যান।
আমরা ভালো মানুষের শাসন চাই, সুশাসন চাই– এটা যদি সত্য হয়, আন্তরিক হয়, তাহলে খারাপ শাসন চলে কীভাবে? আমাদের চাওয়ায় কী কোনো ভেজাল আছে, গলদ আছে?
আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। অনেক বছর ধরেই আছে। আমাদের দেশে শুধু নয়, অন্য অনেক দেশেও শেখ হাসিনার চেয়ে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তিনি তার শাসনকালে ভালো কাজ বেশি করেছেন, না খারাপ কাজ বেশি সেটা একটি দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়।
আমি যদি বলি, শেখ হাসিনা ভালো কাজ বেশি করেছেন, সঙ্গে দু’একটি মন্দ কাজও করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আপনি তেড়ে উঠবেন, বলেন কী, শেখ হাসিনার মতো দুঃশাসক আর হয় না।
যদি বলি, তিনি তাহলে ক্ষমতায় টিকে আছেন কীভাবে?
ফেসবুকে বিপ্লবীর জবাব পাওয়া যাবে: আরে ক্ষমতায় তো আছেন জোর করে। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ওপর নির্ভর করে। বিরোধী দলকে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করে।
যদি বলি, হাসিনার আগে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়াও তো জোর করে ক্ষমতায় থাকার নানা রকম চেষ্টা করেছেন। পারেননি কেন? শেখ হাসিনা কী কেবল জবরদস্তি করেই ক্ষমতায় আছেন, নাকি তার পেছনে জনসমর্থনও আছে?
অমনি জবাব পাওয়া যাবে, রাখেন আপনার দালালি। মানুষের ভোটের অধিকার একবার ফিরিয়ে দিতে বলেন, দেখেন জনসমর্থন কোন দিকে!
আমি যদি বলি, ঠিক আছে, লুটপাট, দুর্নীতি শেখ হাসিনার আমলেও হচ্ছে। কিন্তু শুধু কি আওয়ামী লীগের চাটার দলেরই পেট ভরছে? মানুষ কি কোনো উপকার পায়নি, পাচ্ছে না? বিদ্যুৎখাতে দুর্নীতি আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট তো দূর হয়েছে। খালেদা শুধু খাম্বা দিয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। খালেদার আমলে কৃষক সার পায়নি, পানি পায়নি, গুলি পেয়েছে। হাসিনার সময় কি সার বা কৃষি উপকরণের সংকট হয়েছে?
ফেসবুক বিপ্লবী বলবেন, কথায় কথায় খালেদা জিয়ার সময়ের উদাহরণ টানা কেন? খালেদা খারাপ বলেই তো মানুষ হাসিনার ওপর আস্থা রেখেছিল। হাসিনা মানুষের আস্থার মর্যাদা রাখতে পারেননি।
আমি যদি বলি, আচ্ছা, শেখ হাসিনাকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে কাকে ক্ষমতায় আনা হবে?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাবো: মানুষ যাকে পছন্দ করবে, সেই ক্ষমতায় আসবে।
আচ্ছা, আমাদের ভোটের অভিজ্ঞতা কি বলে? মানুষ কি ভালো মানুষকে ভোট দেয়, নাকি দল এবং মার্কা দেখে ভোট দেয়? রাজনীতিতে ভালো মানুষ যারা ছিলেন, তারা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেন কেন? ভালো রাজনীতিকের প্রতি মানুষের সমর্থন থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো খারাপ মানুষকে কাছে টানার সাহস পেত কি?
রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতা। রাজনৈতিক দলের নীতি, কৌশল, কর্মসূচি প্রণীত হয় ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরির জন্যই। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো শুধু সেবাদান কোনো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। জনসেবার ব্রতের কথা একসময় রাজনীতিবিদের মুখে শোনা গেলেও এখন সময় পাল্টেছে। চিন্তার জগতেও এসেছে পরিবর্তন। এখন প্রতিযোগিতার সময়।
তারপরও এখনও কারো কারো নিজেকে ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’। কিন্তু ওটা মুখে, কাজে নয়!
যেকোনো পরিবর্তনের জন্য হুজুগ নয়, দরকার হয় সচেতন ও সংগঠিত জনশক্তির। এখন আমাদের অনেকেই ভাবুক হয়ে ভাবসাগরে হাবুডুবু খেতে ভালোবাসি। কিন্তু গায়ে-গতরে রোদ-মেঘ একটু মাখামাখি করুক তা চাই না। পাহাড় তুলে আছাড় মারার অবাস্তব কল্পনা নয়, এখন দরকার ভালোর পক্ষে একটি দল গড়ে তোলা। ‘এ’ এর বিকল্প ‘বি’- এই সনাতন চিন্তায় আটকে না থেকে ‘সি’ কিংবা ‘ডি’র পক্ষে সমবেত হওয়ার বাস্তব কাজে হাত দেওয়াই এখন জরুরি। সৎ ও সাহসী মানুষদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জড়তা নয়, দরকার তীব্র একটি ঝাঁকি। সেই ঝাঁকি কে দেবে, তারই এখন অপেক্ষা।