Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকাল: মানবপাচার তথা আধুনিক দাসত্ব


২২ জুলাই ২০২০ ২২:০৪

বাংলার ইতিহাসের দীর্ঘ একটি অধ্যায় জুড়ে দাসপ্রথা ছিল সামাজিক ও আইনিভাবে স্বীকৃত একটি সামাজিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর মানুষদের আনুষ্ঠানিক বেচাকেনা চলত এবং ক্রয়কৃত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি স্বরূপ কাজ করতে বাধ্য থাকত।

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বলছে, দাসপ্রথা প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসনব্যবস্থাতেই বিদ্যমান ছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের সিলেট এবং পার্শ্ববর্তী হুগলী, ত্রিপুরা, চন্দনগরে দাস বিক্রয়ের প্রাপ্ত দলিল অনুযায়ী নিঃস্ব, স্বাধীন ব্যক্তিসমূহ, স্বাধীন ব্যক্তিদের উপর নির্ভরশীল শিশু (পুত্র বা কন্যা) বা ক্রয়কৃত দাসদের পুনরায় বিক্রি করা হতো। চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ও পর্তুগীজ ব্যবসায়ী বারবোসার লেখনীতে, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীতে তৎকালীন দাসপ্রথার সম্যক রূপ তুলে ধরা হয়েছে।

মূলত তখন সামাজিকভাবে অসহায়, দুঃস্থ নারী ও শিশুরা বেশি দাসপ্রথার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, ব্রিটিশদের শোষণমূলক কর ব্যবস্থা ও খাদ্য শস্য রফতানির ফলে, ১৭৬৯-১৭৭৩ সালে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ পরবর্তী অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব, এতিম ও বিধবাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল ক্রীতদাস বাজার। বাস্তবক্ষেত্রে দাসপ্রথা হঠাৎ করে থেমে যায়নি। এ প্রথা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বিবেচিত হতে বেশ কয়েক দশক লেগে যায়। সর্বশেষ বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে বাংলা দাসপ্রথা হতে মুক্ত হয়।

একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বস্তুগতভাবে বিশ্ব যখন উন্নতির চরম শীর্ষে সমুপস্থিত, তখন আজ আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন জাগে বিংশ শতাব্দীতে অবলুপ্ত হওয়া দাসপ্রথা হতে প্রকৃত অর্থেই কি আমরা মুক্ত হতে পেরেছি? নাকি মানবপাচারের মত ঘৃণ্য অপরাধের শিকার মানুষগুলো আজও পরিণত হচ্ছে আধুনিক দাসে।

বিশ্বের করোনা মহামারির এই ক্রান্তিকালে যেখানে গোটা বিশ্বব্যবস্থা আজ থমকে গেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠেছে ভঙ্গুর ও বিপদজনক, সেই মূহুর্তে মানবপাচারের যে ভয়াবহ চিত্র বাংলাদেশে লক্ষণীয় তা সত্যিই আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। মানবপাচারের বিষয়টি একটি ঘৃণ্য অপরাধরূপে বরাবরই দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। প্রতিবছর আমাদের শ্রমবাজারে ২২-২৩ লাখ তরুণ প্রবেশ করে। তার সামান্য অংশই কাজ পায়। বাকিরা বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে প্রভূত উন্নয়ন হলেও বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মসংস্থানবিহীন এসব মানুষ উন্নত জীবনযাপনের আশায়, চাকরির প্রত্যাশায় এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য নিজের অজান্তেই মানবপাচারকারীর দুষ্ট চক্রের ফাঁদে আটকে পড়ছে। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুরসংখ্যক মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরের সংবাদপত্রের চিত্র থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষ এবং অসাধু মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে ভূমধ্যসাগর, বঙ্গোপসাগর বা অননুমোদিত ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে অর্থ ও জীবন দু’টোই হারাচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার মতে গত চার বছরে বঙ্গোপসাগর দিয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের থেকে সমুদ্র পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বাধিক প্রচলিত এসব রুটে মালয়েশিয়াগামীরা যেতে বেশি আগ্রহী। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে আটক হয় ১৯৪ বাংলাদেশি যাদের গন্তব্যস্থল ছিল মালয়েশিয়া। একই বছরের মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকুলে ৩৯ বাংলাদেশি নৌকাডুবিতে মারা যান।

এছাড়াও থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যে গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ভূমধ্যসাগরে চাকরি সন্ধানীদের সলিলসমাধির যে খবর পাওয়া গেছে সেসব নিদারুণ ঘটনায় বাংলাদেশিদেরও উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো আমাদের সরকারের স্বদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এসব করুন ধিক্কারজনক ঘটনার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আমরা জানি যারা পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পা দেয় তাদের অধিকাংশই পারিবারিকভাবে সচ্ছল নয়। সচ্ছল ও সুন্দর জীবনের আশায় তারা ইউরোপের মতো উন্নত বিশ্বে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের অনেকেই ঋণ করে বা জমি জমা সর্বস্ব বিক্রির টাকা পাচারকারী হাতে তুলে দেয়। এর পরও অনেকে পথিমধ্যে লিবিয়ার গিয়ে পাচারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পরিবারের কাছে অতিরিক্ত অর্থ চায়।

অর্থ না পেলে পাচারকারীরা অমানুষিক নির্যাতন চালায়, কখনও সে ভিডিও পাঠানো হয় তার পরিবারের কাছে। আবার স্থানীয় মাফিয়াদের পক্ষ থেকে উদ্ধারের নামেও স্বজনদের কাছে চাওয়া হয় টাকা। এরপরও অনেকেই কাঙ্ক্ষিত দেশে যেতে পারে না। আর তাইতো আমরা দেখেছি ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধির যত ন্যাক্করজনক ঘটনা।

মানবচারীকারী চক্র টাকার নেশায় মানুষ বিক্রির মত কাজ করছে, তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চলাচ্ছে। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনকার্যে লিপ্ত হতে। যার একটি উদাহরণ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে র‍্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে গত দেড় বছরে সহস্রাধিক নারী পাচার হয়েছে, যাদের অধিকাংশই হয়েছে যৌন নিপীড়নের শিকার। আমাদের সম্ভাবনাময় শ্রমশক্তির উৎস বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মানবচারের বলি হওয়ার এসব মর্মান্তিক ঘটনা ও নির্মম পরিণতি প্রকৃতপক্ষে দেশ ও জাতির জন্য বেদনাদায়ক।

আমরা দেখেছি বিগত কয়েক বছরে মানবপাচার সংক্রান্ত অপরাধ দমনে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে সরকার কঠোর ব্যবস্থা ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তথাপি এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা এখনো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে করোনাকালীন স্থবিরতায় আমাদের দেশে অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে এখন ফিরে যাচ্ছে গ্রামে দিন দিন বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হারও। ভবিষ্যতে এসব মানুষের পরিণতি কী হবে ? কিভাবেই বা তারা জীবিকা নির্বাহ করবে ? বর্তমান চিত্রপট থেকে এটা স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, এই বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ বেকারত্বের সমস্যা আরও প্রকট রূপ ধারণ করবে। বেকারত্বের হারও ক্রমবর্ধমান হবে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এর বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হলেও এটি বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশির মৃত্যুর পর নতুন করে বিষয়টি আবার জোরালোভাবে সামনে আসে। ইতিমধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবপাচার ও সন্ত্রাস দমন আইনে সারাদেশে বাইশটি মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে আটক করা হয়েছে লক্ষ্মীপুর-২ এর কাজী শহীদ ইসলাম (পাপুল), নারীপাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের আজম খানসহ প্রায় সতেরো জনকে। এটা স্বস্তির বিষয় যে, পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও সরকার মানবপাচার দমন ও সুরক্ষা আইন-২০১২ বাস্তবায়নে বিধি ও অন্যান্য আইন চূড়ান্ত করে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসনীয়।

কিন্তু আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনও কম। তবে কি বিপৎকালীন সময় অতিক্রম করে আমরা আরও বড় কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি? এই অসংখ্য নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত,অসহায় মানুষের শেষ গন্তব্য হবে কি মানবপাচারের নামে প্রচলিত ক্রীতদাস বাজারে? তারা কি পরিণত হবে আধুনিক দাসে? করোনাকালে এবং করোনা পরবর্তী বিশ্ব-ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান ও বিদেশে চাকরি পাওয়া আগের চেয়ে আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। তবে অপ্রিয় সত্যটি হলো দেশে কর্মসংস্থানের অভাব ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণেই মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। কোনো অঘটন না ঘটলে সেটা হয় অভিবাসন। আর অঘটন ঘটলে এবং তা জানাজানি হলে সেটা তখন মানবপাচার হয়, সাময়িক পদক্ষেপ ও নীতিমালা প্রণয়নের পর ফের চুপ, এভাবেই চলছে।

পূর্বে থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার গহীন জঙ্গলে আবিষ্কৃত বাংলাদেশিদের গণকবরের কাহিনী আমাদের হতবাক করেছিল। তখনও অনেক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা গণকবরের জন্য দায়ী, সেই কুশীলবদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। সেই ব্যর্থতাই লিবিয়ার বিয়োগান্তক উপখানের জন্ম দিয়েছে। নাগরিকরা তাদের বেঁচে থাকার ঝুঁকির তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে দেখে তার দেশ কম অনিরাপদ নয়। সুতরাং কারণটা খুঁজতে হবে অর্থনীতিতে, বেকারত্ব মোচন করতে না পারার দিক থেকে।

বিশ্লেষকদের মতে, মানব পাচারের অভিশাপ থেকে কর্মক্ষম জনশক্তিকে বাচাতে সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পাচারকারী চক্রের কঠোর শাস্তি যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি আমাদের তরুনসমাজকে সচেতন করে তুলতে হবে। একইসঙ্গে তরুণদের মধ্যে চাকরি খোঁজার মানসিকতার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। কারণ এখন আমাদের সবচেয়ে জরুরি বেকার সমস্যার সমাধান। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মুক্তশ্রমের ব্যবহার ও পুঁজি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে আমরা অনেকটা এগিয়ে যেতে পারি। আমাদের জনশক্তি রপ্তানিও জরুরি। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ প্রশিক্ষণ, আইনানুগ প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই কাউকে দেশের বাইরে পাঠানো উচিত। তাছাড়া যেসব আইন বা নীতিমালা রয়েছে সর্বতোভাবে সেগুলোর কার্যকারী প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষে আইন বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত তাদের প্রশাসনিক দিক থেকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

ইতোমধ্যে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনের সদস্যদের আটক করার সংবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট-২০২০ সালের বৈশ্বিক মানবপাচারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান পুনরায় দ্বিতীয় স্তরে উন্নতি হওয়া আমাদের মনে আশার সঞ্চার জাগায়।

আবার ১১-১৩ জুন, ২০২০ আইওএম এর তথ্যানুযায়ী ৩৬২ বাংলাদেশির ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপে আটকের ঘটনা আমাদের শঙ্কিত করে। তাই এখন সময় এসেছে মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ নির্মূলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের। সবার স্বদিচ্ছা আর সম্মিলিত উদ্যোগই পারে মানবপাচারের অভিশাপকে সমূলে উৎপাটন করতে। এছাড়া পাচারকৃতদের প্রতি আমাদের অক্ষমতার শিকার হয়ে যেন আর কেউ সমাজের মূল স্রোত থেকে হারিয়ে না যায়, আর কেউ যেন আধুনিক দাসত্বের শিকার না হয় সেদিকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মানব পাচার


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর