একুয়ামিমিক্রি; বাংলাদেশের চিংড়ি চাষের এক নতুন সম্ভাবনা
১৪ জুলাই ২০২০ ১৬:৫৯
একুয়ামিমিক্রি কী?
একুয়ামিমিক্রি চিংড়ি চাষের এক অসাধারণ পদ্ধতি যা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের জুন মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খামারিদের মাধ্যমে। একুয়া মানে পানি আর মিমিক মানে নকল করা। একুয়ামিমিক্রি পদ্ধতিতে চিংড়ি জলীয় পরিবেশে যেভাবে বেড়ে উঠে, তারই অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়। এই পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো, পুকুর বা ঘেরে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে পাচনকৃত চালের বা গমের কুড়া ও ভুষির প্রয়োগে কপিপড এবং জুপ্লাংটন উৎপাদন, যা চিংড়ি খাবার হিসেবে গ্রহণ করে এবং পানিতে সবসময় কার্বন ও নাইট্রোজেন চক্রের সুষম ব্যবস্থাপনা।
একুয়ামিমিক্রিতে চিংড়ির নিবিড় চাষ করা যায় এবং কোন ঔষধ বা ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার না করেই চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা যায়।
একুয়ামিমিক্রির মূলনীতি:
জলজ প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো পুকুরে কপিপড ও জুপ্লাংটন উৎপাদন বাড়িয়ে এবং পানির ভৌত-রাসায়নিক প্যারামিটারগুলো চিংড়ির জন্যে সহনীয় পর্যায়ে রেখে একুয়ামিমিক্রি পদ্ধতি কার্যকর করা হয়। এই চাষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিগুলো হলো-
১. চাষের পুকুরে টয়লেট বানানো: চিংড়ির প্রতিদিনের বর্জ্য জমা এবং নিষ্কাশনের জন্য পুকুরের মাঝামাঝি টয়লেট বানানো এবং তার থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চিত্র ১: পুকুরের মাঝে চিংড়ির টয়লেট
২. প্যাডেল হুইল/এরেটর/এয়ার ব্লোয়ার ব্যবহার: সার্বক্ষণিক প্যাডেল হুইল/এরেটর/এয়ার ব্লোয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে পানি আন্দোলিত করে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা অনুকূল পর্যায়ে (৫-১০ পিপিএস) রাখতে হবে। এতে অধিক ঘনত্বে চিংড়ি পোনা (পোস্ট লার্ভা বা পি এল) মজুদ এবং কপিপড উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।
৩. পাচনকৃত (Fermented) চালের বা গমের কুড়া বা ভুষি প্রয়োগ: পিএল মজুদের আগে ও পরে পাচনকৃত চালের বা গমের কুড়া বা ভুষি নিয়মিত প্রয়োগের মাধ্যমে কপিপডের ঘনত্ব ২০-৪০ সেমি এর মধ্যে রাখতে হবে।
এই তিনটি মূলনীতি, বায়োফ্লক টেকনোলজি, তরল কাদা (Sludge) অপসারণ, উচ্চমাত্রায় কপিপড উৎপাদন এবং খুবই কম পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ির অধিক উৎপাদন করা হয় একুয়ামিমিক্রি পদ্ধতিতে। এতে পানির পি এইচ এর মাত্রা ৭.৬-৭.৯ থাকে এবং অক্সিজেনের মাত্রা ৫-১০ পিপিএম থাকে। পানির পিএইচ এর পরিবর্তনের মাত্রা ০.৩ এর বেশি হয় না বলে চিংড়ির দ্রুত বেড়ে উঠা নিশ্চিত হয়।
চিত্র ২: পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য
চিংড়ির পুকুর প্রস্তুতি:
১. পুকুরের কাদা অপসারণ: পুকুরের তলার কাদা যতটুকু সম্ভব অপসারণ করতে হবে। কাদা অপসারণের পরে তলার মাটির ২০-২৫ সেমি নিচের মাটির পিএইচ নির্ধারণ করে নিতে হবে। মাটির পিএইচ খুব কম (৪-৫.৯) হলে অতিরিক্ত জৈব বর্জ্যের উপস্থিতি প্রমাণ করে। এক্ষেত্রে মাটির নাইট্রোজেনের (এমোনিয়া, নাইট্রাইট, নাইট্রেট) পরিমাণ পরিমাপ করে নিতে হবে।
২. পাড় মেরামত: পুকুরের গভীরতা ১.৫ মিটার হওয়া উচিৎ। পুকুরের পাড় মেরামত করে এইচডিপিই লাইনার দিয়ে পাড় মুড়িয়ে নিতে পারলে পাড় ভাঙবে না এবং কাঁকড়া বা কুচিয়া পাড়ে গর্ত করতে পারবে না।
৩. পুকুরে টয়লেট খনন: পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় চিংড়ির টয়লেট নির্মাণ করতে হবে। পুকুরের মাঝ বরাবর ১৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকৃতির গর্ত (৬.৫ মিটার ব্যাসার্ধ) তৈরি করতে হবে। এই গর্তের স্লোপের দৈর্ঘ্য হবে ৬.৪ মিটার আর গভীরতা হবে ২.৫ মিটার। ২.৫ মিটারের নিচে মাঝ বরাবর একটা স্লাজ ট্যাংক বসাতে হবে, যার গভীরতা হবে ১.৫ মিটার আর প্রস্থ হবে ১.৬ মিটার। এটি পুকুরে চিংড়ির টয়লেট হিসেবে কাজ করবে এবং এটি এইচ ডি পি ই প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। স্লাজ ট্যাংকের নিচে একটি ১ হর্স পাওয়ারের সাবমারসিবল পাম্প বসাতে হবে যার মাধ্যমে প্রতিদিন দুই বেলা করে (সকাল ও সন্ধ্যা) টয়লেটের তলায় জমা হওয়া তরল জৈব পদার্থ (মল-মূত্র, মরা প্রাণী-উদ্ভিদ, খাদ্যের অতিরিক্ত অংশ) অপসারণ করতে হবে।
চিত্র ৩: পুকুরের চিংড়ির টয়লেট খনন
পুকুরের পানি প্রস্তুতি:
- কোন অবস্থাতেই পুকুরের পানি বা তলায় বিষাক্ত রাসায়নিক বা জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
- ১০০-২০০ মাইক্রন ব্যাসের ছিদ্রযুক্ত ব্যগের মাধ্যমে পানি ঢুকাতে হবে।
- ১ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পানি ঢুকাতে হবে।
- প্রতি একরে ৪০-৭০ কেজি চায়ের বীজের কেক (Tea Seed Cake) প্রয়োগ করতে হবে।
মাটির পিএইচ এর মান উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত হারে প্রোবায়োটিক রেড ক্যাপ দিতে হবে:
মাটির পিএইচ এর মান – রেড ক্যাপের পরিমাণ
- ৬.০-৭.০ – ৪ বোতল
- ৫.০-৫.৯ – ৮ বোতল
- ৪.০-৪.৯ – ১২ বোতল
- চিত্র ৪: এরেটরসহ প্রস্তুতকৃত পুকুর
চেইন ড্র্যাগিং ও প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন:
রেড ক্যাপ দেওয়ার পরে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সমস্ত পুকুরে লোহার চেইনের তৈরি হররা টানতে হবে। এসময় পানিতে এরেশন করলে ফলাফল আরও ভালো হবে।
- একুয়ামিমিক্রি সিমবায়োটিকের মাধ্যমে (৪-৭) দিন পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য ২৪৩-৩২৪ কেজি (১০০ পিপিএস) অটো চালের কুড়া (তুষ এবং খুদমুক্ত) এবং ১ বোতল হোয়াইট ক্যাপ (প্রোবায়োটিক) প্রতি কেজি কুড়ার জন্য ৫-১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৪৮ ঘণ্টা ফারমেন্টেশন করতে হবে। এর প্রয়োগে পুকুরে রটিফার, কপিপড ও রেড ওয়ার্ম এর উৎপাদন বেশি হবে।
- ফারমেন্টেশনের সময় এরেশন দিতে পারলে প্রারম্ভিক সময়ে প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে কপিপডের উৎপাদন বেশি হবে।
- প্রতিদিন ২-৪ ঘণ্টা চেইন ড্র্যাগিং করলে পুকুরের তলায় বায়োফিল্ম কম তৈরি হবে। চেইনের ওজন কমপক্ষে ৩০ কেজি হলে ভালো হয়।
চিত্র ৫: চেইন ড্র্যাগিং মেশিন ও পুকুরে চেইন ড্র্যাগিং
পিএল মজুদ পূর্ব প্রস্তুতি:
মজুদ পূর্ব সময়ে পানির গভীরতা ১ মিটার আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
- ৩২-৪০ কেজি তরল পাচনকৃত (ফারমেন্টেড) চালের তুষ (ব্রান) পুকুরে প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে (৭-১৪ দিন) যাতে প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতি ২৫-৪০ সেমি হয়। এটা সেক্কিডিক্সের মাধ্যমে মেপে নেয়া যায়।
- প্রতিদিন প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে বিশেষ করে রটিফার, কপিপড, ডায়াটোম ও ব্লাড ওয়ার্ম।
- এরেশন চালিয়ে যেতে হবে এবং পিএল মজুদের পূর্বে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ পিপিএম এর বেশি থাকবে।
- পিএইচ এর মান ৭.৬-৮.০ এর মাঝে থাকতে হবে, তবে ৭.৬-৭.৮ এর মধ্যে থাকলে ভালো।
- চেইন ড্র্যাগিং চালিয়ে যেতে হবে।
পিএল মজুদ:
- পিসিআর টেস্ট এর মাধ্যমে ভাইরাসমুক্ত এসপিএফ বা কোন ভালো চিংড়ি হ্যাচারির ১২-১৫ দিন বয়সী পিএল নির্বাচন করতে হবে।
- প্রতি বর্গমিটারে ১২-২৫ টি পিএল বা প্রতি শতাংশে ৪৮০-১০০০ টি সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত পিএল নির্বাচন করতে হবে।
- মজুদের পূর্বে কমপক্ষে ৩০ মিনিট স্ট্রেস টেস্ট (পিএইচ ও লবনাক্ততা) করতে হবে।
- এন্টিবায়োটিকমুক্ত পোনা মজুদ করতে হবে।
- পানির পিএইচ, তাপমাত্রা, লবনাক্ততার সাথে কমপক্ষে ৩০ মিনিট খাপ খাওয়াতে হবে।
চাষকালীন ব্যবস্থাপনা:
চিত্র ৬: বিভিন্ন ধরণের প্রোবায়োটিক
- প্রতিদিন ১-৫ পিপিএম হারে পাচনকৃত তরল চালের কুড়া প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের কপিপড বা বায়োফ্লকের উৎপাদনের ঘনত্বের উপর নির্ভর করে চালের কুড়ার পরিমাণ ঠিক করা হয়। বায়োফ্লকের সবচেয়ে ভালো মাত্রা হলো ২০-৩০ সেমি।
- ভালো মানের কোন এর মাধ্যমে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে বায়োফ্লকের ঘনত্ব পরিমাপ করতে হবে।
- পানির পিএইচ পরিবর্তনের লগ যেন ০.২-০.৩ লগ হয় সেটা লক্ষ রাখতে হবে পুরো চাষকালীন সময়ে।
- দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা দিন-রাতের কোন সময় ৫ পিপিএম এর নিচে থাকা যাবে না। দিনে যাতে ১০ পিপিএম এর বেশি না উঠে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
- প্রতি সপ্তাহে প্রতি একরে ১০-২০ গ্রাম গ্রিন ক্যাপ প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে যাতে দ্রবীভূত কঠিন কণা উৎপাদন কম হয়।
- প্রতি সপ্তাহে প্রতি একরে ১০-২০ গ্রাম ইয়েলো ক্যাপ প্রোবায়োটিক পাচনকৃত চালের কুড়ার সাথে দিতে হবে যাতে অভুক্ত খাবার পচিয়ে কপিপড উৎপাদন করতে পারে।
- যদি অক্সিজেনের অভাব দেখা যায়, তাহলে পাচনকৃত তরল চালের কুড়া প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে এবং খাবার কম দিতে হবে। এছাড়া প্রতি একরে ১০-২০ গ্রাম গ্রিন ক্যাপ প্রোবায়োটিক এরেটর চালিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- পুকুরের মাঝখানে চেইন বা হররা টানা যাবে না।
সম্ভাব্য সমস্যা ও সমাধান:
চাষকালীন সময়ে পিএইচ এর সমতা রাখা
- প্রতি একরে ৩ পিপিএম হারে মোট ১২ কেজি অটো চালের কুড়া পানির পিএইচ এর মাত্রা অনুকূল অবস্থায় না আসা পর্যন্ত প্রিবায়োটিক হিসেবে দিতে হবে।
- ৪৮-৬০ লিটার পানিতে ৭.২ কেজি সোডিয়াম বাইকার্বনেট এবং প্রতি কেজি কুড়ার জন্য ১.৬ গ্রাম রেড ক্যাপ ২৪ ঘণ্টা ফারমেন্টেড করে প্রয়োগ করতে হবে।
চাষের সময় সবুজ পানি কমানো:
- ৫ পিপিএম হারে সিনবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত পানির পিএইচ এর মাত্রা ৭.৬-৭.৮ এর মাঝে না আসে।
- ৮০-১০০ লিটার পুকুরের পানিতে ২০ কেজি চালের কুড়া, ৪ কেজি সোডিয়াম বাইকার্বনেট ও প্রতি কেজি কুড়ার জন্য ১.৬ গ্রাম রেড ক্যাপ ২৪ ঘণ্টা ফারমেন্টেড করে প্রয়োগ করতে হবে।
সতর্কতা:
- পানির গভীরতা প্রথম ৩০ দিন ১ মিটার এবং পরে চিংড়ি বড় হলে ১.৫ মিটার রাখতে হবে।
- পুকুরের চারদিক এবং পাড় সবসময় এলজি/শ্যাওলা মুক্ত রাখতে হবে।
ফলাফল:
স্থান: শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা
পুকুরের আকৃতি: ১০০০ ডেসিমেল
মজুদের মোট সময়: ১৫০ দিন
পোনার পরিমাণ: ৯২,০০০
প্রতি বর্গমিটারে পোনার সংখ্যা: ২৩
ফলনের আকার: ২২.৫টি প্রতি কেজিতে
মোট ফলনের সংখ্যা: ৬৬,০০০
গড় ওজন: ৪৪.৪৪ গ্রাম
পোনা বেচে থাকার পরিমাণ: ৭১.৭৪%
মোট ব্যবহৃত খাবার: ৫,০৮০ কেজি
মোট ফলন: ৩,০০০ কেজি
এফসিআর: ১ ঃ ১.৬৯
প্রতি হেক্টরে উৎপাদন: ৭,৪১০ কেজি