Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বুকে জ্বলে আশ্চর্য আগুন


৪ আগস্ট ২০২০ ১৯:১৩

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের খুনের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুল মাজেদের কবরের উপর এক ব্যক্তির লাঠি দিয়ে আঘাত করার ভিডিওটি আপনারা অনেকেই হয়ত দেখেছেন। এটি সাম্প্রতিক ঘটনা। এর আগেও ২০১০ সালে যখন বাকি খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হয় তখনও আপনারা অনেকেই দেখেছেন এইসব খুনিদের বাড়িতে জন সাধারণের জুতো নিক্ষেপ; তাদের কবরে আক্রমণ কিংবা বসতবাড়িতে হামলার ঘটনা।

এগুলো ছাড়াও কয়েকমাস আগেই ডা. জাফরুল্লাহ সাহেব একাত্তর টিভির একটি টকশোতে হঠাৎ করে বলে বসলেন প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা যেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিদের ক্ষমা করে দেন।

যে ব্যাক্তি খুনি আব্দুল মাজেদের কবরে জুতো বা লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন তিনি ঠিক কোন ক্রোধ বা মনের জ্বালা থেকে এই কাজ করছিলেন তা আমি জানিনা তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পাঁচটি রায় (দায়রা আদালতের প্রথম রায়, হাই কোর্ট ডিভিশনের দুই বিচারপতির প্রথম বেঞ্চ, ঐ একই ডিভিশনে একক বিচারপতির বেঞ্চ, আপিলেট ডিভিশনের পাঁচজন বিচারপতির রায় ও রিভিউ পিটিশনের রায়) এবং সাক্ষিদের জবানবন্দি ও জেরা এবং আসামিদের জবানবন্দি এসব সবকিছু পড়লে আপনার এক বাক্যে যেটা মনে হবে সেটা হচ্ছে-

‘কবরে জুতা দিয়ে আঘাত কেবল নয়, এদের মৃত্যুর পর যদি এদেরকে আবারো কবর থেকে উঠিয়ে আরও কয়েক হাজারবার শাস্তি দেয়া যেত, তবে সেটিও কম হতো হয়ত’

আমার উপরের এই মন্তব্যটিকে অত্যন্ত অশালীন কিংবা নিষ্ঠুর মনে হতে পারে প্রাথমিকভাবে। কিন্তু আমার এই মন্তব্যের কারণ জানতে হলে আপনাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা ভালো করে জানতে হবে, হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পড়তে হবে। এর পরই হয়ত আপনি আমার এই মন্তব্যের পেছনের যুক্তিটুকু নিয়ে একবার ভেবে দেখতে পারবেন।

এই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে লিখবো বলে আবারো নানাবিধ বই-পত্র নিয়ে বসেছি। যতবারই এসব পড়তে যাই এবং যতবারই প্রতিটি সময়ের ঘটনাগুলো জিগস পাজলের মত মেলাতে যাই ততবারই আমি মুষড়ে পড়ি।

১৪ আগস্টের খুনিদের রাত্রিকালীন প্যারেড থেকে ওইদিন দিবাগত রাতের অর্থ্যাৎ ১৫ আগস্টের কালো রাতের প্রতিটি ঘটনা এখন আমি ছবির মত আমার সামনে আমি দেখতে পাই। মনে হয় এইতো পাপা ব্যাটারির সব খুনীরা মাত্র রওয়ানা দিল, এইতো খুনী ফারুক ট্যাংকের ভেতরে ঢুকে রওয়ানা দিল। সবকিছু যেন চোখের সামনে স্পষ্ট করে ঘটে চলে। অনেকে আমাকে ‘আবেগতাড়িত’ বলে আখ্যা দিতে পারেন, কিন্তু আমি মিথ্যে বলছিনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত রায়গুলো বা বইগুলো ভালো করে পড়লে আপনার সামনেও সেদিনের রায় এক তীব্র হাহাকার নিয়ে উপস্থিত হবে।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, সেরনিয়াবাতের বাড়ি, শেখ মনির বাড়ি, পেট্রোল পাম্পের হত্যাকাণ্ড, মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের ১৪ জনের হত্যাকাণ্ড এইসব ঘটনা আপনাকে এক মুহূর্তে অসাড় করে দেবে। আপনার মনে হতে থাকবে এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ? এত? ঠিক এতটা? আপনি হিসেব মেলাতে পারবেন না। বিশ্বাস করেন, হিসেব মেলাতে পারবেন না।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার জেরাতে ১০ নাম্বার সাক্ষি মেজর জেনারেল (অবঃ) আব্দুর রবেরর সাক্ষ্য বা জেরার বিস্তারিত জানলে আপনি বিস্ময় নিয়ে বসে থাকবেন বেশ কিছুক্ষণ।

এই ভদ্রলোক সেনাবাহিনীর সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট ব্যাটেলিয়নের তৎকালীন অধিনায়ক ছিলেন এবং স্টেশন কমান্ডার লে. কর্ণেল আব্দুল হামিদ (বোধকরি ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা) ১৫ আগস্ট রবকে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থাকা সব লাশ দাফন করতে।

বঙ্গবন্ধুর লাশ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গি পাড়া নিয়ে যাওয়া হলেও পরিবারের বাকি সকল নিহতদের লাশ এই রব সাহেবই বনানী গোরস্থানে দাফন করে। কিভাবে দাফন করে জানেন?

লাশগুলো ঠিক যেভাবে রক্তমাখা ছিলো, যেভাবে অবহেলায় পড়েছিলো ঠিক সেভাবে জাস্ট কফিনে করে ভরে, ট্রাকের মধ্যে এনে কয়েকটা গর্ত খুড়ে সেখানে ফেলে লিটারেলি মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।

এই তথ্য আমি বানাইনি। খোদ দায়িত্বরত এই মেজর জেনারেল রব সাহেবের জেরাতে ও জবানবন্দিতে এই পুরো ঘটনা উঠে এসেছে। লাশগুলোর একটিরও জানাজা পড়ানো হয়নি এবং কোন কবরে কার লাশ এটিও শনাক্ত করে রাখেননি সেনাবাহিনীর এই অফিসার।

কেন রাখেননি?
তার ভাষায়, তাকে নাকি বলা হয়েছিলো যত দ্রুত পারা যায় লাশ ‘ডিসপোজ’ করতে হবে। এই লোকের ভেতরে সামান্যতম কোনো রিগ্রেট দেখা যায়না, সামান্য রিমোর্সফুলও হতে দেখা যায়না জেরাতে। সহজ গলায় সে বলতে থাকে, ‘আমাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমি তাই করেছি’।

অনেকেই হয়ত বলবেন, রব সাহেবের কি দোষ? সে নিজে নির্দেশ পালন করেছে। চেইন অফ কমান্ড। কিন্তু আমি না কোনোভাবেই এটা মানতে পারিনা। এমনকি খোদ আসামি পক্ষের আইনজীবিরাও তাকে সরাসরি ধরে বসেছে এই বলে যে, ‘আপনাদের সেনাবাহিনীর নিজস্ব মসজিদ ছিল, মেসের মধ্যে থাকা পরিষ্কার সাদা কাপড় ছিল কিংবা আরও কত উপায় ছিল সেদিন আপনার জন্য। কিন্তু করেন নি কেন?’
উত্তরে রবের কথা একটিই। ‘আমি উপরের নির্দেশ পালন করেছি’। তিনি আবার জেরাতে এটিও জানাচ্ছেন যে, ‘আমরা উপস্থিত ব্যাক্তিরা ব্যাক্তিগতভাবে দোয়া দুরুদ পাঠ করেছি।’
রব আবার যুক্তি দিচ্ছেন যে, সে সময় সামরিক আইন জারি ছিল, কার্ফু ছিল তাই ইমাম পাওয়া সম্ভব ছিলনা। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? চাইলেই এই অধিনায়ক সেদিন একজন মাওলানা সাহেবকে যে কোনো এলাকা থেকে ধরে আনতে পারতেন, মৃত লাশগুলোর প্রতি সামান্য সম্মান দেখাতে পারতেন।

সব কিছু যদি বাদও দেই, অন্ততপক্ষে কোন কবরে কে শায়িত হচ্ছেন এটির একটা চিহ্নও দিয়ে রাখতে পারত এই মেজর জেনারেল। কিন্তু তিনি এর কিছুই করেন নি। করবার ধারে কাছেও যান নি আসলে। আরও আছে। আরও অনেক ঘটনা আছে যা এই আগস্টে আমি একটি একটি করে লিখব।

কিন্তু আজকের লেখাটা লিখলাম শুধু এটুকু বলতে যে, শুধু খুনীরাই যে খুন করে চলে গেছে তা নয়। এই খুনের সাথে মৌনভাবে জড়িত ছিল আরও অনেক মানুষ। যাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়নি, যারা ভেতরে ভেতরে ঘৃণা পুষে রেখেছিল বঙ্গবন্ধুর উপর। এই বাংলাদেশে তারা বহাল তবিয়তে বেঁচে বর্তে মেজর জেনারেল পর্যন্ত হয়েছিলো। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোনদিন চার্জ গঠন করেনি। কেন করেনি, আমি জানিনা।

এই লেখার শুরুতে আমি যা বলছিলাম যে খুনিদের কবরে লাঠি বা জুতো দিয়ে আঘাত, কবর থেকে উঠিয়ে নেওয়ার দাবি কিংবা জাফর সাহেবের ক্ষমা করে দেবার গদ্গদ আহবানের কথা। খুনিরাতো এই দেশে একটা বিচারের মধ্যে দিয়ে দুই দশক পর্যন্ত সময় পেয়েছে ন্যায় বিচার চাইবার। হাজতে ডিভিশন পেয়েছে। তিনবেলা আহার পেয়েছে এবং ফাঁসি হওয়ার পর তাদের জানাজা হয়েছে। কোথায় কবর রয়েছে সেই নিশানা পর্যন্ত এই দেশে তাদের হয়েছে। দায়রা আদালতের জজ কাজী গোলাম রসূলের সময়ই এইসব খুনিরা সব রকম সুযোগ ও সুবিধা পেয়েছিল কারাগারে কিংবা বিচারের সময়। রাষ্ট্র ন্যায় বিচারের ক্ষেত্র থেকে কখনোই সরে আসেনি।

কিন্তু একবার চিন্তা করেন যারা সে রাতে খুন হলো তাদের কথা। ছোট্ট রাসেল কিংবা ছোট্ট সুকান্ত বাবু থেকে শুরু করে বাকিদের কথা। জানাজা, দোয়া, দুরুদ দূরের কথা। কার কবর কোথায় হয়েছে এটাই আমরা আজও জানিনা। কোনটা কার কবর নিশানা পর্যন্ত নেই।

আর জনাব জাফর সাহেব বলেন, ‘ক্ষমা’ করে দিতে। নিজের পোড়েনি, নিজের যায়নিতো, তাই বলা বড় সহজ। বলতে অনেক আরাম। একবার নিজের যেত, নিজের সবকিছু হারাত, সেদিন তিনি বুঝতে পারতেন ক্ষমা প্রদর্শন করা যায়, কি যায়না অথবা হারাবার ব্যাথা আসলে কেমন। ফলে খুনিদের কবরে একজন দুঃখক্রান্ত ব্যাক্তির জুতা দিয়ে আঘাত করা কিংবা লাশ উঠিয়ে ফেলতে চাইবার পেছনের ক্রোধ আর দুঃখটা তারা বোঝেন না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। অনুধাবন করতে পারি সেই ক্রোধের উৎস।

আপনি এই ঘটনাকে যতই নির্মম বা নিষ্ঠুর বলেন অথবা আমার এই মন্তব্যকে আপনি অযাচিত বলেন, আমি অনুরোধ করি শুধু তার আগে ১৫ আগস্টের ঐ চার স্থানের হত্যাকাণ্ডগুলোর পুরো বিবরণ আপনি পড়ে আসবেন। দেখবেন আপনার কাছে সেই জুতোর আঘাত করাটা আর অপরাধ লাগছে না।

১৫ আগস্ট খুনি আব্দুল মাজেদের নিঝুম মজুমদার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বন্ধবন্ধু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর