চামড়া শেষ; আমড়ায় বাম্পার
২ আগস্ট ২০২০ ১৫:০১
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবারও যে বিপত্তি-নৈরাজ্য ঘটবে, তার আলামত ছিল আগেই। গত ২৬ জুলাই সরকারের কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ঠিক করে দেওয়ার দিনই আঁচ করা যাচ্ছিল। এ সময় বলা হয়, এ বছর লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। অন্যদিকে সারাদেশে ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা এবং বকরির ১০ থেকে ১২ টাকা।
তখন আড়তদার বা ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে জোর গলায় কিছু বলা না হলেও তাদের মতিগতি ভালো ছিল না। তারা চাচ্ছিলেন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে নয়, আরও কমে, পারলে পানির দামে চামড়া হাতাবেন। বাস্তবে সেটাই হলো। দাম না পাওয়ার কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল কোরবানি দেওয়া মানুষের মধ্যেও। বিক্রির অপেক্ষায় না থেকে তারা চামড়া দান করে দিয়েছেন মাদ্রাসা ও এতিমখানায়। ঢাকার কোনো কোনো এলাকায় চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়ী পা-ও মাড়ায়নি। এছাড়া, করোনা ভাইরাস এবং অর্থনৈতিক মন্দাও তাদের অনীহার কারণ। চামড়া কিনে লোকসানে পড়ার চেয়ে তাদের কারো কারো কাছে আমড়া ব্যবসা বেশি লাভজনক। ঝুঁকিমুক্ত।
চামড়ার টাকাকে গরিবের হক বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। আবার প্রতিবছর কোররবানি দেওয়া লাখ লাখ গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ঋণ দেওয়া, সেল গঠনসহ অনেক কিছু শোনা গেলেও এগুলোর ভেতরের রহস্যে বড় গোলমাল। বছর কয়েক আগেও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পাড়া-মহল্লায় চামড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত। শুরু হত চামড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি। মারামারিও হত। কে কোন এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে চামড়া কিনবে তা নিয়ে টেন্ডারবাজির মতো বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যেত। তখন চামড়ার দামও ছিল প্রচুর। প্রতিটি গরুর চামড়া আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো।
গত দুই বছর ধরে তা ফিকে হয়ে গেছে। এ সময়ে তাদের অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ। হাতে গোনা যে ক’জন নেমেছে তারাও বড় সাবধানী। দেড় লাখ টাকার গরুর চামড়া তারা পারলে ২০০ টাকায় নিতে চায়। দুই লাখ টাকার গরুর চামড়া ৩০০ টাকার বেশিতে বিক্রি হয়নি ঢাকায়। চাহিদা না থাকার গল্প শোনানো হচ্ছে মানুষকে। চাহিদা না থাকলে ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া রফতানির বিরোধিতা করেন কেন? জবাব নেই এ প্রশ্নের। চামড়া কেনার জন্য সরকারের দেওয়া ঋণ কারা পেলেন, ঋণের টাকাটা অন্য কি কাজে খরচ হল, শোধ হলো কি-না? এসব প্রশ্ন তলানিতেই থেকে যায়। সামনে আসে না।
গত কয়েক বছর ধরে টানা কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এ ধরনের কাণ্ডকীর্তি চলছে। ঘটনা-রটনাও প্রচুর। কেউ কেউ সর্বশান্ত। কেউ লালে লাল। পকেট ভারি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লাভবানরাও হায়-হায় মাতমে একাত্ম। ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে তারাও দোষ পুরোটাই চাপায় সরকারের ওপর। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ ধাঁচে দায়ী করা হচ্ছে সরকারকে। দায়ী হতে হতে, দায় নিতে নিতে সরকারও যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে আরেক নদী ধলেশ্বরীর পাড়ে ২০১৭ সালে শেষ হওয়া ১৯৯ একর জমিতে চামড়ানগরীর এখন কী হাল? সেটাও অনেকের অজানা। বলা হয়েছিল, ট্যানারিগুলো পরিকল্পিত শিল্পনগরে এলে বুড়িগঙ্গা দূষণ থেকে বাঁচবে। আর পরিবেশ দূষণের অপবাদ ঘুচিয়ে চামড়া হবে ‘কমপ্লায়েন্ট’। বড় ব্র্যান্ডগুলোর আর বাংলাদেশি চামড়ায় তৈরি জুতা-ব্যাগ কিনতে কোনো দ্বিধা থাকবে না। চামড়া খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। কী হয়েছে বাস্তবে?
শ্রুতিতে চামড়ার কাছাকাছি শোনায় আমড়া। আর চামড়ার মৌসুমেই এবার জমে উঠেছে আমড়ার কারবার। এই কারবারিরা ভালোই আছেন শোনা যাচ্ছে। কারণ, আমড়া বাণিজ্যে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তার ওপর স্বাদ-পুষ্টিগুণের কারণে আমড়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। রোগবালাই কম। ফলনও এবার বাম্পার। এরইমধ্যে একটি অর্থকরী ফল হিসেবে জায়গা করে নেওয়ায় বরিশালের আশপাশের অঞ্চলে আমড়ার চাষাবাদ বেড়েছে। বিশাল অংকের লাভ গুনছেন আমড়া বাগানের মালিকরা। ব্যবসাটিতে এখনো ধুরন্ধরদের হাত পড়েনি। তাই চামড়া বা অন্য কয়েকটি পণ্যের মতো কাণ্ডকীর্তি শুরু হয়নি। তবে, হিমাগারের অভাবে আমড়া বেশিদিন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এটার একটা হিল্লে হবে আশা করা যায়। রাস্তার আশপাশে, বাড়ির সামনে-পেছনে অনাবাদি জায়গায়ও তেমন যত্নআত্তি ছাড়া থরে থরে আমড়া ফলছে। ঢাকা থেকেও বেপারিরা ছুটে যাচ্ছেন বরিশাল-পিরোজপুরের আমড়া গাছের মালিকদের কাছে। চৈত্র-বৈশাখ মাসেই আমড়ার গৃহস্থদের আগাম টাকা দিয়ে আসেন। চামড়ার বদলে এখন সেই আমড়া সংগ্রহ করে লঞ্চে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাইতে মহাব্যস্ত তারা।
লেখক-মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন