কারিগরি শিক্ষার রকমফের
৩০ জুলাই ২০২০ ১৯:৫৬
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ডিপ্লোমা শিক্ষায় বয়সের বাধা তুলে দেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রীর এই মতামত নিয়ে সংশ্লিষ্টজনেরা আলোচনা শুরু করেছেন। ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। এসএসসি পাস করে চার বছর মেয়াদি কোর্সে ভর্তি হতে হয়। বয়সের বাধা তুলে দিলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিষয়ে যারা মতামত দিচ্ছেন তাদের ধারণা খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ, যা এই শিক্ষার প্রসার ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে রীতিমতো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শুরুতে দুটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। এক. ডিপ্লোমা কোর্সে বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রীর মতামত মাত্র, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আপত্তিও জানিয়ে রেখেছে। দুই. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দু’টি ধারা বিদ্যমান। ট্রেড কোর্স ও ডিপ্লোমা কোর্স। ট্রেড কোর্সে দুই থেকে ছয় মাসের স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ কারিগর গড়ে তোলা হয়, যারা পরে শ্রমবাজারে কাজ করেন। আর ডিপ্লোমা কোর্সে প্রকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রচলিত অর্থে কারিগর বা টেকনিশিয়ান নন।
এখন দেখা যাক শিক্ষামন্ত্রী বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার বিষয়টি কেন বলেছেন। কারিগরি শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বলছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের একটা অংশ ভবিষ্যতে হয়তো দেশে ফিরবেন। অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে এবং আধা দক্ষদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শিক্ষামন্ত্রীও একই রকম কথা বলেছেন। মূলত যে কারণে শিক্ষামন্ত্রীর এই ইচ্ছা সেটা হচ্ছে, কোভিড-১৯-এর কারণে অনেক প্রবাসী কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরবেন বা ইতিমধ্যে ফিরেছেন, তাদেরকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করা। পরিকল্পনাটা চমৎকার। কিন্তু প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে।
বলা হচ্ছে, ডিপ্লোমা কোর্সে বয়সের বাধা তুলে দেওয়া হবে। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছরের। ডিপ্লোমা পাশ করার পর ক্ষুদ্র একটা অংশ আরও চার বছরের বিএসসি কোর্সে ভর্তি হয়, একটা অংশ চাকরি পায় এবং অনেকেই বেকার থাকে। কেউ কেউ নিজস্ব দক্ষতা-সংশ্লিষ্ট নয় এমন কাজ বেছে নিতে বাধ্য হন। ঢাকার মালিবাগে একটা অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তারক্ষীকে আমি জানি, যিনি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। এরকম অনেককেই পাওয়া যাবে আমাদের চারপাশে।
কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান সম্প্রতি একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, ডিপ্লোমায় প্রতিবছর অনেক আসন খালি থাকে, বয়সের বাধা তুলে দিলে আসন পূর্ণ করা যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আসন খালি থাকে কেন? কারণ, ডিপ্লোমা কোর্সে উপযোগিতা আনয়নের জন্য কার্যকর কোনো পরিকল্পনা ও সমীক্ষার ব্যবস্থা নেই।
সিঙ্গাপুরে ডিপ্লোমায় ছাত্র ভর্তি করা হয় সমীক্ষার ভিত্তিতে। ধরুন, সিভিল বিভাগে এক হাজার আসন আছে। তারা আগে সমীক্ষা করে বের করে, পাশ করার পর এদের চাকরির বাজারের পরিস্থিতি কী হবে। সে অনুযায়ী তারা ভর্তি করায়। প্রয়োজনে আসন খালি থাকে। আর আমাদের দেশে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ছাত্র ভর্তি করানো হয়। ফলাফল বেকারত্ব। দেশে চাকরির বাজার সীমিত, বিদেশে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট তাঁরা কাজে লাগাতে পারেন না। অনেকের ধারণা, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা ভালো বেতনে চাকরি পান। ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কিছু একটু ফাঁক আছে। সিঙ্গাপুরে কর্মরত আমার কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বাংলাদেশের কোনো ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সিঙ্গাপুরে গিয়ে তার সনদ অনুযায়ী চাকরি পান না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওখানে গিয়ে সবাইকে নতুন করে ন্যাশনাল ট্রেড সার্টিফিকেট (এনটিসি) অর্জন করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন এসএসসি পাশ বাংলাদেশির সঙ্গে ডিপ্লোমা পাশ বাংলাদেশির কোনো পার্থক্য থাকে না। জাপানেও সেরকম। তবে ওসব দেশে ডিপ্লোমা সনদ দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরে গিয়ে যারা এনটিসি করেন না তারা ওই দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে শর্ট কোর্স করে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন।
ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা করা আমার আরেক ছাত্র সিঙ্গাপুরে গিয়ে এনটিসি না করতে পারায় ওখানে পাইপ ফিটিংয়ের কাজ পেয়েছিলেন। হতাশ হয়ে সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে এসেছেন।
এই যখন অবস্থা তখন বয়সের বাধা তুলে দিয়ে সবাইকে ডিপ্লোমায় সুযোগ করে দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে সেটা চিন্তার বিষয়। আর ওই বয়সী কর্মীরা চার বছরের জন্য আবার ছাত্রত্ব বরণ করবেন কি না তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
তবে বয়সের ব্যাপারটা স্বল্পমেয়াদী ট্রেড কোর্সে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা দক্ষ কারিগর হয়ে উঠতে পারবেন। অবশ্য সরকার চাইলে বয়স্ক শিক্ষার্থীদেরকে ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েট বানাতেই পারে। সে ক্ষেত্রে পলিটেকনিক কেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিকল্প তো রয়েছেই।
আমরা কারিগরি শিক্ষার হার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, কী বাড়ানো দরকার, কারিগর নাকি প্রকৌশলী? ট্রেড কোর্স করা কারিগর আর ডিপ্লোমা কোর্স করা প্রকৌশলীর মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সেটা হয়তো আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এটা বোঝা জরুরি।
লেখক: ননটেক বিভাগের শিক্ষক, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট