নগদ পৌঁছানো ও প্রচুর অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই
১২ জুলাই ২০২০ ১৮:২৯
গত ডিসেম্বরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে পুরো উহান শহরকে চীন লকডাউন করে। ওই লকডাউন চলেছিল একমাসের বেশি সময় ধরে। লকডাউন করে চীন সাফল্য পেয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই তারা করোনা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। পুরো চীনে করোনাভাইরাস ছড়ায়নি। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে সারা পৃথিবী। শিক্ষাটি সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, কেরালা, শ্রীলংকা, নেপাল, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি। বলা যায় তারা করোনাকে আঁতুর ঘরেই মেরে এক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে।
ইউরোপ দেরীতে এবং কিছুটা ঢিলেঢালাভাবে হলেও শিক্ষাটা কাজে লাগিয়েছে; করোনা নিয়ন্ত্রণ করে একে একে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করেছে। চীনের শিক্ষাটা একেবারেই কাজে লাগায়নি আমেরিকা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, রাশিয়া, তুর্কী, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি। এসব দেশের মাথায় অর্থনীতি বাঁচানোর ভুত চেপে বসলো। এরা জীবন বনাম জীবিকার ভিত্তিহীন ধুঁয়া তুলল। জীবনের বিপরীতে জীবিকাকে দাঁড় করানো যায় না। এই করোনাকালে জীবন আর জীবিকার সমন্বয়ের কথা বলা অত্যন্ত অমানবিক, বর্বর। ফল যা হবার তাই হয়েছে। না পরেছে অর্থনীতি বাঁচাতে, না মানুষ। প্রকৃতিগত কারণে ভারত আর বাংলাদেশসহ তুলনামূলক কম মানুষের জীবনের উপর দিয়ে রক্ষা পাচ্ছে উপমহাদেশ।
সময়ের আগে লকডাউন তুলে দিয়ে বড় ধরণের ভুল করেছে বাংলাদেশ। এখন ভুলের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই মুনাফা করতে পারছে না। সরকারের টাকার লেনদেন করে, সরকারকে বিগত বছরের দ্বিগুণ ঋণ দিয়ে ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছে ব্যাংকিং ব্যবসা। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সে সুযোগ হয়নি। সেই এপ্রিল মাস থেকে খোলা রেখেও তারা কমবেশি ৫০ শতাংশের মত ব্যবসায়ীক কার্যক্রম চালাতে পারছে। কেউ কেউ ২০ থেকে৩০ শতাংশ বিক্রি করতে পারছে।
এপ্রিল মাস থেকে ব্যবসা বাঁচাতে লকডাউন তুলে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এপ্রিলের প্রথম দিকে লকডাউন যতটা কড়াকড়ি ছিল তা মে মাস পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে এখানের চিত্র থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার মত হতো। করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে আসতো। জুন মাস থেকে নির্ভয়ে সকলে বাইরে বেরিয়ে অর্থনীতি সচল করে তুলতো। জুন গেছে, জুলাইও যাচ্ছে। বর্তমানের মতো করোনা ব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরও যাবে। সকলে ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত করোনার দংশন বন্ধ হবে না। মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। অর্থনীতি সচল হবে না।
কর্তাদের বোঝা উচিৎ ছিল যে দোকানপাট, কারখানা খুলে দিলেই তাতে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে না। আর্থিক ক্ষতির ভয় থেকে অনেক বড় ভয় জীবনের, শারীরিক কষ্টের। যারা সচ্ছল তারা জীবনের, স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নেয় না। পেটের দায় থাকলে নেয়। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে যত সম্পদ আছে মোটামুটি তার ৮০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ২০ ভাগ মানুষের হাতে। এই মানুষেরা ঘরে থাকে। তারা নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কিছু কেনে না। এটা মহামারির সময়, যুদ্ধের সময় হয়ে থাকে। সচ্ছল মানুষ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে না, ঘরবাড়ি বানায় না, দেশ-বিদেশে বেড়াতে যায় না, রেস্টুরেন্টে গিয়ে আড্ডা মারে না, বিয়ে-শাদী, আকিকা বন্ধ করে রেখেছে, এমনকি আত্মীয়স্বজন অসুস্থ হলে ফুলফল নিয়ে দেখতে যায় না। সচ্ছল মানুষেরা এসব কাজ না করলে বাজারে টাকা আসবে কোথা থেকে? টাকার চলাচল না হলে অর্থনীতি চলবে কী করে? এসব অর্থনৈতিক চিন্তা একেবারে প্রাথমিক স্তরের। এসব বুঝতে বড় কোন ডিগ্রি লাগে না। ২০ শতাংশ সম্পদ নিয়ে ৮০ ভাগ মানুষ রাস্তায়, বাসস্ট্যান্ডে, রেল স্টেশনে, কাঁচাবাজারে যত ভিড় করুক না কেন তাতে সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না। ৮.২৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না। তাই বলে একথা যেন ভুলে না যাই – খেঁটে খাওয়া মানুষেরাই খাবার-দাবার উৎপাদন করে, সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে ৫০ শতাংশ অর্থনীতি।
সচ্ছল মানুষদের ঘর নেওয়ায় সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষেরা। তাদের কাজ নেই সরকার থেকে কোনো সহায়তা নেই। সামান্য কিছু জমানো টাকা দিয়ে, ধারদেনা করে কোনো মতে বিগত দিনগুলো কাটিয়েছে– আর চলে না। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক বড় বড় প্রণোদনা ঘোষণা করলেও তা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে পৌঁছায়নি, পৌঁছানো যায়নি। তারা এখন দলে দলে ঢাকা ছাড়ছে। ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় এখন দেখা যাচ্ছে ঘর ছেড়ে বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে যাওয়া পরিবারগুলোর ঢল। নিম্ন আয়ের মানুষেরা যেসব এলাকায় থাকে সেসব এলাকায় এই চিত্র বেশি স্পষ্ট। বাড়িতে বাড়িতে টু-লেট সাইনবোর্ডের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার উচ্চ ব্যয় বহন করতে পারছে না চাকরি হারানো কর্মহীন মানুষেরা। তারা এখন ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ গ্রামে।
শিল্পখাত থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু মানুষ কর্মহীন হয়েছে। সেবা খাত থেকে কর্মহীন হয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষ। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ৮৭ শতাংশ বা প্রায় ৬ কোটি মানুষ। এদের বেশিরভাগই সেবা খাতে নিযুক্ত এবং করোনাকালে কর্মচ্যুত। এদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রবাসীরা। শিল্প উৎপাদন এখন ৫০ শতাংশের কম। ৫০ শতাংশ পণ্য উৎপাদন করতে ৫০ শতাংশ কর্মীর প্রয়োজন। অর্থাৎ পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে শুধু শিল্প খাত থেকে ৭৫ লাখ মানুষ কর্মচ্যুত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কোন খাত থেকে কত জন কর্মি এখন পর্যন্ত কর্মচ্যুত হয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর সরকারের কাছে আছে বলে মনে করিনা। করোনাকালে পরিসংখ্যান ব্যুরো এমন কোন জরিপ করেছে বা বিশ্লেষণমূলক তথ্য দিয়েছে বলে শুনিনি বা সংবাদ মাধ্যমে দেখিনি। দেশে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের খুব অভাব। দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ ইতিমধ্যে কর্মহীন হয়েছে বলে ধারণা করি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানের চেয়ে খারাপ হলে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।
গ্রামীণ অর্থনীতি এত শক্তিশালী নয় যে তা শহর থেকে ফেরত যাওয়া মানুষদের কাজ দিয়ে, খাইয়ে, পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। আমাদের কৃষি জাতীয় অর্থনীতির মাত্র ১৩ শতাংশ যোগান দেয়। কর্মসংস্থান করে ৩৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৭০ কোটি মানুষের। করোনাকালে কৃষি চালু আছে পুরোপুরি। কৃষি খাতের জন্য দেওয়া ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা এখনো বেশিরভাগ অব্যবহৃত। অর্থাৎ তা কৃষকের হাতে পৌঁছায়নি। আমাদের আমলাতন্ত্র তা কৃষকের হাতে পৌঁছাতে পারেনি। এ টাকা পৌঁছানো গেলে কৃষিখাতে আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই বলে শহর থেকে ফেরত যাওয়া সকলের কর্মসংস্থান করা কৃষির পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রামে বাড়তি মানুষ সামাজিক চাপ সৃষ্টি করবে। ঘরে ঘরে অশান্তি ও মানসিক সমস্যা দেখা দেবে, পারিবারিক ও সামাজিক সন্ত্রাস বাড়বে। সামাজিক ও রাজনৈতিক নৈরাজ্য বৃদ্ধি পাবে। এসব মোকাবিলা করতে হবে।
কর্মহীন মানুষদের সামাজিক শৃঙ্খলায় রাখতে হলে তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে যুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য দরকার প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। মানুষের কাছে এমন কোন যাদু নেই যা দিয়ে দেড়-দুই কোটি মানুষের জন্য রাতারাতি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। বেশ কয়েকজন বন্ধু আমার কাছে রাতারাতি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কী উপায় আছে তা জানতে চেয়ে ফোন করেছেন। তাদের প্রশ্নের আমি কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। পারব কী করে? আমাদের কারো হাতে কোন যাদু নেই। এখন একটা যাদু দরকার। কারো কাছে এখন পর্যন্ত যাদুটা নেই বলে কেউ তা উদ্ভাবন করতে পারবে না – তা নয়। যেকোনো সময় যে কেউ নতুন একটা যাদু নিয়ে আসতে পারে। মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রতি আমার অগাধ আস্থা। করোনা দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার জন্য মে মাসের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক রিপোর্টার্স ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক লেখায় আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ কিভাবে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে পারে তার উপায় বাতলে দিয়েছিলাম।
অর্থনীতির নিম্ন পরিক্রমায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পথ বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার সময়ে জন মেনার্ড কেইনস যেটা দেখিয়েছেন তার থেকে বেশি কিছু এখনও মানুষের মাথায় ধরেনি। ত্রিশের দশকের মহামন্দা কাটাতে কেইনসের প্রেসক্রিপশন দারুণ সফল হয়েছে। কেইনস বলেছেন, মন্দার সময় অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে রাষ্ট্রের বেশি বেশি খরচ করা দরকার। সে মোতাবেক বর্তমান লেখকসহ বেশ কয়েকজন বড় বড় দেশের জন্য, গরীবের জন্য ভাবেন এমন অর্থনীতিবিদ নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। আমার পরামর্শ ছিল নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষদের চিহ্নিত করে তাদের হাতে পরিবার প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা মোবাইল একাউন্টের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া। কয়েকজন মাস প্রতি আরও বেশি অর্থ দিতে বলেছেন। রোজার ঈদের আগে সরকার ৫০ লাখ পরিবারের কাছে মাত্র একবার ২,৫০০ টাকা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেও প্রশাসনের দুর্নীতি আর অদক্ষতার কারণে কাজটা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। ১২ জুলাই তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এ উদ্যোগ জালিয়াতি আর অনিয়মে ভরা। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭ লাখ পরিবারের কাছে এ টাকা পৌঁছেছে।
নিম্ন আয়ের কর্মহীন দেড় কোটি পরিবারকে মাসে ৫ হাজার করে টাকা পৌঁছাতে হলে মাসে দরকার ৭,৫০০ কোটি টাকা। এই টাকা ঠিকমত পৌঁছাতে হবে। এর সঙ্গে দরকার প্রচুর অবকাঠামো উন্নয়নমূলক কাজ। উন্নয়নমূলক সেসব কাজই এখন করত্রে হবে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সবচেয়ে বেশি। অন্য আর কোনো কার্যকর উপায় নেই। মানুষের হাতে টাকা থাকলে একে ওপরের মালপত্র কিনবে; অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে। অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর ভি-শেপ পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে; অন্যথায় ইউ বা এল শেপ। ইউ বা এল শেপ পুনরুদ্ধার মানে হচ্ছে আরও অনেক যন্ত্রণা, অনেক দারিদ্র্য। দারিদ্র্য বেড়ে চলছে। মানুষ বাঁচাতে হবে। করোনা কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে কেউ জানে না। পরিস্থিতি আরও যে খারাপ হবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষদের নগদ সহায়তা দিতে হবে সকলের স্বার্থে। প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করতে হবে সকলের স্বার্থে।
প্রয়োজন হলে টাকা ছাপিয়ে যতদিন পর্যন্ত অর্থনীতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এ দুটো কাজ ঠিকভাবে করতে না পারলে বিগত দশ-এগারো বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে অসম্ভব গতিতে বেড়ে চলছিল তা শুধু থেমেই যাবে না; দেশকে ২০০৯ সালের পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরিয়ে নেবে।
লেখক: লিড কনসালটেন্ট, ঢাকা কনসালটিং লিমিটেড