মন্দার শঙ্কায় প্রতারণার সাহেদনামা
১৮ জুলাই ২০২০ ১৪:২৩
পাড়াগাঁয়ে একটি প্রচলিত গল্প আছে, পাশের গ্রাম থেকে এক মুমূর্ষু রোগীকে দেখে ফিরছেন একজন। সবুজ ধানক্ষেতের আল ধরে মন খারাপ করে হেঁটে চলছেন তিনি। তার মন খারাপের কারণ, যাকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি মারা গেছেন। তাই বেদনার শোক নিয়ে ফিরে আসা। সে পথেই ওই একই রোগীকে দেখতে যাচ্ছিলেন অন্য একজন। মাঝপথে দুজনের দেখা। লোকটিকে মন খারাপ করে ফিরতে দেখে তার কাছেই জানতে চাইলেন অসুস্থ মানুষটির খোঁজ। প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন, অসুস্থ লোকটি ইন্তেকাল করেছেন। শুনে প্রথমে কিছুটা চুপচাপ থাকলেন অনেকটা সাদাসিধে, মূর্খ ও কম জানা গেঁয়ো লোকটি। তারপর বললেন, গতকাল শুনেছিলাম তার অবস্থা খুব সিরিয়াস আর আজ আপনি বলছেন ইন্তেকালের কথা। আহা, সিরিয়াসের মধ্যে যদি ইন্তেকাল করে তাহলে কি আর লোকটা বাঁচবে?
এমন গল্পের একটা সারবেত্তা হচ্ছে নিদারুণ বেদনা আর শোকের করুন সংবাদের মধ্যে নিতান্ত বোকার মতো বক্তব্যের জন্য এক ধরনের হাসির উদ্রেক হওয়া। বেদনাক্রান্ত সময়ে কারো বোকামির জন্য হাসির পরিস্থিতি তৈরি হলে তা সত্যিই ব্রিবতকর ভিন্ন কিছু নয়। করোনার হিংস্র নখরে যখন ছিন্নভিন্ন গোটা বিশ্ব এবং সেই সাথে বাংলাদেশও। যখন চোখের জল, প্রিয় মানুষের কান্না আর মানুষে মানুষে মৃত্যু ভীতিতে কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেছে পরিচিত চারপাশ। তখনও এখানে যেন হাসির অভাব নেই।
এই যেমন একজন সাহেদ। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান। একের পর এক হাসির খোরাক যোগাচ্ছেন। তার হাসপাতালের সাথে সরকারের একটি চুক্তির বিষয় নিয়ে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে দোষারোপের রশি টানাটানি প্রতিদিন কালো হরফে ছাপা হচ্ছে পত্রিকার পাতায় কিংবা পর্দার প্রতিবেদনে। ইনি বলছেন তিনি জানেন। আবার তিনি বলছেন ইনি জানেন। কেউ বলছেন উনার আমন্ত্রণে তিনি গিয়েছেন। আবার উনি বলছেন উনাদের অনুমতি ছাড়া তিনি কিছু করতেই পারেন না।
এছাড়াও একজন নারী চিকিৎসক সাবরিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ টিভির পর্দা কাঁপিয়ে তুলেছে। করোনার আক্রমণে পুরো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যখন সিরিয়াস অবস্থার মধ্যে পড়েছে তখন সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা রোগীদের ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে রোগীদের সাথে প্রতারনার অভিযোগ যেন বিবেকের ইন্তেকালেরই নামান্তর। করোনার কালো বিষে যখন দেশের জনগণের মাথাভর্তি মৃত্যু চিন্তা আর অনাগত দিনের মন্দার ডামাডোল। তখন করোনা চিকিৎসা নিয়ে সাহেদ, সাবরিনাদের এসব জালিয়াতি ও ছেলেমানুষিপনা আর কর্তাব্যক্তিদের এ বিষয়ে না জানার দায় এবং একে অন্যের ঠেলাঠেলিগুলো চিরদর্শক সারিতে থাকা জনগণের মনে কিছুটা হাসিরই যোগান দেয়।
সবকিছুই যেন এই করোনার কিংকর্তব্যবিমূঢ় সময়গুলোতে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। চিন্তার ভেতরে কেবলই জন্ম দিচ্ছে অবিশ্বাসের অজস্র ডালপালা। চিকিৎসা যেখানে মানুষের সুস্থতা কিংবা জন্ম-মৃত্যুর বিষয়, তখন তা নিয়ে এমন প্রতারনার সাপ যখন বেরিয়ে পড়ছে সাধারণ আর নিরীহ মানুষের চিন্তায় জন্ম নিচ্ছে অগুনতি প্রশ্নমালা। কোথায় হবে সুচিকিৎসা? তাইতো শঙ্কার আর ভয়ের ঘরে কেবলই যোগ হয় অসহায়ত্ব।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশের চিকিৎসা খাতে যখন এমন রঙ্গচিত্র ততক্ষণে করোনার নীল বিষ দেশের অর্থনীতিতে মন্দার ঢেউ ছুঁয়ে দিয়েছে। মন্দার কারণে শিল্প-ব্যবসা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠানই অনেকটাই আর্থিক সমস্যার কবলে নিপতিত। অনাহুত এই মন্দা মোকাবেলায় অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন করার কথা ভাবছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী ছাঁটাই, বেতন ভাতা কমানো এবং নতুন নিয়োগের দুয়ার বন্ধের চিন্তা করছেন। তবে এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন সরকারী চাকরিজীবীরা। ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে কেউ যে একাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কিন্তু নয়। এর পুরো প্রভাবটাই পড়বে রাষ্ট্রের পুরো ব্যবস্থার ওপর।
কারণ চাকরি না থাকলে কিংবা আয় কমে গেলে সেসব মানুষ তার পারিবারিক জীবনেও ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করবেন। অর্থাৎ তিনি কাপড় কিনবেন কম, বুয়াকে বিদায় করে দিবেন, মোবাইলে কথা বলবেন কম, কমিয়ে দেবেন জমিজমা কিংবা ইলেকট্রনিক্স পন্যসহ বিলাসী পণ্য কেনা, কমে যাবে তাদের বেড়াতে যাওয়া। এতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নিজের পারিবারিক সকল ক্ষেত্রের ব্যয়ই কমিয়ে আনবেন তারা, কারণ তাদের আয় কমেছে অনেক। ফলে পোশাক, আবাসন, ইলেকট্রনিক্স, জমি; সব খাতেই কমে যাবে কেনাবেচার হার। এসব কমে গেলে সহজ অংকের মতোই কমে যাবে সরকারের রাজস্ব আয়। তাই চাকরীচ্যুত করে ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন কোন সমাধান বয়ে আনবে না।
বিপরীত দিকে এমন মন্দা পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। সেক্ষেত্রে কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরি বহাল রেখে অন্যান্য ব্যয় সংকোচন করার কথা ভাবতে হবে। তা হতে পারে আপদকালীন সময়ে নতুন বেতনস্কেল কিংবা ইনক্রিমেন্ট কমিয়ে আনা কিংবা অফিসের ভাড়াসহ অন্যান্য খাতকে সংকোচন করা।
করোনা কারণে আপদকালীন সময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ ফান্ড অথবা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা, যা দিয়ে সচল রাখা যাবে কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে চাকরিচ্যুতির ভয় ও হতাশা কিছুটা লাঘব হতে পারে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের যেমন বুঝতে হবে তেমনি এই আপদকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানেরও উচিত হবে কর্মীদের পাশে থাকা।
এমন বাস্তবতায় ইতোমধ্যেই জনাকীর্ণ রাজধানী ছেড়ে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন গ্রামের পথে। অনেকেই আছেন ঢাকা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তাভাবনায়। নিজের এতদিনের চেনা পেশা হারিয়ে কেউ কেউ টিকে থাকার নিদারুণ চেষ্টায় কয়েক ধাপ নিচের পেশায় নামছেন। সংসারের বিশাল বোঝা বহনের ভার তাদের মাথার ওপর চেপে বসেছে। এ থেকে তৈরি হচ্ছে হতাশা আর সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের শঙ্কা।
মন্দার এমন প্রেক্ষাপটে মানুষ যখন বেঁচে থাকার যুদ্ধে কষ্টের সবটুকু ঢেলে লড়ে যাচ্ছেন অবিরাম সংগ্রামের সময়টুকু। তখন মানুষকে ঠকিয়ে সাহেদ, সাবরিনাদের মতো এমন জালিয়াত প্রতারকদের কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রতারনার খবর তাদেরকে কেবল বিস্মিতই করে না, তৈরি করে হতাশা ও ক্ষোভও। এসব সম্মিলিত ক্ষোভের বিপরীতে নীতি নির্ধারকদের উদাসীনতা আর দায়বোধ নিয়েও প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
সাহেদ, সাবরিনাদের হয়তো আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু শঙ্কার জায়গা হলো সবার অজান্তে আরও নীচের দিকের সারিতে কর্তাব্যক্তিদের দুর্বলতার সুযোগকে ব্যবহার করে অন্যকোনো সাহেদ, সাবরিনা কিংবা পাপিয়ারা বেড়ে উঠছে কিনা! সেদিকেও বাড়াতে হবে সতর্ক দৃষ্টি।
করোনাকালীন এই নাজুক সময়ে সাহেদ, সাবরিনাদের প্রতারনার দিকে যেমন নজর দিতে হবে তেমনি গরীব মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে যোগাতে হবে অর্থনৈতিক সাহস। তবেই হয়তো সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বিপদের সময়কে অতিক্রম করা সম্ভব হবে। খেয়াল রাখতে হবে কেবলই ভুলে বেভুলে সবাই যেন এই করোনার সিরিয়াস সময়কে নিজেদের মূর্খতার কারণে ইন্তেকালের দিকে ঠেলে না দেই আমরা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী