Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংগঠন ও স্বাধীনতা, কর্তৃত্ব নয় বন্ধুত্ব


৭ আগস্ট ২০২০ ২১:১৯

ডান- বাম দল নির্বিশেষে এদেশে এবং দুনিয়ার আরো অনেক দেশে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু বলা কিংবা ভিন্ন চিন্তা ও মত প্রকাশ করাকে দলের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে গুরুতর ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

রাজনীতিতে যেহেতু ক্ষমতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাই ক্ষমতার প্রশ্নে অপরাপর রাজনৈতিক দলের সাথে লড়াইয়ে অভ্যন্তরীণ মত-দ্বিমতের প্রকাশ বিবেচিত হয় প্রতিটি দলের দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে। অপরাপর শক্তির সাথে লড়াইয়ে নিজস্ব দুর্বলতা ঢাকতে দ্বিমত-ভিন্নমতের প্রকাশ রোধে সব দলের মধ্যে সাংগঠনিক নীতিমালার অভাবনীয় সাদৃশ্য খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। বস্তুত, দলের অভ্যন্তরে সব রকমের মত-দ্বিমত, তা সে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রশ্নেই হোক কিংবা দলের নীতি ও কৌশল নির্বাচনের প্রশ্নেই হোক; প্রায় সকলেই ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে কোনো না কোনো প্রকার কেন্দ্রীকতা অনুসরণ করেন। বামপন্থীরা এটাকে লেনিনীয় পার্টি নীতি অনুযায়ী “গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা” বলেন, অন্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতের ভিত্তিতে গৃহীত বলে এটাকে “গণতান্ত্রিক” প্রক্রিয়া নামে অভিহিত করেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু যে প্রশ্নগুলো সবসময়ই আমাকে ভাবিত করেছে তা হলো, রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া আসলে কতটা গণতান্ত্রিক? যাদের জন্য অর্থাৎ যে জনগণের জন্য এই সিদ্ধান্ত, তাদের মতামতের জন্য কোন রাজনৈতিক দল কবে, কখন, কোথায়, কিভাবে জনগণের কাছে গেছে? রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব সবসময়ই আশা করেছে জনগণ তাদের অনুসরণ করবেন, ভোট দেবেন এবং তারা হচ্ছেন সবচেয়ে অগ্রসর ও চিন্তাশীল এবং কল্যাণকামী অংশ। এই চিন্তার অন্তর্নিহিত ভাবনার মধ্যে কী জনগণকে ভেড়ার পালের অধিক বিবেচনা করা হয়? বিষ্ময়করভাবে, বর্ণিত প্রশ্নের সামনে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের চিন্তা ও পরিচালনার পদ্ধতি মোটামুটি অভিন্ন।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, পরিবার ও ব্যক্তি। মোটামুটি এই হলো উপর থেকে নীচে নেমে আসা সংগঠন কাঠামো। এর আবার অসংখ্য শাখা উপশাখা আছে। তবে সাধারণভাবে সবচেয়ে পুরনো এবং তলার সাংগঠনিক কাঠামো হলো পরিবার। আমাদের পরিবার কীভাবে চলে?

পরিবারের সবচেয়ে বয়োজোষ্ঠ্য সদস্যের সিদ্ধান্ত হলো পরিবারের সিদ্ধান্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনিই পরিবারের বেশিরভাগ সম্পদের মালিক অথবা সবচেয়ে বেশি উপার্জনক্ষম। পরিবারের জন্য তার অবদান হয়তো অন্যদের চেয়ে বেশি। পরিবারের সদস্যরা একত্রে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সকলে অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিবারের সদস্যরা একত্রে বসে একমত না হলে, সবচেয়ে বিবেচক ও অভিজ্ঞ সদস্যকে সিদ্ধান্ত দিতে বলা হয়। তিনি নিজ প্রজ্ঞা ও বিবেচনার সাথে অপরাপর সদস্যদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে সকলের মতামত ধারণের চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবারের সব সদস্য সবসময় একমত হতে পারেন না। পরিবারের মধ্যে মতানৈক্য ও মতবিরোধ দেখা যায়। পরিবার ভেঙ্গেও যায়। কিন্তু সকলেই একমত হবেন, পরিবারের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো পরিবারের জন্য মঙ্গলময় হয়ে ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চিন্তা ও মতের সাদৃশ্য পরিবারের স্থায়িত্ব ও ঘনত্ব নিশ্চিত করে। কিন্তু পরিবার পরিচালনা প্রক্রিয়ার জন্য ফরমান জারি করতে হয় না। কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ; এ বিষয়ে পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে এক ধরনের মতৈক্য। এবং তা-ই নিশ্চিত করে পরিবারের স্থায়িত্ব।

লেনিনীয় পার্টি নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যমান অপরাপর দলের চেয়ে কোন্ দল অনেক বেশি সততার সাথে সংগঠন পরিচালনা করছে, সে বিষয়টি নিয়ে এই আলোচনা নয়। কিন্তু খোদ লেনিনীয় নীতিটাকেই গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করি। কারণ তা অনিবার্যভাবে গড়ে তোলে পার্টি ব্যুরোক্রাসি। রাষ্ট্র সম্পর্কে যখন অভিযোগ তোলা হয় যে, রাষ্ট্র আমলাতন্ত্র নির্ভর, তা আসলে কাজের নয়। কারণ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সামরিক-বেসামরিক-দলীয় আমলাতন্ত্রের যুগপৎ ও ঐক্যবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ মারফত। ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক দল নিজস্ব পরিসরে যেভাবে পরিচালিত হয় তার সাথে মর্মবস্তুর দিক থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের কার্যত কোনো ফারাক নেই। কোন আমলাতন্ত্র কতটা বান্ধব, কতটুকু কার্যকর ও জোরালো তা তুলনা করা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, বরং আমরা সুস্পষ্টভাবে মনে করি তা গণতান্ত্রিক নয়। কারণ তা জনগণের নয়, জনগণের নিয়ন্ত্রিত নয়, জনগণ দ্বারা পরিচালিত নয় (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে “জনগণ” শব্দটির স্থলে “দলীয় সদস্য” শব্দদ্বয় পড়ুন)। সেদিক থেকে তা গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা ও চিন্তার প্রতিকূলে। এবং “মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ” এর কাম্য চিন্তা ও ধারণা অর্জনের পথে ভীষণ প্রতিবন্ধক।

উপরের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক, লেনিনীয় পার্টি অর্গানোগ্রাম গড়ে ওঠে উপর থেকে নীচে উল্লম্ব বা খাড়াভাবে। জনগণের মধ্যে শ্রমজীবী শ্রেণী, শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে অগ্রসর বলে দাবিদার কিছু সংখ্যক পার্টি সদস্য, কিছু সংখ্যক পার্টি সদস্য নিয়ে অজস্র বা অসংখ্য ক্ষুদ্র শাখা, তাদের ওপরের কমিটির ওপরে আরো উর্ধতন কমিটি, এবং সবার উপরে গিয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কমিটি, তার মাথায় প্রেসিডিয়াম এবং সবশেষে প্রেসিডিয়ামের মাথার মুকুট তার শীর্ষতম নেতা। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় শীর্ষে। তা অনুমোদন হয় জাতীয় সম্মেলন বা কংগ্রেস মারফত। এবং অবশ্য পালনীয় বিধি হিসেবে তা প্রযুক্ত হয় নিম্নতম কমিটিসহ সব পার্টি সদস্যদের জন্য। বস্তুত, আকৃতির দিক থেকে তা রুপ নেয় পিরামিডের। যেখানে হুকুমের মালিক কতিপয়, যারা অবস্থান করেন চূড়ায়। হুকুমের আজ্ঞাবহ নিম্নতম সকলে। এভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অধিকারের স্থলে এই পদ্ধতি কতিপয় তন্ত্রের রুপ নেয়।

বলা হয়ে থাকে, কোনো কোনো অনুরূপ দল তাদের দলের জাতীয় সম্মেলনের (কংগ্রেস) পূর্বেই দলের নীতি নির্ধারণী দলিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক দলিল দলের নিম্নতম স্তর থেকে উচ্চতম স্তরের মধ্যে আলোচনা করে। মতামত গ্রহণ করে। শেষে গিয়ে জাতীয় সম্মেলনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা গৃহীত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো নিম্নতম স্তরে প্রাপ্ত কোনো মত প্রতিটি বুনিয়াদি শাখা, থানা, উপজেলা স্তরে আলোচনার সুযোগ কী থাকে? যে দলিল বা দলিলাদি সারা দেশ ঘুরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ব্যাখ্যা করতে পারেন, অধঃস্তন সদস্য প্রদত্ত মতামত কী সেই একই সুযোগ পায়? জাতীয় সম্মেলনে পাঁচ মিনিটের বক্তব্য উত্থাপনের মাধ্যমে সেই সদস্য হয়তো তার মত প্রকাশের সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারেন। সারাদেশে প্রতিটি শাখায় অজস্র ঘন্টা ধরে নেতৃত্ব উত্থাপিত দলিলাদির বিপরীতে নিম্নতম শাখার ভিন্নমতের জন্য বরাদ্দ জাতীয় সম্মেলনের পাঁচ মিনিট। তাও তিনি জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থেকে সেই বক্তব্য উত্থাপনের সুযোগ পাবেন কী না নিঃসন্দেহ নয়।

তদুপরি, জাতীয় সম্মেলনের অজস্র দলিল পাঠ, অনুমোদন এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কী গণতন্ত্র প্রয়োগ করা যায়? যেমন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দল কর্তৃক ইশতেহার ঘোষণা হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোট প্রদানের মাধ্যমে বিজয়ী দল কর্তৃক ধরে নেয়া হয়, উক্ত ইশতেহার জনগণ অনুমোদন করেছে এবং একইসাথে তা প্রয়োগের জন্য তাদের রায়ও দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অজস্র অসংখ্য ইস্যুতে জনগণের জীবন্ত মতামতের প্রতিফলন কীভাবে হবে? জনগণের মতামত মোতাবেক দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার জন্য তাদের নেতৃত্বকে ফিরিয়ে আনার (Right to recall) সুযোগ কোথায়?

এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি পুনঃ পুনঃ সুন্দরভাবে, সুন্দর শব্দের সমাহারে মঞ্চায়িত নাটক, যাতে নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন, নেতৃত্ব সিদ্ধান্তের পক্ষে ম্যান্ডেট নেয়ার জন্য জনগণের রায় নেন এবং পাঁচ বছর ধরে জনগণের কাজ পর্যবেক্ষণ এবং পরিপালন। এই প্রক্রিয়া ঘাড়ের উপর মস্তিষ্ক বিশিষ্ট চিন্তাশীল কোনো সত্তা নয় জনগণ। তার নিজের চিন্তা ও মত প্রয়োগ করার কোনো ক্ষমতা নেই। জনগণ হলো হুকুমের অপেক্ষারত ভৃত্য। সবক্ষেত্রেই জনগণের স্থলে পার্টি সদস্য শব্দ যুগলের ব্যবহার করে অভিন্ন সিদ্ধান্তের বাইরে কী পৌঁছানো যায়?

আমরা সবাই জানি, জাতীয় সংসদে আইন পাশ হয়। সেই আইন রচনা করেন প্রধানত আমলাতন্ত্র। আমলারা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা মোতাবেক তা করেন। খুব অসাধারণ ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে জাতীয় সংসদের সদস্যরা সেই আইন অনুমোদন করেন। অতঃপর সেই আইন প্রযুক্ত হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যরা কী তাদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনগণের মতামত নিয়ে সংসদে উত্থাপন করেন। না, নিজের পার্লামেন্টারী সিটের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য দলীয় নেতৃত্বের অন্ধ অনুসরণ করেন? আমরা সবাই এই প্রশ্নের উত্তর জানি। অনুরূপভাবে, কোনো দল পরিচালনাকালে, দলীয় কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়নকালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা ও সাধারণভাবে শীর্ষ নেতাদের অনুগামী হন। কস্মিনকালেও পার্টির সাধারণ সদস্যদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোটা তাদের কাজের অংশ হয়ে ওঠে না। এভাবে গোটা প্রক্রিয়ায় একটি পার্টির সদস্যরা যেমন পার্টি আমলাতন্ত্রের নাট বল্টুর অধিক হয়ে উঠতে পারেন না, একইভাবে ভোট দিয়ে দেশের নেতা নির্বাচন করা জনগণের পক্ষেও নিষ্ক্রিয় দর্শক বা আদেশ প্রতিপালনের অধিক হওয়া সম্ভব হয় না।

এসব সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও পন্থা ও পন্থী নির্বিশেষে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জনগণের ভোট দেয়ার ক্ষমতা ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতৃত্ব কর্তৃক দল ও দেশ পরিচালনার নীতি; সাধারণ নীতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। উপরের আলোচনায় আমরা স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, কিভাবে এই প্রক্রিয়ায় আপামর মানুষ কর্তা হয়ে ওঠেনা। কর্তা হয়ে ওঠেন কতিপয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্যাস কী এমনই? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণ জীবন্ত সত্তা হয়ে কী তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে অক্ষম? সে কী কেবলই সিঁড়ি? কিংবা ক্ষমতা অর্জন ও ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার? মানুষের অজস্র বছরের ইতিহাস তার প্রতিধ্বনি করে না। একদল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অগ্রসর মানুষের উদ্যোগ ও চিন্তার মুখাপেক্ষী হয়ে সভ্যতা গড়ে ওঠেনি!

আমাদের জীবন-জীবিকা-ভোগ-উপভোগের আদিতম জ্বালানি খাদ্য। কৃষি যার মুল উৎস। লক্ষ লক্ষ মানুষ কোটি কোটি টন খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত। এই বিপুল সংখ্যার মানুষকে খাদ্য উৎপাদনের মতো এমন শৃঙ্খলাপূর্ণ উৎপাদন শিখিয়েছে কে? কোন সে অগ্রসর চিন্তকেরা, যারা এতো বিপুল সংখ্যক মানুষকে এমন সুশৃঙ্খলার সাথে খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত করেছে? না, তেমন কোনো একক বা বহু চিন্তক প্রয়োজন হয়নি। অজস্র মানুষ তাদের অযুত অভিজ্ঞতার পারষ্পরিক সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছে সম্মিলিত অভিজ্ঞতার ভান্ডার। তা দিয়েই তারা পরিচালনা করতে পারে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে জানে। এই সহস্রাব্দে মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার সেই ক্ষমতাকে কতিপয়ের কাছ থেকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনা। জ্ঞান বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উৎকর্ষের জটিল এক জগতে তা আদৌ কী সম্ভব? আমরা বলি, তা সম্ভব। মার্কস থেকে ধার নিয়েই বলি, মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা জগতটাকে পায়ের উপরে দাঁড় করানোটাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ও বাঁচার জন্য প্রয়োজন, তার প্রাণ ভোমরাটাকে রাক্ষসপুরী থেকে ছিনিয়ে এনে যথাস্থানে স্থাপন করা। যা কর্তা মানুষের কাজ। সে বিষয়েই আমরা পরবর্তীতে প্রবেশ করব।

সংগঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো নিয়ে আলাপে আমরা দেখেছি, উপর থেকে নীচে উল্লম্ব বা খাড়াভাবে নেমে আসে যে কাঠামো তা উর্ধতন আর অধঃস্তন এইভাবে গোটা কাঠামোটাকে তৈরী করে। এতে একদল ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত প্রণেতা। আর বিপুল সংখ্যক সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইনস্ট্রুমেন্ট। একদল হুকুম দেবেন, আর একদল তা প্রতিপালন করবেন। কিন্তু গোটা কাঠামোটি যদি আড়াআড়িভাবে প্রতিস্থাপিত হয়, তাহলে কেমন দাঁড়ায়? ধরুন আমরা যখন বন্ধুদের একটা ছোট বা বড় গ্রুপে কথা বলি, মতামত দেই, গ্রহণ করি, বর্জন করি, সবশেষে একটা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে (Consensus) উপনীত হই। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হয়, ততক্ষণ আলোচনা চলতে থাকে। কখনোবা বিভক্ত মত নিয়েও আমরা চলি। এখানে আদেশ-নির্দেশ-নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন হয় না। তবুও তাতে আমাদের বন্ধুত্ব খারিজ হয়ে যায় না।

ছোট বড় এই রকম অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু কোষের সমষ্টি হলো সংগঠন। যেখানে সদস্যরা তাদের মতামত তুলে ধরবেন। এসব মতামত আরো বড় পরিসরে উত্থাপনের জন্য তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। যে প্রতিনিধি সর্বাবস্থায় দায়বদ্ধ থাকবেন তার কোষ সংগঠনের সদস্যদের প্রতি। ব্যত্যয় হলে বা প্রয়োজন মনে করলে সেই কোষভুক্ত সংগঠনের সদস্যরা তাদের প্রতিনিধি পরিবর্তন করতে পারবেন, যেকোনো সময়। এরকম অজস্র কোষের মতামত যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে ধারণ করার জন্য উপযুক্ত প্লাটফর্ম তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে অবারিত। এসব অজস্র কোষের মতামত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিটি সদস্য তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। অজস্র কোষের মতামত প্রয়োগের জন্য, প্রচারণা ও আদান প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। এবং তাও সম্ভব একইভাবে।

প্রতিটি মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা এবং অপরের চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ, বর্জন ও আত্মীকরণের অবিশ্রান্ত মিথষ্ক্রিয়া গড়ে তোলে জীবন্ত সংগঠন। সে তখন একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের নাট বল্টু থেকে হয়ে ওঠে নির্মাতা। এভাবেই ভবিষ্যতের কাম্য সমাজের জন্য কাম্য সংগঠন তৈরী হতে থাকে। যারা একই সাথে তত্ত্ব নির্মাতা ও তত্ত্বের প্রয়োগকারী। যা মানুষ হিসেবে তার জৈব সত্তার সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল শক্তির উন্মোচন ঘটায়। সে হয়ে ওঠে ইতিহাসের অবজেক্ট থেকে সাবজেক্ট। এটা কী কষ্টকল্পিত কোনো ভাবনা? মানুষের ইতিহাস কী এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি।

আমরা নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক কাঠামোবিহীন (Leaderless movement) অনেক বড় বড় আন্দোলনের উদাহরণ দেখি। যেমন, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট, সিয়াটলে বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভ, এমনকি আমাদের দেশের শাহবাগ আন্দোলন, ভ্যাট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন। এর কোনে কোনেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠলেও সর্বক্ষেত্রে তা নয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তা ছিল আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ববিহীন। বস্তুত, ছোট ছোট অসংখ্য কোষ সংগঠনের সদস্যদের নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগে আন্দোলনের বিশাল অবয়ব দেখা দিয়েছে। যার প্রধান চিন্তা ও অংশগ্রহণের পুষ্টি যোগান দিয়েছে ব্যক্তি মানুষ।

গত শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে রাশিয়ায় গড়ে ওঠা সোভিয়েতগুলো ছিল এমন কোষ সংগঠনের অনন্য উদাহরণ। সোভিয়েতের প্রতিনিধি যারা মনোনীত হয়েছেন, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের সোভিয়েতের কাছে ফিরে এসেছেন করণীয় নির্ধারণ করতে। গত শতকের শেষ দশকে ‘Zapatistas’ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা যখন মেক্সিকোর সরকারী প্রতিনিধিদের সাথে শান্তি আলোচনা করছিলেন, তখন বিভিন্ন সময়ে আলোচনা মুলতবি করে বড় একটা সময় বিরতি নিয়ে ফিরে যেতেন তাদের আন্দোলনের তৃণমূল সদস্যদের কাছে। কারণ একেবারে তৃণমূলের প্রতিটি সদস্যের মতামত ব্যতিরেকে প্রতিনিধিরা এমন কোনো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না যে, তারা অর্থাৎ প্রতিনিধিরা সব সিদ্ধান্ত নেবেন আর তাদের সদস্যরা শুধু তা বাস্তবায়ন করবেন।

সুতরাং, রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী নিপীড়নের মুখেও সেই সংগ্রামের জনসম্পৃক্তি ছিল অসাধারণ। কুর্দি যোদ্ধাদের রোজাভা আন্দোলনের অভাবনীয় প্রতিরোধ ও সংগ্রামের অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস ও অনুরুপ। যদিও শেষ অবধি পরাজিত হতে হয়েছে, তবুও ইতিহাসে স্পেনের কাতালোনিয়ায় ১৯৩৬-৩৮ অবধি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার মুলে ছিল নৈরাজ্যবাদী বামপন্থীদের পরিচালিত শক্তিনালী ট্রেড ইউনিয়নসমূহ। সুতরাং, জনগণের দ্বারা, জনগণের নিয়ন্ত্রিত ও জনগণের পরিচালিত সংগঠন স্বপ্নজাত নয়, খুবই বাস্তব। এবং তা সম্ভব।

এদেশের মানুষের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে অপরিমেয় ত্যাগ ও লড়াইয়ের ঐতিহ্য আছে। উনবিংশ শতকের পটভূমিতে গড়ে উঠেছিল যে মুক্তি চিন্তা, তার ধারাবাহিকতায় এদেশের বামপন্থীরা নিরবচ্ছিন্ন লড়াই করে চলেছেন। ইতোমধ্যে জগত জুড়ে মানুষের ইতিহাসে সঞ্চিত হয়েছে অভূতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা। প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের এ কালে শতাব্দীব্যাপী অভিজ্ঞতার আলোকে বামপন্থার চিন্তার নবায়ন জরুরী। তত্ত্বের আগে “সৃজনশীল” শব্দ জুড়ে দিলেই, সৃজনশীলতা ধরা দেয় না। মানুষের এ যাবতকালের অভিজ্ঞতার নিরিখে মুক্তি আন্দোলনের দিশারীদের গণতন্ত্র-স্বাধীনতা-মুক্তি চিন্তাকে ধারণ করেই নতুন সহস্রাব্দের নতুন সংগঠন গড়তে হবে। যা ভবিষ্যতের কাম্য সমাজ গড়ে তুলতে বুনিয়াদি কাজ করবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সমাজ সমীক্ষা সংঘ

রাজনীতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর