Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত-চীন বন্ধুত্ব কি ভেঙে গেল?


১১ জুলাই ২০২০ ১৪:৫৭

হিমালয় অঞ্চলভুক্ত গালওয়ান উপত্যকায় ২০ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যার পর ভারত-চীন বন্ধুত্বের কি মৃত্যু ঘটলো?

১৫ জুনের ওই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একমাস হতে চললো, সীমান্ত নিয়ে কোন সমোঝোতা হয়নি। চীন ১৫ জুনের পর যেমন এলাকা তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল, তা থেকে সরে আসেনি। অন্যদিকে ভারত ও চীন উভয় রাষ্ট্রই সীমান্তে সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে। একটি ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ ভাব। এমনি এক পরিস্থতিতে ‘যুদ্ধ’ হবে কি না, বলা মুশকিল। কিন্তু শীর্ষ সেনা কমান্ডারদের সাথে নিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিরোধপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন ও পরোক্ষভাবে চীনকে হুশিয়ারী দেওয়া প্রমাণ করে চীন-ভারত বন্ধুত্ব এখন তলানিতে অবস্থান করছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের বড় অর্থনীতির দুটো দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। দুটো দেশের একত্রিত জিডিপির পরিমাণ (পিপিপি) ৩৫ দশমিক ৬২৪ ট্রিলিয়ন ডলার (সাধারন হিসেবে ১৯.০৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার)।

বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর ৩ ভাগের ১ ভাগ এই দুই দেশে বসবাস করে (প্রায় ২৭২ কোটি মানুষ)। আগামী ৫০ বছর এই দুটো দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাবে। ফলে এই দুটো দেশ যদি একত্রিত থাকতে পারে, তাহলে যে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সারা বিশ্ব যখন চীন-ভারত সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখনই ঘটলো গালওয়ান উপত্যকায় হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা।

এখানে বলা ভালো চীন-ভারত বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক চীন সফরের মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে নেহেরুই ছিলেন প্রথম সরকার প্রধান, যিনি চীন সফর করেছিলেন। ওই সফরে বিখ্যাত ‘পঞ্চশীলা’ নীতি গ্রহন করেছিল দুই রাষ্ট্র, যে নীতিকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের রাজনীতির জন্ম হয়েছিল। তবে এটা ঠিক, ১৯৫৪ সালের এই সমঝোতা বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। ১৯৬২ সালে হিমালয় অঞ্চলেই ভারত ও চীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৭ সালে হিমালয় অঞ্চলভুক্ত দোকলামেও একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ হয়নি। চীনের কাছে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক। তিব্বত ও জিন জিয়াং প্রদেশ এই অঞ্চলেই অবস্থিত। তিব্বত চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর (১৯৫০-৫১) তিব্বতে চীন বিরোধী একধরনের অসন্তোষ বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

লাদাখের দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমাচল রাজ্য, আর এই রাজ্যের উপর চীন তার অধিকার এখনও দাবি করে আসছে। একই সাথে হিমাচল রাজ্যের ধর্মশালায় তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের একটি অস্তিত্ব রয়েছে। চীন জিন জিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে একটি সংকটে আছে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। তাই চীন কখনোই চাইবে না জিন জিয়াং এবং তিব্বত আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠুক। পশ্চিমা ইন্ধন এখানে রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে উইঘুর মুসলমান ও তিব্বত নিয়ে একটি আইন পাসও হয়েছে। ফলে এই সীমান্ত যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে চীন।

ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাবার সময় চীনের সাথে ভারতের সীমানা চিহ্নিত করে যায়নি। একধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় ছিল এই এলাকায়। এই গালওয়ান ভ্যালির একদিকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর, অন্যদিকে চীন নিয়ন্ত্রিত আফসাই চিন, যা কিনা ভারত তার নিজের এলাকা বলে দাবি করে। এর উত্তরে রয়েছে সিয়াচেন হিমবাহ, যেখানে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এই সিয়াচেন হিমবাহ ভূমি থেকে ৫ হাজার ৪০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, যার স্ট্রাটেমিক গুরুত্ব অনেক। সিয়াচেন হিমবাহের ৭০ কিলোমিটার এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল বালতিস্তানের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এই সিয়াচেন।

সিয়াচেন হিমবাহের পাশে অবস্থিত একটি সাকসাম ভ্যালি পাকিস্তান চুক্তি করে চীনকে দিয়ে দিয়েছিল। ১৫ জুন গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষ হলেও, এই অঞ্চলের (পশ্চিম অংশ) অর্থাৎ লাদাখ ও আকসাই চীনের কর্তৃত্ব নিয়ে ১৯৬২ সালে ভারত ও চীন বহুল আলোচিত যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালেও সংঘর্ষ হয়েছে সিকিমের নাথু লা ও চো লা গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৯৯ সালে কারগিল (লাদাখ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত) যুদ্ধের কথা আমরা জানি। আর ২০১৭ সালে ডোকলামে ভারত-চীন একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা জানান দিলেও, শেষ পর্যন্ত তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর অর্থ হচ্ছে হিমালয় অঞ্চলে যুদ্ধ আর সংঘর্ষের খবর অনেক পুরনো। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক ধরনের বন্ধুত্ব নিয়ে এগিয়ে গেছে। মোদির জামানায় দুই দেশের সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছিল। অনেকের স্বরণ থাকার কথা চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিন পিং তার প্রথম ভারত সফরে প্রথম অবতরন করেছিলেন গুজরাটে।

সম্প্রতি চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উহান স্পিরিট’কে অন্যতম অগ্রগতি হিসেবে ধরা হয়। ২০১৮ সালের ২৭-২৮ এপ্রিল মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ব্রিফিং-এ তখন বলা হয়েছিল, দুই শীর্ষ নেতার অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুধু এ অঞ্চলের নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির উন্নয়ন ও বিকাশেও বড় ভূমিকা রাখবে।

ব্রিফিংয়ে আরও বলা হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে এই সম্পর্ক একটি শক্তিশালী ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ গঠনে বড় অবদান রাখবে।

এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের উপরও গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই দুই নেতা (ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোট, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮)।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই দুই নেতার অনানুষ্ঠানিক বৈঠককে ‘উহান স্পিরিট’ হিসেবে আখ্যায়তি করেছিলেন। এর রেশ ধরে পরবর্তী অনানুষ্ঠানিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রাচীন শহর সমুদ্রঘেষা মামাল্লাপুরামে ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর। পরপর দুটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের পর তৃতীয় আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা চলতি বছরের শেষের দিকে। কিন্তু গত ১৫ জুন হিমালয় অঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সংঘর্ষ ও তাতে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর সংগত কারনেই যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে ‘উহান স্পিরিট’ কি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে চলেছে?

চীন ও ভারত উভয় দেশই গালওয়ান উপত্যকা নিজেদের বলে দাবি করে। এটি ভারতের লাদাল অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তবে এই অঞ্চলটির স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। এক সময় লাদাল ছিল ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ভারত সরকার এই অঞ্চলের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৯ সালে সব ধরনের আপত্তি উপেক্ষা করে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন এনে লাদালকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হলেও পাকিস্তান ও চীন উভয় দেশই এতে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। পাকিস্তান বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে। আর চীন তাতে সমর্থন দেয়।

মূলত তখন থেকেই চীনের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চীনের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ ছিল চীন ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলাচ্ছে। চীন-পাকিস্তান অ্যালায়েন্স ও চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরকে ভারত দেখছে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এসব ঘটনায় চীনের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটলো গালওয়ান উপত্যকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

উহান ও মামাল্লাপুরামে চীন ও ভারত পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস আর উন্নয়নের কথা বলেছিল কিন্তু গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের সাথে তা মেলানো যায় না। দু’পক্ষই সেখানে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলার চেষ্টা করছেন, ভারত ও চীন যদি একসাথে কাজ করতে পারে, তাহলে বিশ্বকে তারা বদলে দিতে পারবে। এজন্যই একসময় Chindia এর ধারণা প্রমোট করা হয়েছিল। চীন ও ভারত মিলেই Chindia (চিন্ডিয়া)। এখন এই ধারণার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। যুদ্ধ এ অঞ্চলে কোন শান্তি বয়ে আনবে না। বরং পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে ‘উহান স্পিরিট’কে সামনে রেখে গালওয়ান উপত্যকার সমস্যার সমাধান করতে হবে।

উহান স্পিরিট গালওয়ান উপত্যকা তারেক শামসুর রেহমান ভারত-চীন দ্বদ্ব ভারত-চীন বন্ধুত্ব ভারত-চীন সম্পর্ক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর