Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ত্যাগ ও সাহসের প্রতীক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা


৮ আগস্ট ২০২০ ১৪:৫৪

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব; তিনি কখনো বিপ্লবী মিছিলে নেতৃত্ব দেননি! তখনকার প্রেক্ষাপটে হয়তো এমন দৃশ্য কল্পনারও বাইরে। তিনি মহাত্মা গান্ধির স্ত্রী কস্তুরিবাঈয়ের মতো কোনো সত্যাগ্রহ আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেননি। জওহরলাল নেহেরুর ধর্মপত্নী কমলা নেহেরুকেও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারেননি।

তবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা আড়ালে থেকে তার গার্হস্থ্য জীবনের কর্তব্য পালন আর মন-মস্তিকে স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহযোগিতা করে গেছেন আজীবন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে কাছ থেকে দেখা ড. নীলিমা ইব্রাহিম লিখেছেন, ‘সাধারণ মানুষ তার (বেগম মুজিব) নাম শুনেছে, ছবি দেখেছে- তাও সম্ভবত ইন্তেকালের পর। স্বাধীনতার পূর্বে খুব কম মানুষই বিশেষত পরিবারের বাইরে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছে।’

প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে আজীবন বঞ্চিত মানুষের কথা বলে বারবার নির্যাতিত হওয়া শেখ মুজিবকে মনসত্ত্বাত্তিক সমর্থন দিয়ে তাকে হিমালয়সম আসনে আসীন করান। টুঙ্গিপাড়ার সেই ‘খোকা’র স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বিশ্বজুড়ে এদেশের মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা।

বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। ‘ আফসোস আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। খোকা থেকে শেখ মুজিব। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু। আবার বঙ্গবন্ধু থেকে আমরা পেয়েছি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। এর পেছনে সলতের মতো জ্বেলে জ্বেলে আজীবন স্বামীকে সাহস জুগিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। দিয়েছেন অনুপ্রেরণা ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। যা অনস্বীকার্য।

বিজ্ঞাপন

যুবক বয়স থেকে শুরু করে মানুষের কথা বলতে গিয়ে শেখ মুজিবকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। তার অবর্তমানে দলের পাশে থাকার পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন বঙ্গমাতা। নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও জননীর মতো বঙ্গমাতার কাছে আশ্রয় নিতেন। বঙ্গমাতা সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগ শুনতেন, বাড়িয়ে দিতেন সহযোগিতার হাত। এভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করেছেন শেখ মুজিবের ‘প্রিয় রেণু’।

বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন। মানুষও তাকে ভালোবাসতেন, এখনো ভালোবাসে। তার প্রতি ভালোবাসা হিসেবে আপামর ছাত্রজনতা ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

পড়াশোনায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বড় ডিগ্রিধারী নন, কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে বিশাল বড় হৃদয়ের অধিকারী। দলীয় কর্মী অথবা সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ, তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনো খালি হাতে ফেরত গেছেন এমনটা কখনো শোনা যায়নি।

১৯৪৬ সালে দেশ ভাগের পর দাঙ্গা শুরু হয়। সেই সময় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অসুস্থ; নিজে শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকলেও স্বামীকে আক্রান্ত এলাকায় যেতে বারণ করেননি। বরং উৎসাহ দিয়ে তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।’

তখন কতই বা বয়স ছিল তার। ১৯৩০ সালে ৮ আগস্ট জন্মের হিসেবে ১৬ বছরের মতো হবে। এই বয়সে একজন কিশোরী বধূ নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে দেশের প্রয়োজনকেই বড় করে দেখেছেন। এটা কেবল বেগম মুজিব বলেই সম্ভব হয়েছে। তাই তো তিনি আবির্ভূত হয়েছেন বাঙালির জননীরূপে-বঙ্গমাতা।

বিজ্ঞাপন

শৈশবে বাবা-মাকে হারানোর পর শেখ ফজিলাতুন্নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। তাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখেন চাচি এবং পরবর্তীতে শাশুড়ি শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুন। পিতার অভাব বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমানও। শৈশবেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়ে সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার-তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুইবোনকে লিখে দিয়ে যাব।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় আট বছর হবে।’’

বিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধু এন্ট্রান্স পাস করার পরই মূলত তাদের সংসার জীবন শুরু হয়। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। এই সময়টায় বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সময় কাটতো শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের।

তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম প্রতিভাসম্পন্ন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল একজন নারী। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তার। শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে সহধর্মিণীর সেই অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

স্ত্রীর অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ এক অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বলেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলে-মেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’

সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে বঙ্গমাতা পরিবারও সামলেছেন বেশ গুছিয়ে। সবকিছুর পরও তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ছায়াসঙ্গী। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই সর্বাত্মক দিয়ে আওয়ামী লীগ ও নেতা-কর্মীদের পাশে থেকেছেন তিনি।

আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় দেখা করার সময় বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের তা জানাতেন বেগম মুজিব।
অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি সফলের ক্ষেত্রেও তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কলকাতায় অবস্থানকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত স্বামী শেখ মুজিবের যখনই অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনই পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় পাঠিয়ে দিতেন মহিয়সী এই নারী।
আর বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার বিক্রি করেও দল ও নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। একজন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের মতো জীবন-যাপন করতেন তিনি। তার বাড়িতে কোনো বিলাসী আসবাবপত্র ছিল না, মনে ছিল না কোনো অহংবোধ।

তার সদয় আচরণ ও বিনয়ে মুগ্ধ ছিল সবাই। সন্তানদের যেমন ভালোবেসেছেন তেমন শাসনও করেছেন এই মমতাময়ী মা। পালন করে গেছেন পিতা-মাতা উভয়েরই কর্তব্য। কোমলে, কঠোরে মিশ্রিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সাহসী নারী স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলে-মেয়েদের গড়ে তোলেন।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ বাঙালি সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য এবং পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করে পাকিস্তান সরকার। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। এ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে তিনিসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবিতে রাস্তায় নামে বাঙালি জনতা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে।

উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা সংস্থা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও গ্রেফতারের হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে তার তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মামলাটি আইনিভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে আইনজীবীদের পরামর্শ ও অর্থ জোগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে পিছু হটে আইয়ুব খানের সরকার।

ওই সময় লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বেঁকে বসেন বেগম মুজিব। এ বিষয়ে তার জোরালো আপত্তি। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে বেগম মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন- প্যারোলে নয়, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।

এ অবস্থায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গমাতা বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর বৈঠকে না যান। তিনি (বঙ্গমাতা) এও বুঝতে পেরেছিলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। তাই বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধুও প্যারোলে মুক্তিতে অসম্মতি জানান।

এরই মাঝে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে; রূপ নেয় গণঅভ্যূত্থানে। এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আইয়ুব সরকার। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান বাঙালির এই মহান নেতা।

প্যারোলে মুক্তি না নেওয়া নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব তখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছরই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন বেগম মুজিব। তারা ওঠেন ঢাকার গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী লেনের একটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হলে সরকারি বাসা পান, তারা ওঠেন মিন্টো রোডের সরকারি বাড়িতে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলে অল্পদিনের নোটিশেই ছাড়তে হয় সেই বাড়ি।

শুধু ওই ঘটনা-ই নয়। এ রকম অনেকবার বাসা পাল্টাতে হয়েছে তাদের। এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাড়ি করেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার প্রিয় বাড়ি। এই বাড়ি নির্মাণেও বঙ্গমাতার অনেক কষ্ট ও শ্রম জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর নিজেদের বাড়িতে ওঠেন তারা। এরপর এই বাড়িটি-ই হয়ে ওঠে নেতা-কর্মীদের আপন ঠিকানা।

এ বিষয়ে কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বহুদিনের আত্মগোপনকারী ছাত্রনেতা কিংবা রাজনৈতিক কর্মী অভুক্ত, অস্নাত অবস্থায় মাঝরাতে এসে ঢুকেছেন বত্রিশের বাড়িতে, তাকে সেই রাতে নিজের হাতে রেঁধে, মায়ের স্নেহে, বোনের মমতায় পাশে বসে খাওয়াচ্ছেন বেগম মুজিব। এই দৃশ্য একবার নয়, বহুবার দেখেছি।’

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকেই পরিচালিত হয়েছে দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনামূলক নানা কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় এই বাড়িতে বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসা নেতা-কর্মীদের শুধু বুদ্ধি-পরামর্শ-ই নয়, যার যেমন প্রয়োজন সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বঙ্গমাতার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। ওইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গতবছর বঙ্গমাতার জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ৭ মার্চ ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে! সবাই এসেছে-এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আব্বাকে সোজা বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ। তুমি জানো- কী বলতে হবে, মানুষ কী শুনতে চায়? তোমার মনে যে কথা আসবে, সে কথা-ই বলবা।

এরপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুত্রে তর্জুনী উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার সেই ডাকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। এই কথাগুলোই সংগ্রামে যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা-সাহস দিয়েছে।

এ থেকেই স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ডাকে ছিল বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন। এই সমর্থন তাকে সাহস জুগিয়েছিল, নির্ভার থাকতে সহযোগিতা করে। আজ এই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে।

শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। সেই সময়টায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেকটা বন্দিদশায় কেটেছে তার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপর সেখান থেকেই লন্ডনে যান। এরপর ওখান থেকে প্রিয়তমা, অনুপ্রেরণাদায়ী শেখ ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে প্রথম কথা হয় শেখ মুজিবের। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এবার স্বামীর সঙ্গে শুরু হয় তার দেশগড়ার কাজ। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জন্মভূমিকে শস্য-শ্যামলারূপে গড়ে তুলতে জাতির পিতার পাশে দাঁড়ান বঙ্গমাতা। এছাড়া অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে তিনি তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দেন। বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ বঙ্গমাতা বলেন, ‘এই বীরাঙ্গনা রমণীদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের লজ্জা কিংবা গ্লানিবোধের কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই প্রথম প্রমাণ করেছেন যে, কেবল বাংলাদেশের ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদাবোধে কী অসম্ভব বলীয়ান। (সূত্র: দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)।’

আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে তুলে ধরতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অবদান রেখেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার সঙ্গে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর বেশ ভালো সখ্যতা ছিল। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ সফরে এলেও বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতেন অসম্ভব প্রাণশক্তিতে বলীয়ণ এই মহিয়সী নারী।

সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে পাশে ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে তাদের হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধীরা। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে। যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

চলতি বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে বাঙালি জাতি। ২০২০-২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। তবে ভয়াবহ নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে এসব অনুষ্ঠানমালা স্থগিত বা সীমিত করা হয়েছে।

শেখ মুজিব-শেখ ফজিলাতুন্নেছার রক্তের উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতার আদর্শে ও তার দেখানো পথে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে তিনি দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলার মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলও এই শেখ হাসিনা-ই।

এ অবস্থায় উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সবারই উচিত নিজ নিজ জায়গা দেশের কল্যাণে অবদান রাখা। বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন কারিগরি ও বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষাব্যবস্থার। পাশাপাশি আমাদের মানবিক মানুষ হতে হবে।

বঙ্গমাতার আদর্শে গড়ে উঠুক এদেশের নারীরা। তার আদর্শে আপন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত হোক বাংলাদেশ। ৯১তম জন্মদিনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি পরম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর