Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব: নেপথ্যের নক্ষত্র


৮ আগস্ট ২০২০ ০০:২৯

রেণু হয়ে তিনি এলেন এক সংগ্রামী মানুষের জীবনে। যে মানুষ এক গ্রামীণ গৃহস্থের সন্তান, স্বপ্ন দেখেন শ্রেণীহীন এক সমাজের। যার ভরাট কণ্ঠের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লক্ষ-কোটি জনস্রোত জমা হতো বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যার ভাষণ সংগ্রামী চেতনা ছড়িয়ে দিতো এই বাংলার আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে, যে মানুষ অগুনতি মানুষকে এক সুতোয় বেঁধেছিলেন, যে মানুষ নিজেই ইতিহাস হয়ে মিশে আছেন পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়, ভালোবাসা, প্রেম আর মমতায় যে মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন সমগ্র বাংলার মানুষের। তিনি সেই মানুষের সহধর্মিণী, যেন বা কেশের আড়ে পাহাড়, নিভৃতে নির্মাণ করে গিয়েছেন এক আশ্চর্য মুজিব ভাস্কর্য। যে ভাস্কর্যের পদতলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষ প্রথমবার নিয়েছিলো প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস, যে তর্জনী পর্বতসম উঁচু, যে কণ্ঠ স্লোগানে আগুন ধারা, যে ভাস্কর্য ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে মিশে আছে এই বাংলার শাশ্বত বুকে তিনি সেই মুজিব ভাস্কর্যের শিল্পী, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিব। তিনি যেন সেই নজরুলের বিজয়লক্ষ্মী নারী, শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে বারবার জয়ী করে যাওয়া পুরুষের তরবারি। আজ ৮ আগস্ট ২০২০ সেই মহীয়সীর নব্বইতম জন্মদিন। যিনি একাধারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী, বাঙালির সকল লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী, বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি এবং সর্বোপরি এই শ্যামল সবুজ বাংলার আবহমান মায়ের প্রতিচ্ছবি, আমাদের ‘বঙ্গমাতা’।

বিজ্ঞাপন

এক দীর্ঘ আপোষহীন লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হওয়া, বঙ্গবন্ধু থেকে একজন জাতির পিতা এবং বিশ্ব বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়ার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু তাকে রেণু নামে সম্বোধন করেছেন। আত্মজীবনীর রেণু ব্যক্তি নারীর প্রয়োজনসমূহ অবদমিত করে দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূলমন্ত্র। নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী এই মহীয়সী নারী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটিও বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন এই মহীয়সী নারীর অনুপ্রেরণায়। আর তাই আত্মজীবনীর প্রারম্ভে তিনি লেখেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে এসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।“ বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।“

বিজ্ঞাপন

শৈশব থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন প্রিয় স্বামীকে। ১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের বঙ্গমাতা। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবনে খেলার সাথি ছিলেন এবং সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী হয়ে তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন। তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে জাতির পিতার সঙ্গে বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছেন। বঙ্গমাতার পিতা শেখ মোহাম্মদ জহুরুল হক দুই শিশুকন্যা বেগম জিনাতুন্নেছা, ডাকনাম জিন্নি এবং ফজিলাতুন্নেছা, ডাকনাম রেণুকে রেখে পরলোকগমন করেন। পরে মাতা হোসনে আরা বেগমও পরপারে পাড়ি জমান। পিতৃমাতৃহারা শিশু ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবার সাথে বড় হয়েছেন। তাঁর বৃদ্ধ দাদা শেখ মো. আবুল কাসেম এবং বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান এর সিদ্ধান্তে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে নেপথ্যে থেকে বেগম মুজিব অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছেন। এই অসামান্য দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী নারী তাঁর দূরদর্শী চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়ে। আমরা জানি এই মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে বাঙালি রাস্তায় নামে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথ দ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠে। পাকিস্তান সরকার এ সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাক সামরিক সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে নিষেধ করেন বঙ্গমাতা। এভাবে তিনি বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৭ই মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণেও বঙ্গবন্ধুকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর এ সকল অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

জীবন সংগ্রামের সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি পরিবারও সামলেছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন কিন্তু বঙ্গমাতা কখনো ভেঙে পড়েননি বরং কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতে সহায়তা করেছেন এবং শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেছেন। তিনি তাঁর পাঁচ সন্তানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অনিন্দ্য আদর্শ ও মূল্যবোধে বড় করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাঙালি যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ পেত না- তেমনি শেখ হাসিনার জন্ম না হলে আধুনিক বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে উন্নয়নের রোল মডেল ডিজিটাল বাংলাদেশের খেতাব পেতো না। আর বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কন্যা হাসু থেকে আজকের দেশরত্ন বাংলাদেশের অভিভাবক জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনায় পরিণত হওয়ার পেছনে বঙ্গমাতার অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গমাতার জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধু ,বাঙালি ও বাংলাদেশের সাথে একটি অবিচ্ছেদ্য নাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধনিতা সংগ্রাম নিয়ে যত আলোচনা হবে তত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান উদ্ভাসিত হবে। বাঙালি জাতি আজন্মকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এই মহিয়সী নারীকে। তিনি বঙ্গমাতা হয়ে মাতৃস্নেহে আগলে রাখবেন সমগ্র বাংলাদেশকে, ভালোবাসায়, মমতায়। স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে নেপথ্যের নক্ষত্র হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশেই তিনি জ্বলবেন আপন মহিমায়।

লেখক:
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
উপাচার্য
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

সুমাইয়া তাহসিন হামিদা
প্রভাষক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

বঙ্গমাতা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর