নিউ নরমাল বাংলাদেশ: সংকটের বিপরীতে সম্ভাবনা (পর্ব- ২)
২৪ জুলাই ২০২০ ২১:১৭
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট অতিমারিতে সংকটের বিপরীতে সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে নিউ নরমাল বিশ্ব বাস্তবতায় বাংলাদেশের অনুমেয় ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা শেয়ার করেছিলাম প্রথম পর্বে । করোনা পরবর্তী পৃথিবী আর কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থায় আধুনিকতা বা সভ্যতার নামে আমাদের অপরিণামদর্শী প্রকৃতিবিরুদ্ধতা এবং শ্রেষ্ঠ প্রাণীকুল হিসেবে চলমান চরম বৈষম্যমূলক ‘আত্মঅতিঅস্তিত্ববাদিতা’- পরিবেশ বৈচিত্র্যময়তাকে অস্বীকার করে বিধায় এই পরিবর্তনটি খুব প্রয়োজনীয় ছিল। গোটা পৃথিবীতে এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। পোস্ট কোভিড এফেক্ট ও তার আফটার ম্যাথ নিয়ে ব্যক্তি থেকে বিশ্ব- সবাই এখন নিউ নরমালসির বাস্তবতায় নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রায় সকল সেক্টর নিয়েই নতুনভাবে বিশেষজ্ঞ ভাবনা খুব জরুরি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোভিড সৃষ্ট সর্বমূখী সংকট ও সম্ভাবনার সঙ্গে দুরন্ত বেগে ছুটে আসা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষিতে শুধু ব্যক্তি আচরণ, পরিবার ও সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে নিজস্ব কিছু ভাবনা শেয়ার করেছিলাম। মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রস্তুতিমূলক ভাবনাটিই ছিল প্রতিপাদ্য।
করোনাভাইরাসের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্নআয়ের মানুষ। অভিযোজনের ফলে মধ্যবিত্ত না হয় ঘুরে দাঁড়াবে, হয়তো মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হবে, কিন্তু দরিদ্র বা অতি দরিদ্রের কী হবে? বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব খুবই তীব্রতর হবে। শহুরে অর্থনীতি তথা দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠন অবশ্যম্ভাবী। নিম্ন আয়ের মানুষ তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার খোলনলচে পাল্টে যাবে নিশ্চিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে রাষ্ট্রের দায়টি প্রধান কিন্তু আমরা যারা সমাজে নিজেদেরকে শিক্ষিত ও সচেতন বলে দাবী করি, নিজেদের ও সমাজের অন্যান্যদের অভিযোজনে আমাদের দায়টা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের আশেপাশের নিম্ন আয়ের মানুষকে অনিশ্চিত আগামীর জন্য প্রস্তুত করতে এবং করাতে নিজেদেরও প্রস্তুতি দরকার। এ পর্বে আমি সংক্ষিপ্তভাবে তাদের কথাই বলবো।
জিডিপি, বাজেট, প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, প্রণোদনা…ইত্যাদি টার্ম সাধারণ মানুষ বোঝে না, এমনকি আমার মত অনর্থনৈতিক মানুষও প্রায়শই বিভ্রান্ত হই। বাস্তবতা হচ্ছে করোনা মোকাবিলায় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যায়ে এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক এবং এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। গত ৮ জুন অর্থনীতি সমিতির গবেষণা বলছে, ৬৬ দিনের লকডাউনে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এ সময়ে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোয় পরিবর্তন হয়েছে। লকডাউনের আগে বিত্তবান যে ১ কোটি ৭০ লাখ ছিল তাদের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। উচ্চ-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তে নেমে গেছে। মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছে। দরিদ্র থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছে। এ মানুষগুলো এক ধাপ নিচে নেমে গেছেন। সব মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশই গ্রামে চলে গেছে। প্রতিবছর ৬০ হাজার মানুষ প্রবাসী হয় কর্মসংস্থানের জন্য সেটাও এখন বন্ধ, শ্রম রফতানির বাজার আর উন্মুক্ত হবে বলে মনে হয় না। প্রায় এক কোটি প্রবাসী আছে আমাদের যাদের একটা অংশ করোনাকালে ফিরে আসলেও এখন অনেকেই সে দেশে ঢুকতে পারছে না, আরেকটি বিশাল অংশ অচিরেই ফিরে আসবে দেশে। এই সময়ে তাই রাষ্ট্র ও তার জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ গণমানুষের কর্মসংস্থান এবং অনাগত আগামীর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
একটি কথা আমি পুনর্ব্যক্ত করছি, আমি যেহেতু কোন বিষয়েই বিশেষজ্ঞ নই শুধুমাত্র সচেতন ধারণা থেকেই ভাবনা শেয়ার করা। অসংখ্য বিষয় বাদ পড়বে, গুরুত্ব বিন্যাসে ভুল হবে, বিশ্লেষণ ও ফোরকাস্টিংও ত্রুটি পূর্ণ হতে পারে তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পয়েন্টগুলো ক্যাটাগোরাইজ করলে ভালো হতো কিন্তু সেটা বিশেষজ্ঞ ভাবনা। যেমন প্রথম পর্বে উল্লেখিত বিষয় বা সেক্টরভিক্তিক প্রভাব (রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা) সময়ভিত্তিক প্রভাব (চলমান, ইমেডিয়েট পোস্ট কোভিড ও দীর্ঘমেয়াদী), বিত্তভিত্তিক প্রভাব (উচ্চমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অতিদরিদ্র), বয়সভিত্তিক প্রভাব (শিশু, তরুণ, জ্যেষ্ঠ), জনপদভিত্তিক প্রভাব (গ্রাম, শহরতলি, শহর) …এরকম সেগমেন্ট ধরে করোনাভাইরাসের প্রভাব ও করণীয় নিয়ে গবেষণা জরুরি। গুরুত্বের ক্রমানুসারে নয় বিচ্ছিন্নভাবেই ভাবনাগুলো শেয়ার করছি।
০১
করোনা যুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটির মত অমানবিক সিদ্ধান্ত উন্নত মানবিক রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য, কেননা ইটস এ ওয়ার, এ্যান্ড এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এ্যান্ড ওয়ার। প্রি কোভিড যুগে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সহায় সম্বলহীন হয়েছে বৃহৎ পুঁজির কাছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র কোটি মানুষের আয়-বাণিজ্যের শেষ অবলম্বনটুকু কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে কর্পোরেটের হাতে। মাত্র ১০ বছর আগেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানায় প্রায় শতাধিক বেকারি, আটামিল, ঘানিসহ অনেক প্রকার ক্ষুদ্র ও হস্তশিল্প কারখানা ছিল। ঝাল মুড়ি থেকে শুরু করে রুটি, লাড্ডু, পাপড়ভাজা, ঝুরঝুরি, মোয়া বা কটকটি বিক্রি করে কোটি মানুষের সংসার চলতো, আজ প্রায় সবই চলে গেলো ১/২টি কর্পোরেটের পকেটে। নদীমাতৃক আবহমান বাংলায় আমাদের ইমেডিয়েট পূর্বসূরিরাও নিজেরাই নৌকা বানাতো গৃহকর্মের নিত্য অনুষঙ্গ হিসেবে। এখন আরএফএল’র ফাইবারের নৌকা ঢুকে পড়েছে খালে-বিলে। আর বাঙালির প্রাণের প্রতীক হক-ভাসানী-বঙ্গবন্ধুর নৌকা আছে শুধু রাজনৈতিক স্লোগানে অথবা যাদুঘরে।
আম জনতাকে বাজার অর্থনীতি বা ইথিকাল বিজনেস বুঝিয়ে লাভ নেই। অবিলম্বে বৃহৎ পুঁজির সীমারেখা নির্ধারণ করে দিন। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহাদুর্যোগে কর্মহীন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তারা নিজেরাই করে নিতে পারবে রাষ্ট্র যদি শুধুমাত্র একটু পলিসি সাপোর্ট দেয়
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাজারে যদি বৃহৎ পুঁজির প্রবেশাধিকার এখনই সংরক্ষিত করা হয় তবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউয়ের সঙ্গেও তাদের অভিযোজিত হতে সমস্যা হবে না, কেননা ফাহিম সালেহর মত ইয়াং ট্যালেন্ট প্রজন্ম নীরবেই তৈরি হচ্ছে আমার দেশে, ক’জনকেই আর মারতে পারবে ওরা?
০২
আব্বাস উদ্দিনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘শহুরে মানুষ কেন তার গান শোনে?’ উত্তরে বলেছিলেন ‘রেডিওর অপর প্রান্তে যে মানুষ বসে থাকেন তাদের প্রত্যেকেরই একটা শিকড় আছে গ্রামে’। একমাত্র শিকড়ই বৃক্ষকে বাঁচাতে পারে। কোভিড পরবর্তী যুগে ‘কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি’ মুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিকাংশ দেশের জন্য প্রধান ও একমাত্র পথ।
গ্রাম থেকে আসা অনিকেত অভিবাসী শহুরে মানুষ আজ মনের আনন্দে নয়, তার কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই শিকড়ের টানে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে আবার। প্রি কোভিড-১৯ সময়ে অপরিকল্পিত নগরায়নের অসুস্থতায় সরকার হাজার কোটি টাকার বাহারি ও লোভনীয় প্রকল্প নিয়েছিলো মানুষকে গ্রামে ফিরাতে। শুধু টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নয় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিতের জন্য গ্রাম উন্নয়ন জরুরি।
৩য় বারের মত ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহার “আমার গ্রাম, আমার শহর” যা পারেনি, হাজার হাজার কোটি টাকার গ্রামে ফেরা কর্মসূচি যেখানে ব্যর্থ, করোনা সেখানে কাঙ্ক্ষিতের চেয়ে কয়েকশগুণ বেশি মানুষকে গ্রামে ফিরিয়ে দিয়েছে
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের রয়েছে কৃষিকাজসহ নানা গ্রামীণ শিল্পে দক্ষতা, যা বহু প্রজন্মের পরম্পরা। সংকটের এই ঘোর আবর্তে তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চাইবে তার পরিবার, গ্রাম ও কৃষ্টিকে। কিন্তু সে কি পারবে?
বাঙালি মধ্যবিত্তের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর আমাদের পিতৃপুরুষের হাত ধরে জন্ম ও বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ। আমাদের পিতা/মাতারা দেশের নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারসমূহে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে। এবং তাদের হাত ধরেই এই শ্রেণিউত্তোরণ, তাদের হাত ধরেই আমাদের স্বাধীনতা, তাদের হাত ধরেই বিকশিত শহুরে সভ্যতা। আত্মো উন্নয়নের জন্য তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বসতি করেছে, গ্রামে গড়েছে স্কুল কলেজ। বছরে ২/১ বার যেত বর্গাচাষীর হাতে জমি বুঝিয়ে দিতে, বছরের খোরাকী ধান, মাছ, ফল-সবজি, মুড়ি-চিড়া আসতো শহরের বাসায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আমরা বড় হয়েছি সামান্য কিছু নস্টালজিক স্মৃতি নিয়ে, ২য় প্রজন্ম বড় হলো নাগরিক ইনকিউবিটরে- তারাও এখন প্রবেশ করতে শুরু করেছে কর্মজীবনে। অধিকাংশ মধ্যবিত্তের উত্তরাধিকার সম্পত্তির আর অস্তিত্ব নেই। শিক্ষিত বাবার উদারতায় আমাদের প্রায় সকলের দাদার জমি চাচা বা চাচাতো ভাইরা ভোগ দখল করছে, সামান্য কিছু হয়তো বাবা বিক্রি করতে পেরেছেন আমাকে মানুষ করার জন্য বা অন্য কোন সংকটে। আমরা এখনঅনেকেই স্বপ্ন দেখি অবসরের পর গ্রামে ফিরে যাবো। কিন্তু বাস্তবতা কী? প্রায় অর্ধ্বশতাব্দি পরে কী গ্রামে ফেরা যায়?
আমার নিজের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। আমার ছোট চাচা অবসরের পর গ্রামে গিয়েছেন। কিছুতেই তিনি পরিবর্তিত গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে বৃদ্ধবয়সে এ্যাডজাস্ট করতে পারছেন না, সেই সঙ্গে- “ওই আইছে ৬০ বছর পর সম্পত্তির ভাগ নিতে!” টাইপের ব্যাঙ্গ হয়- তাকে গ্রাম ছাড়া করাতে। অন্যান্য খুঁটি-নাটি বিষয় আর না বললাম। মধ্যবিত্তের হাতে কিছু ক্যাপিটাল বা স্কিল আছে বিধায় শ্রেণীচ্যুত হলেও গ্রামীণ জীবনের অভ্যস্ততায় ফিরে আসা একটু দুরূহ হলেও সম্ভব। এত গেল মধ্যবিত্তের গীত কিন্তু শহুরে শ্রমজীবী নিম্নআয়ের মানুষদের কী হবে? তাদের তো গ্রামেও মাথা গোঁজার জায়গা নেই।
বর্তমান সরকার দারিদ্র বিমোচন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রায়ন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ ১০ টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া সরকরের পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (এসএফডিএফ) পশুসম্পদ অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সরকারী নানা প্রতিষ্ঠান দেশের জনগণের জীবন মান উন্নয়নে নানা প্রকার প্রকল্প গ্রহণ করে থাকে। এর বাইরে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশাসহ ১৫টি উন্নয়ন সংস্থা সরকারের মাইক্রো ক্রেডিট অথরিটির অনুমতি নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশে সহস্রাধিক এনজিও’র মুখে নানা উন্নয়নের গল্প শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে গ্রামে না গেলে তা বোঝা যায় না। আমার হাতে তথ্য উপাত্ত নেই কিন্তু জোর দিয়েই বলতে পারি একমাত্র সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচি ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকল্পের ২৫ শতাংশ সুফলও গ্রামের মানুষ পায়নি। অধিকাংশ প্রকল্পের সুফল গিয়েছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের পকেটে। সরকারী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ যে সকল উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে তার মধ্যে ন্যূনতম কোন সমন্বয় নেই। যদিও সরকারের প্রায় সকল অধিদপ্তরই দাবী করে তাদের ডিজিটাল ডাটাবেজ আছে বাস্তবে কি আছে তা তারা নিজেরাও জানে বলে মনে হয় না, জেনে থাকলেও তার ব্যবহার জানে না, এটা নিশ্চিত। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকে নিজের অজান্তেই সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক সমিতির সদস্য। একটি অধিদপ্তর আরেকটি অধিদপ্তরের কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানে না, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় তো অনেক পরের আলাপ। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ জনগণকে উন্নয়নের নামে গিনিপিগ বানিয়ে দেশি-বিদেশী/সরকারী-বেসরকারি সংস্থাসমূহ নানা প্রকার ট্রায়েল চালায়, দেখার কেউ নেই।
করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের গ্রামে ফেরার যে তীব্রতর স্রোত তা আমরা কেউই বছর শুরুতেও কল্পনা করতে পারিনি। এই স্রোতটিকে উৎপাদনে সম্পৃক্ত করতে রাষ্ট্রের দরকার ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে অনেক অনেক গবেষণা ও কর্মপরিকল্পনা এবং আমাদের সকলের সচেতন প্রস্তুতি।
০৩
“পাখিটা যে গাছটায় বসে, গাছটা যে মাটিতে দাঁড়িয়ে সে মাটি এখনো খুব কষে, ধরে সব দু’হাত বাড়িয়ে।”- কবীর সুমনের গানের মতই সত্য- সভ্যতাকে ফিরে আসতে হবে মাটির কাছেই। জাতি হিসেবে আমরা খুবই ভাগ্যবান- জন্ম আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে উর্ব্বরতম মাটিতে, পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশে। যে মাটির উর্বরতা লোভে সারা পৃথিবীর লুটেরারা এসেছিল এই বঙ্গদেশে। পৃথিবীর অন্যসব দেশের কথা জানিনা নিজের দেশের কথা বলতে পারি, স্বাধীনতার অর্ধশতকে জনসংখ্যা হয়েছে প্রায় আড়াইগুণ (প্রতি বছর যোগ হয় ২২ লাখ মুখ) জমি বাড়েনি এক ছটাকও উল্টো কমছে কৃষিজমি প্রতিবছর ১ শতাংশ করে। অথচ একদা খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যতিরেকেই বাংলাদেশ আজ উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ। স্বপ্ন আমাদের এখানেই।
আমাদের কৃষি গবেষণা এখন বিশ্বমানের। চাষাবাদে শুরু হচ্ছে আধুনিকায়ন। অর্গানিক এগ্রো, বায়োফ্লেক্স, একোয়া ফিনিক্স, ভার্টিকাল ফার্মিং, গ্রিন হাউজ, যান্ত্রিকায়নসহ নানা আধুনিকায়ন স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে দেশে। বিশ্বব্যাপী শুরু হচ্ছে স্মাটফার্মিং যুগ। জৈবপ্রযুক্তি, ব্লকচেইন, জিপিএইচ, রোবোটিক্স, এআই, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, আইওটি ইত্যাদি ব্যবহার করে আমাদের জলবায়ু উপযোগী এগ্রোটেকের মাধ্যমে সমন্বতিভাবে পরিবেশবান্ধব কৃষি উৎপাদন শুরু করতে হবে। উৎপাদনের পাশাপাশি পণ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, নানা প্রকারের ভ্যালুএডিশন ও বিপণন ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। এর পাশাপাশি হাইব্রিড ফসলের জন্য যে ‘বীজ মাফিয়া’ গড়ে ওঠেছে তাদের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আমার এলাকা পটুয়াখালী তরমুজ উৎপাদনে গত কয়েক বছরে দেশের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে, কিন্তু তরমুজের বীজ চাষিরা ফলাতে পারে না, অত্যধিক দামে বিদেশী বীজ বা কর্পোরেট বীজ কিনতে হয়।
পোল্ট্রি সেক্টরেও বিগ প্লেয়াররা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, বার্ডফ্লুর ধোয়া তুলে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র খামারীকে সর্বশান্ত করে দেয় নিয়ম করে
বড় বড় পোলট্রি ফার্মগুলো এখন নিজেরাই বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করছে। একইসঙ্গে তারা স্থানীয় খামারীদের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে পোলট্রি শিল্পের মূল উদ্যেক্তারা আজ মালিকানা হারিয়ে কর্মচারীতে পরিণত হয়েছে। নিউ নরমালের এই সময়ে এই পোলট্রি উদ্যেক্তাদের জীবনে নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসতে পারে।
এগ্রো সেক্টরে কোনো প্রকারের মাফিয়াগিরি মানা সম্ভব নয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আগমনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়েই এদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অর্গানিক কৃষিতে ফিরে আসতে হবে আমাদের কেননা গোটা পৃথিবীই এখন বিষমুক্ত, ভেজালমুক্ত, অর্গানিক পণ্যে ফিরে আসছে।
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে অনেকেই হয়তো শ্রম সংকোচনের আশংকা করছেন কিন্তু তখন কর্মসংস্থানেরও অবারিত দ্বার উন্মোচিত হবে, প্রয়োজন শুধু মাইন্ডসেটাপের পরিবর্তন ও সামান্য যুগোপযোগী কিছু সিদ্ধান্ত। রাইডশেয়ারে যেমন একটা নীরব কর্মসংস্থান হয়েছে তেমনি করোনাকালে ই-কমার্স বুমিং হয়েছে দারুণভাবে, এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় কয়েক লক্ষ তরুণের। কৃষিক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্মও নতুন সম্ভাবনা। আমি আশাবাদী শুধুমাত্র যথাযথ কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমেই বর্তমান সরকারের রূপকল্প ৪০-৪১ এর আগে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবে, যদি করোনা পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সমন্বিত টেকসই ইনক্লুসিভ গ্রামোন্নয়নের নয়া পরিকল্পনা ও উদ্যোগ আমরা যুৎসইভাবে নিতে পারি। মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র টেকনোলজির কারণে উন্নত বিশ্বে কৃষক মানেই ধনাঢ্য শ্রেণী আর আমাদের দেশে কৃষক মানেই নিচু জাতের অস্পৃশ্য সম্প্রদায়, ভদ্রলোকের ড্রয়িংরুমে প্রবেশাধিকার নাই যার, থাকলেও সোফা রেখে মেঝেতেই বসতে হয় তাকে। দিন বদলাতে শুরু করছে, নতুন প্রজন্ম অনেকেই ফিরে আসছে মাটির কোলে। মাটিতে জন্ম- মাটিতেই শেষ, মাটিই বাঁচাবে বাংলাদেশ। কবীর সুমনের ভাষায়- মানুষ যে মাটিকে কাঁদালো, লুট করে মাটির জীবন, সে মাটি শুভেচ্ছা পাঠালো, ঘাসের সবুজে প্রাণপণ।
০৪
বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দেশের সরকারি অর্থনীতিবিদরা খুশীতে ডগডগো। চীন থেকে উন্নত অনেক দেশ পুঁজি প্রত্যাহার করছে- অনেক দেশ চীন থেকে পুঁজি প্রত্যাহারে লোভনীয় ইনসেনটিভও দিচ্ছে। অনেকের ভাবনা বাংলাদেশের উচিৎ সেই পুঁজিকে আমাদের দেশে আনা। কেউ বলে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে সস্তায় চীন থেকে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আনো, কেউ বলে এখান থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া উচিত, কেউ বলে পানির দামে তেল চলে যাচ্ছে- রেমিটেন্সের রিজার্ভ দিয়ে ওয়েল রিজার্ভ করি না কেন? কিন্তু তারা একবারও ভাবে না প্রবাসে থাকা সোনার ডিম পাড়া হাঁসগুলো তাদের জমানো ডিমগুলো একসাথে পাঠাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটি চিরতরেই দেশে চলে আসছে, সাধারণ ডিমও আর পাড়বে না। সংখ্যাটা কেউ বলে ২০ লাখ কেউ বলে ৩০ লাখ। দেশের অভ্যন্তরে নতুন কর্মহীন কয়েক কোটি মানুষের ভারই আমরা নিতে পারছি না!
এই বিশাল সংখ্যক রেমিটেন্স যোদ্ধা যারা এতদিন বিদেশ-বিভূঁইয়ে রক্ত পানি করা শ্রম দিয়ে আমাদের রিজার্ভ ভরেছে, রাষ্ট্র তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে? ‘ওয়েলকাম ব্যাক’ বলার সাহস কি আমাদের আছে?
আভ্যন্তরীণ কর্মহীনদের চেয়ে প্রবাস ফেরতদের অবশ্য একটু বাড়তি সুবিধা আছে তা হচ্ছে তাদের হাতে আছে কিছু ক্যাপিটাল আর কিছু স্কিল। কিন্তু তাদের অভিযোজনে তেমন কোন পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না।
এছাড়া আনফেয়ার নয় আরেকটি ফেয়ার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরি। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশে এতটাই প্রিভিলাইজড- নানা প্রকারের অনৈতিক সুবিধাও সরকারকে চাপে রেখে তারা আদায় করে নেয়। এরকম একটি মামা বাড়ির আবদার গত ১০ বছরে বিশাল বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে- তা হচ্ছে “অবৈধ ওভারসিজ এমপ্লয়ি” এবং দেশের নানা সেক্টরে এদের সংখ্যা নাকি ১০ লাখের উপরে। গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং এমন কোনো রকেট সায়েন্স নয় যে আমাদের ছেলেরা পারবে না। অথচ দর্জিওয়ালারা তাদের প্রোফাইল ও অবৈধ মুনফা বাড়াতে ১০/২০ জন দেশি কর্মীর জায়গায় ১ জন ইন্ডিয়ান বা শ্রীলংকান নিয়োগ দেন অবৈধভাবে যারা রাজ করে প্রতিটি ফ্যাক্টরি ও বায়িং হাউজে, চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। ২০ বছর আগে আমরা যখন গার্মেন্টস ট্রেডটি ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করিনি তখন- আমার শ্রম, আমার টাকা, আমার ফ্যাক্টরি, আমার শ্রমিক অথচ মুনফার ক্রিমটা নিয়ে যেত কোরিয়া, হংকংয়ের চতুর বায়িং হাউসগুলো। আমাদের দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৌরত্ব কমেছে ঠিকই পাশাপাশি আমাদের বেড়েছে অনৈতিক আবদার। বাংলাদেশ থেকে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়, তার সিংহভাগ হয় এই সেক্টরের মাধ্যমে। যে যতই ‘হাজী সাব’ সাজেন না কেন দেশে এমন কোন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নেই যার বিদেশে ইনভেস্টমেন্ট বা ডিপোজিট নেই।
গার্মেন্টস সেক্টরসহ ঢাকায় কর্মরত সকল অবৈধ বিদেশীদের এখনই খুঁজে বের করে দেওয়া দরকার তাহলেই কয়েক লাখ শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান এখানেই সম্ভব
এর পাশাপাশি এই সেক্টর নিয়ে আরেকটি শঙ্কার কথা বলি- গার্মেন্টস শিল্প শ্রমঘন শিল্প হিসেবে সস্তা শ্রমের দেশে তা সাময়িকভাবে আরও কিছুদিন টিকে থাকবে, কিন্তু কতদিন? যে প্রোডাক্টের মূল উপাদান তুলা- যা আমাদের শতভাগ আমদানি করতে হয় শুধুমাত্র কাটিং-মেকিংয়ে ভ্যালু এ্যাড করে কতদিন আমরা টিকতে পারবো? এই আধামেকানাইজড সেক্টরই তো বিলুপ্ত হবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রথম ধাক্কায়। তারচেয়ে আমাদের নিজেদের যা আছে তা নিয়েই বেশি ভাবা উচিত। হ্যাঁ, আমি বাংলার গর্ব সোনালী আঁশ- পাটের কথা বলছি। পাটের মত একটি পরিবেশবান্ধব চমৎকার ফাইবার দিয়ে আমরা চটের বস্তা বানাই- এটা আমার কাছে দুঃখজনক। পাটের জিনোমকোডও আমরা আবিষ্কার করেছি। আমাদের উচিৎ পাটের ব্যবহার আরও এক্সক্লুসিভ করা যায় কীভাবে- তা নিয়ে গবেষণা করা।
১৯৭৯ সালে ক্রুড ওয়েল বেইজড বাইপ্রোডাক্ট পিপি দিয়ে বিশ্বময় প্লাস্টিক বিপ্লব হয়েছে। পাটের মত অর্গানিক ফাইবারের জায়গা দখল করে নিয়েছে পরিবেশের নাম্বার ওয়ান শত্রু প্লাস্টিক। করোনা এসে তেলের বাজার দরকে তলানিতে নিয়ে আসলো কিন্তু এর কোন প্রভাব পড়লো না প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে। আমাদের মত শ্রমঘন উন্নয়নশীল দেশের শিল্পায়ন অনেকটাই প্লাস্টিকমুখী হতে বাধ্য হয়েছে আভ্যন্তরীণ চাহিদার জন্য। যেহেতু শতভাগ কাঁচামাল আমদানি নির্ভর তাই প্লাস্টিক শিল্পও বাংলাদেশে তেমন সাসটেইনেবল হবে না, হওয়া উচিত ও নয় যেহেতু ইকো ফ্রেন্ডলি নয়। কিন্তু বিশ্বে সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি ক্লাইমেট চেঞ্জের শিকার আমরা। মাঝখানে শুনেছিলাম কার্বন ট্রেডিং করে বাংলাদেশ বিলিয়ন ডলার ইনকাম করবে কিন্তু গতকাল ২৩ জুন কক্সবাজারে বিশ্বে জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রথম প্রকল্প যা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম আশ্রায়ন প্রকল্প- সেটি উদ্বোধন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী- যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে কেন? যাদের কারণে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন হেতু দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরই উচিত আমাদেরকে এই ক্ষতিপূরণ দেয়া। এটা আমাদের অধিকার, কিন্তু যে কোন প্রকার আন্তর্জাতিক নিগেশিয়েশনে আমাদের সক্ষমতা শূন্যের কোঠায়। অতীতে আমরা শুধু ঠকেই এসেছি, কেউ আমাদের ন্যায্য হিস্যা দেয়নি, দিতেও চায় না, আদায় করে নিতে হয়। একমাত্র সমুদ্রসীমা নির্ধারণে কিছুটা সক্ষমতা দেখালেও অদ্যাবধি তেমন আর কোন অর্জন চোখে পড়ে না।
আগামীর পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে নেগেশিয়েশনের ক্যাপাসিটি বিল্ড আপ করতেই হবে অন্যথায় সরকারের স্বপ্নদর্শী ব্লু ইকোনোমির ডেল্টা প্লান স্বপ্নেই থেকে যাবে
০৫
অনেক সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ঈর্ষনীয় অবস্থানে আছে। অথচ জীবন-মান অবকাঠামোর সূচকে ঢাকা বিশ্বের সহস্র শহরের মধ্যেও পড়বে না, কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজকাঠামোতে তুলনামূলক বাবুগিরি ও আয়েশী জীবন, ফ্লাটের দাম হিসাব করলে শীর্ষ দশে থাকবে ঢাকা। স্বাভাবিকভাবেই মহামারিকালেও বিত্ত এখানে সুরক্ষা দেয়নি, তেমনি দারিদ্র আরও তীব্রতর হয়েছে। বলা হয় কোটি মানুষ শহর ছেড়েছে, প্রমাণ চাইলে যে কেউ কয়েকটা ঘণ্টা একটু বস্তিতে কাটিয়ে আসুন- চিত্রটা পরিষ্কার হবে। কিন্তু কারা শহর ছাড়েনি? যারা টিকে থাকতে পারবে তারা এবং যাদের গ্রামেও যাওয়ার জায়গা নেই তারা। ঢাকা শহরের বস্তিগুলো গড়ে ওঠেছে অধিকাংশই অবৈধ জায়গায়, কিছু হয়েছে ব্যক্তিগত জায়গায়। অবৈধ পেশীজীবী বা বৈধ মালিকের কাছ থেকে শুধু খালি জায়গাটা ভাড়া নেয় কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী উদ্যোক্তা। তারা বস্তি বানিয়ে ভাড়া দেয়। এই মধ্যসত্ত্বভোগী উদ্যোক্তা বা দালালরা এবার কিছুটা মানবিকতা দেখিয়েছে, বস্তির অর্ধেক ঘর খালি, বাকী অর্ধেকের অর্ধেকও ভাড়া দিতে ব্যর্থ, তবু থাকছে।
এত মানুষ ঢাকা ছেড়েছে কিন্তু ভিক্ষুক বেড়েছে মনে হয় ১০ গুণেরও বেশি। রাস্তায় আপনি নিজের পকেটে হাত দিবেন তো ১০ জন ভিক্ষুক আপনাকে ঘিরে ধরবে, যা আগে কখনই দেখা যায়নি। আপনার বাসার গৃহকর্মীটি কী অবস্থায় আছে পারলে খবর নিয়ে দেখুন। সন্ধ্যার পর ঢাকা শহরে নিজের প্রাইভেট কার নিয়ে যে কোনো মোড়ে মাত্র ১ মিনিটের জন্য ব্রেক করুন, দেখবেন ১ মিনিটেই কত জন দরিদ্র মানুষ আপনাকে ঘিরে ধরে? তার মধ্যে আপনার গৃহকর্মীকেও হয়তো খুঁজে পাবেন। করোনার কারণে তারা নিশিকন্যাও হতে পারছে না কেননা দেহজীবিরাই তো বেকার। এই সব হত দরিদ্ররা অনানুষ্ঠানিক খাতে সম্পৃক্ত ছিল বিধায় কোন প্রকার প্রণোদনায় তাদের সুফল আসেনি। তাই সরকারের এখনই কিছু ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলেও দ্রুত তা নেওয়া উচিত।
বঙ্গদেশে ১৮৬৫ সালে পালকির জায়গায় রিকশার আবির্ভাব হয় এবং ২০১৫ সালের হিসেবে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫ লক্ষাধিক রিকশা চলাচল করে। পাশাপাশি ঢাকার যাতায়াতের মোট ৪০ শতাংশই হয় রিকশার মাধ্যমে বিধায় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ২০১৫ সালের প্রকাশনায় ঢাকার রিকশা জায়গা পেয়েছে। কিন্তু রিকশার মতো একটি মধ্যযুগীয় অমানবিক যানবাহন একবিংশে এসেও মেগাসিটিতে বড় জায়গা দখল করে থাকছে, এটা মানা যায় না। সরকার জেগে জেগে ঘুমায় বিধায় আপনি আমি মানি বা না মানি বাংলাদেশ থেকে প্যাডেল চালিত রিকশা চিরবিদায় নিয়েছে শুধু ঢাকা শহর ছাড়া। আমি বাজি ধরতে পারি চলমান সরকারি ঘুম অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ঢাকায়ও ৯০% প্যাডেল চালিত রিকশা বিদায় নিবে। কেননা সারা দেশেই রিকশার জায়গা দখল নিয়েছে ইঞ্জিন চালিত রিকশা ও অটোবাইক। ঢাকা শহরে বর্তমানে অবৈধ হলেও প্রায় ২৫% (ব্যক্তিগত ধারণা) রিকশা এখন ইঞ্জিন চালিত। অমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন মেয়র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকার বলছে কোন অবস্থাতেই ব্যাটারি চালিত যানবাহনের অনুমতি দেওয়া হবে না, কোন কোন পৌরসভা নিজেদের আয় বৃদ্ধির স্বার্থে ব্যাটারি চালিত যানের নিবন্ধন দিলেও তা অবৈধ এবং ধরা পড়লে মেয়রগিরি হুমকিতে পড়বে। কিন্তু প্রয়োজন আইন মানে না। মফস্বলে ১০০ টাকা রিকশা ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে তাকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হাঁটতেই হবে। কোন বিকল্প নেই। কিন্তু ব্যটারি চালিত রিকশা বা অটোতে সে ৫ টাকায় ওই পথ যেতে পারছে। সময়, শ্রম, অর্থ সবই সাশ্রয় হচ্ছে।
একই কারণে শেয়ার রাইডিংও জনপ্রিয় হচ্ছে এই শহরে। বিদ্যুতের অপব্যয় কমানোর জন্য সরকারের এমনতর সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিদ্যুতের চরম সংকটময় দিন তো এখন অতীত। সরকারের এই জাগ্রত নিদ্রার কারণে ৭০ হাজার টাকার অটো বিক্রি হয় ১ লাখ ৭০ হাজারে। ব্যাটারিতে ইলেকট্রিক চার্জ দেওয়া অবৈধ হওয়ায় প্রায় শতভাগ ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া হয় অবৈধভাবে। একটি ব্যাটারিতে একবার চার্জ দিতে রিকশাওয়ালা থেকে গ্যারেজ মালিক নেয় ১০০ টাকা যার ৫০ টাকা যায় বিদ্যুৎ কর্তাদের পকেটে, বাকীটা গ্যারেজ মালিকের। ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের রিকশার নিবন্ধন আছে ১ লাখেরও কম। ৩ দশক ধরে নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ কিন্তু ঢাকা শহরে রিকশা চলে প্রায় ১২ লাখ যাদের নিবন্ধন দেয় ৩০টি অবৈধ সংগঠন যে ধান্ধা রিজেন্ট সাহেদও করেছে। ব্যাটারি চালিত যান কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, অবৈধ বলে টেকসই বাহন তৈরিতে কেউ আগ্রহ দেখায় না। এরা রাস্তায় বের হলেই পুলিশ, ট্রাফিক ও চাঁদাবাজদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সারাদেশ এই রিকশা বা অটো শ্রমিক আছে প্রায় ১ কোটি। এই ১ কোটি লোকের জীবিকা নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা দ্রুত বন্ধ হওয়া দরকার। করোনাকালে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, রাস্তার রংবাজদের দৌরত্ব বন্ধ এবং নিম্নআয়ের মানুষের যোগাযোগ ব্যয় কমানোর স্বার্থে অবিলম্বে সংক্ষিপ্ত নীতিমালা করে ব্যাটারি চালিত রিকশা বা অটোবাইকসমূহকে বৈধতা দেওয়া উচিৎ।
একটি কথা আমাদের মনে রাখা উচিত ওয়াকম্যান, পেজার, ডিভিডির মত ইঞ্জিন রিকশাও অন্যান্য ঠুনকো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ন্যায় সীমিত সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যেতে বাধ্য কিন্তু করোনাসৃষ্ট কর্মসংস্থান সংকটে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যাটারিচালিত যানের বৈধতা দেয়া খুবই জরুরি
০৬
এক কর্মচারী তার বসকে বললো, ‘স্যার ৫টার পর আর অফিস করতে পারবো না।’ “কেন?” ‘স্যার বউয়ের চাকুরী নাই, বউ দিনে ভ্যানে সবজি বেঁচে, সন্ধ্যার পর ওই ভ্যানে আমি ফল বেচবো।’ “গুড রাত ৮ টার পর দয়া গঞ্জের মোড়ে আইসো, আমিও ডিম পরোটা বেচি।”
দেশে হকারের সংখ্যা কত- জানি না, তবে সংখ্যাটা ১০ লাখের কম নয়। কয়েক মাসের লকডাউনে (সাধারণ ছুটি) সব ফুটপাত হকার মুক্ত ছিল। পেশাদার শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অনেকরেই আয় বন্ধ হয়ে গেছে; ছোট চাকুরীজীবী অনেকেই চাকুরিচ্যুত হয়েছে। ফলে লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ১০ লাখ হকারদের অনেকেই আর ব্যবসায় নামতে পারেনি। সে জায়গায় এসেছে সদ্য কর্মহীন অনভিজ্ঞ হকার- যাদের ছদ্মবেশী হকারও বলা যায়। কয়েকজন হকারের সাথে কথা বলে বুঝলাম নয়া ছদ্মবেশী হকাররা সামান্য পুঁজি নিয়ে ফুটপাতে বসলেও অনভিজ্ঞতার কারণে তারা শেষ মূলধন বা ধার করা টাকাটা লস করে অনেকই হকারী কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে থানা পুলিশ। এই করোনা যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে পুলিশ এবার অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছে যার সিকিভাগও প্রত্যাশা করেনি জনগণ। জন্ম থেকেই পুলিশের নানা অনিয়মের কারণে জনগণ প্রতিপক্ষ ভেবেছে পুলিশকে। কিন্তু এই করোনাকালে পুলিশের অসাধারণ ভূমিকার কারণে জনগণ সবকিছু ভুলে পুলিশকে এখন বন্ধু মনে করছে। তাই ফুটপাতে পুলিশের উৎপাত নিয়ে কিছু বলতেও সংকোচ হচ্ছে। ফুটপাতে রংবাজী বা পেশীজীবীদের দৌরত্ব এখন নেই বললেই চলে তবু প্রি কোভিড সময়ে প্রতিটি সাধারণ ভ্যান বা ফুটপাতের সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হতো প্রতিদিন ৫০ টাকা, অস্থায়ী অবকাঠামো বা দোকান থাকলে ১০০ টাকা। করোনা দুর্যোগে রেট দ্বিগুণ হয়ে ১০০ ও ২০০ হয়েছে।
দেশপ্রেমিক পুলিশ বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি করোনাকালীন দুঃসময়ে ফুটপাত থেকে সকল প্রকার ‘তোলা’ তোলা বন্ধ করুন, মানুষ আরও বেশি দোয়া করবে আপনাদের
বর্তমান সরকারের সময় সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরে। ব্যাংক ডাকাতিতে ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের, প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম, ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত পরোক্ষভাবে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতের বাইরে নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলো আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এরা বিভিন্ন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর প্রতি মানুষের এক ধরণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া আরেকটি সেক্টরে ডাকাতি হয়েছে ব্যাংক ডাকাতির চেয়েও বেশি যার ভুক্তভোগী সরাসরি নিম্ন আয়ের জনগণ, যাদের নিয়ে কেউ আলোচনা করেনা।
মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, মাল্টি লেভেল মাকেটিং কোম্পানি, অখ্যাত উন্নয়নের বুলি আওড়ানো নানা এনজিও এবং অজস্র নিবন্ধনকৃত ও নিবন্ধনহীন সমিতি, যারা শতকোটি টাকা নিয়ে ওয়ান ফাইন মর্নিং সাইনবোর্ডসহ উধাও হয়ে যায়। যে টাকাগুলো একেবারেই খেটে খাওয়া মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয় যা কখনই ফিরে পায়নি কেউ
বাংলাদেশের বিভিন্ন হাট-বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফুটপাতের দোকানী একজনও পাওয়া যাবে না যে কোন না কোন সমিতির সদস্য নয়। এর বাইরে কোটচাঁদপুরের কাজল বাহিনী তো আছেই যারা পাঁচ এ চল্লিশ বা বছরেই দ্বিগুণ হওয়ার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে অতীতে। কয়েকটা মাল্টি লেভেল মার্কেটার ধরা পড়লেও বাকী ধান্ধাবাজরা সবাই প্রায় গা ঢাকা দিতে সফল হয়েছে। এখনও যে সমস্ত সমিতিগুলো ক্রিয়াশীল তাদেরকে কঠিন মনিটরিংয়ে রাখা দরকার।
বর্তমান ‘নিউ নরমাল’ সময়ে মানুষ বিনিয়োগের জন্য কোন ক্ষেত্রগুলোকে বেছে নেবে, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তার যথেষ্ঠ সুযোগ আছে
০৭
ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সবদেশই সবকিছুতে বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে চেষ্টা করবে। কনসাস ও স্মার্ট লিভিং-এ জীবন-যাপন যেহেতু সাশ্রয়ী ও বাহুল্য বর্জিত হবে তাই প্রি কোভিড আমলের চাহিদা পত্র পোস্ট কোভিডে এসে সংকুচিত হবে পাশাপাশি সম্প্রসারিত হবে ডিজিটাল প্রোডাক্টের বাজার। তাই আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশীয় পণ্য উৎপন্ন ও ব্যাবহারে সবার উদ্যোগী হতে হবে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই বিদেশী পণ্য বর্জন করে, স্বদেশী পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে আমাদের। আমরা চাইলে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ কে একটা অনন্য গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত করতে পারি। আমরা পড়ে আছি গার্মেন্টস নিয়ে, যার মূল উপাদানই আমাদের নেই এবং অদূর ভবিষ্যতেও তুলা উন্নয়ন বোর্ড কোন সাফল্য দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের প্রাকৃতিক ফসলভান্ডার ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও ঐতিহ্যবাহী। সমুদ্রপথ আবিষ্কার হওয়ার অনেক আগ থেকেই ঐতিহাসিক সিল্করোড দিয়ে আমাদেরই মসলা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করেছে ভিনদেশীরা। মশলাযুক্ত ভারতীয় রান্নার প্রতি পশ্চিমারা গত কয়েক শতাব্দী ধরে নাঁক সেঁটকালেও করোনা এসে ইমিউনিটি বাড়াতে সবাইকে ভারতীয় রন্ধন পদ্ধতি অনুসরণের উপদেশ দিচ্ছে।
রাষ্ট্রের উচিত দেশে মসলা চাষে যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর সাথে আমাদের অনেক উন্নতমানের ফল আছে যা মানে ও দামে বিশ্বসেরা, যেমন কলা, আনারস, কাঁঠাল, টমেটো, আম, পেঁপে, আমড়া, পেয়ারা। আছে নানা প্রজাতির বৈচিত্র্যময় সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ, ছোট্ট দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন মৎস্য চাষে বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ খাবার এখন প্রক্রিয়াজাত। তাই আমাদের হরেক রকমের ফল ও মৎস্য উপযুক্তভাবে প্রসেসিং করে অসাধারণভাবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বিশ্বময় ব্র্যান্ডিং করতে পারি
ডিজিটাল প্রোডাক্টের সম্ভাবনাও অপার আমাদের দেশে। আমাদের ডেনসিটি ও পশ্চাৎপদতা বাংলাদেশকে ডিজিটাল পণ্যের সবচেয়ে সাসটেইনেবল বিগ বাজারে পরিণত করবে। মোবাইলের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে।
এক বর্গ কিলোমিটারে কানাডাতে ১০০ জন ইউজার পেলে তার ৯০ শতাংশই কোন না কোম্পানির সেবা গ্রহণ করছে আর বাংলাদেশে ওই পরিমাণ জায়গায় ইউজার পাবে সহস্রাধিক যার পুরোটাই ভার্জিন
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের ১ম প্রজন্ম তাদের প্রায় সিংহভাগ মেধাবীদেরই ব্রেইন ড্রেন হয়েছে। যেমন আমার ঢাকা কলেজ-৯১ ব্যাচের প্রায় শতাধিক সহপাঠী বুয়েটের ছাত্র ছিল এবং এরমধ্য থেকে প্রায় ৯৫ ভাগই এমএস বা হায়ার ডিগ্রি নিতে প্রবাসী হয়েছে যারা আর দেশে ফেরেনি। এরা সবাই বিভিন্ন টেকনোজায়েন্টে উচ্চপদে আসীন। রাষ্ট্রের সময় এসেছে তাদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানানোর। চায়নার উন্নতির একটা বড় কারণ তারা তাদের মেধাবীদের রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশ থেকে স্কলার বানিয়ে আবার দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। আর আমরা মেধাবীদের পিছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাই, তারা প্রবাসী হয়ে আর ফিরে আসে না, যারা দেশে থাকে, তারা আবার বিসিএস প্রশাসনে চান্স পেলে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান চিরতরে বাক্সবন্দী করে রাখে স্রোতে ভাসায়। ৪র্থ বিপ্লবে অবস্থান কোন সমস্যা নয়, তার উপরে রয়েছে অবারিত ডিজিটাল ফিউচার। সুতরাং রাষ্ট্রের উচিৎ তাদের ফিরিয়ে এনে দেশে থেকেই যেন প্রবাস ফেরত মেধাবী পেশাজীবীরা ৪র্থ বিপ্লবের ট্রেনে উঠতে পারে সেই ব্যবস্থা করা, কেননা ডিজিটাল প্রোডাক্টের এত বড় বাজার বিশ্বে কোথায়ও খুঁজে পাবে না কেউ।
কলোনিয়াল আমলাতন্ত্রের আপাদমস্তক সংস্কার করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক ও সেবাধর্মী ই-গভর্নেন্স বাস্তবায়ন করতে হবে। অবিলম্বে প্রশাসনের জন্য “আইটি ক্যাডার” তৈরির আয়োজন করতে হবে
কোভিডের ঢেউয়ে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্যুরিজম ও এমিউজমেন্ট সেক্টর, যথা এভিয়েশন, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। এই ঢাকা শহরেই গত ১০ বছরে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জোয়ার এসেছিল। আন্তর্জাতিক মানের অনেক রেস্টুরেন্ট, ফ্র্যাঞ্চাইজি, বিদেশী খাবারের দোকান অসংখ্য গড়ে ওঠেছিল। একসাথে প্রায় অর্ধশত ফাইভস্টার রেস্টুরেন্ট চালু হতো আগামী ২/১ বছরে, এদেরে ভবিষ্যৎ এখন অজানা। ট্যুরিজম ও রেস্টুরেন্টে ব্যবসায় উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি বিশাল কর্মসংস্থান হয়েছিল নিম্ন আয়ের মানুষের। বিশাল মধ্যবিত্তের বড় অংশ উচ্চ মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস এসে সব এলোমেলো করে দিল। আগামী ১০ বছরে নতুন করে কেউ রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করবে বলে মনে হয় না। এখন আর কেউ সপরিবারে হ্যাংগআউট করতে অদূরের কোন রিসোর্ট বা রেস্টুরেন্টে যায়না। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাচ্ছে ফুড পান্ডা। তবে ডিজিটাল প্লাটফর্ম হওয়ায় অনেকে ঘরে তৈরি খাবারও অনলাইনে বিক্রি করছে। আশার কথা আভ্যন্তরীণ পর্যটনের হয়তো পরিধি বাড়বে। নিউ নর্মালসি মাথায় রেখে নয়া ট্যুরিজমের অবকাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে।
আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা টাকা পাচার। এটা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা সরকারেরও কম। তবে বিদেশী বিনিয়োগের স্বার্থে ও দেশের বাইরে গিয়ে টাকা উড়ানো বন্ধ করতে ফাইভস্টারগুলোতে এক্সক্লুসিভ এমিউজমেন্ট জোন করা উচিৎ। যেখানে শুধুমাত্র ফরেনার, ফরেন ইনভেস্টার ও তার লোকাল এজেন্ট ও কার্ডধারী সিআইপি ও বিগ ট্যাক্স পেয়ারদেরই প্রবেশাধিকার থাকবে। কোন অবস্থাতেই দেশের সংস্কৃতিতে যেন তার প্রভাব না পড়ে তেমন সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু এমিউজমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলা উচিত।
এছাড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা অপার সুযোগ আছে দেশে। বুয়েট-পলিটেকনিক-ধোলাইখাল এই তিনটির যুতসই মেলবন্ধনের মাধ্যমে উৎকর্ষসাধন করা গেলে ২০ কোটি লোকের বিশাল লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাজার আর আমদানি নির্ভর হবে না নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারবো। আর যদি আমাদের মেধাবী সোনার ছেলেরা দেশে ফিরে আসে তবে হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং, সফসটিকেটেড ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়ো প্রোডাক্ট, আইটি প্রোডাক্ট নিজেদের জন্য বানিয়েই দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
০৮
অনেক দিন ধরেই বিশ্বাস করি নগর কর্তৃপক্ষ চাইলে শুধু ঢাকা নয় দেশের সকল শহরকেই ধুলোমুক্ত শহর করা সম্ভব
নিউ নরমালসি সেই বিশ্বাসে সাহস জুগিয়েছে। প্রি-কোভিড আমলে অনেকেই এটাকে পাগলের প্রলাপ বলে মনে করতো। করোনা এসে আমাকে সাহস যুগিয়েছে। পরিবেশবিদরা করোনা অতিমারিকে বলছে প্রকৃতির বিদ্রোহ বা ওয়েক আপ কল। এবারও ঘুম না ভাঙলে সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।
১২ হাজার বছর আগে শুরু হওয়া কৃষি বিপ্লব থেকে ১৭ শতকের শিল্প বিপ্লব মানুষের চাহিদাকে সীমাহীন করে তুলেছে। সবকিছুর যোগান পেতে নির্ভরতা বাড়ছে প্রকৃতির ওপর আর এতেই প্রকৃতির ভাণ্ডার শূন্য হয়ে পড়ছে। প্রকৃতি বিরূপ হচ্ছে, প্রকৃতির রুদ্ররূপ প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষ তার অন্তহীন ক্ষুধা নিবারণে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রকৃতির মালিক বিবেচনায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। মানুষের অসীম সৃজনশীলতা তাকে দায়বদ্ধ না করায় সে গন্তব্য নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতি হয়েছে রুষ্ট। আজ দাম্ভিক সভ্যতা মানুষের জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে প্রায় ব্যর্থ। পুঁজিবাদের ধারায় ভোগবাদের তাড়নায় মানুষ বুদ্ধি আর বাহুবলে ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকৃতিকে শোষণ ও লুণ্ঠন করেই যাচ্ছে। সেই আইয়ুব খানের আমল থেকেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের সকল ছোট নদী ও খালগুলো থেকে কৃষিজমি ও গ্রাম বাঁচানোর জন্য অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বাধ নির্মাণ হয়েছে ও ওয়াপদা দিয়ে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় সকল খাল এখন নর্দমায় পরিণত হয়েছে, কোন খালে এখন আর স্রোত নেই, নৌকা চলে না। আগে প্রতিটি গ্রামের সাথে আন্তঃযোগাযোগ ছিল নৌ পথে যা এখন শতভাগ বন্ধ। কয়েক দশক ধরে স্লুইস গেট নির্মাণের হিড়িক পড়লো, নৌযান না চললেও যেন পানি প্রবাহ থাকে অথচ সব স্লুইস গেট এখন অকেজো। যাদের বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলে তারা জানে কী নির্মমভাবে খালগুলোকে হত্যা করা হলো।
অথচ শিকারি যুগে শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ ছিল। প্রতিদিন মানুষ কয়েক ঘণ্টা পরিশ্রম করে যে খাদ্য সংগ্রহ করত তা সবাই ভাগ করে খেয়ে ফেলত, খাদ্য মজুদ করার যেমন চিন্তা ছিল না, ঠিক তেমনি অন্যের উৎপাদিত খাদ্যে ভাগ বসানোর মতো পরজীবী মনোভাবও মানুষের ছিল না। করোনাভাইরাস মানুষকে অনেকটা সেই পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব পরিবেশে দুষণমুক্তির সুবাতাস বইছে। জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমার ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমে গিয়েছে। করোনাকালে মানুষের চাহিদা ও মোবিলিটি নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শিল্প কারখানা, বিমানচালনা, পরিবহন কমে যাওয়ায় বায়ু-মাটি-পানিদূষণ কমেছে। জীববৈচিত্র্যের বিচরণ ক্ষেত্রে নির্মল হয়েছে।
আগামীর পৃথিবীতে মানুষ তার অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি অমূল্য জীবনের অধিকাংশ সময়টি অর্থ উপার্জনের মত একটি ক্ষুদ্র কাজে ব্যয় করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। পৃথিবীতে কর্মসংস্থানের গুরুত্ব একদিন অনেকটাই কমে আসবে
করোনা আমাদের প্রচলিত প্রায় সকল সোশ্যাল টার্মোলজির প্যারাডাইম শিফট করে মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করছে আর এই পরিবর্তিত কাঠামোতে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আরও প্রকৃতিবান্ধব নিউ নরমাল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এখন যদি নগর কর্তৃপক্ষ “আরবান কনস্ট্রাকশন, ট্রান্সপোর্টেশন ও বিজনেস গাইডলাইন” তৈরি করে নগরের সকল উন্মুক্ত জায়গায় ঘাস ও কনক্রিট দিয়ে কাভার করে, ধুলোমুক্ত নগরী উপযোগী “নাগরিক আচরণ নীতিমালা” প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে পারে তবে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের সকল শহরকে ধূলামুক্ত করা সম্ভব। করোনার এই ‘ওয়েক আপ কলে’ মানুষ জেগে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস।
শেষ করছি ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে। একটা ফাইভস্টার হোটেলের বুফে। বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মানের, হাজার প্রকার খাবার আছে। একজন মানুষ ক’টি আইটেমই বা খেতে পারে? সে তার প্রয়োজনীয় কিছু আইটেম পরিমিতভাবে নিবে, এটাই স্বাভাবিক। সচেতন মানুষ মাত্রই হা-ভাতে ক্ষুধার্ত মানুষের মত কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে অপরিমিত খাবার খেয়ে নিশ্চয়ই অসুস্থ হওয়ার রিস্ক নেয় না। কোভিড-১৯ আমাদের সামনে তেমনি সংকটের বিপরীতে যে অসীম সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে দিল- তা ওই ফাইভস্টারের বুফের মতোই। আমরা তা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস, কীভাবে কতটুকু নেব তার উপরই নির্ভর করবে আমাদের অনাগত আগামী। দিনশেষে আমি আশাবাদী- আলো আসবেই।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সংস্কৃতিকর্মী