অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম নির্বাচন
১১ আগস্ট ২০২০ ১৯:৪৭
একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে লিখতে বসলে অনেক অনেক ইতিহাস উঠে আসে। কোনটা ফেলে কোনটা নিয়ে লিখব তাই নিয়ে মনে মনে চলে বিশাল যুদ্ধ। কিন্তু যদি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে একটি বিষয় নিয়ে লিখতে বলা হয়, আমি সবসময় বঙ্গবন্ধুর করা প্রথম জাতীয় নির্বাচন ও তার আগে-পরের সমসাময়িক ঘটনা নিয়েই লিখতে চাই। এই নির্বাচন, নির্বাচনের জনসমাবেশ বা নির্বাচন ও তার পরবর্তী সকল ষড়যন্ত্র এসব কিছুই বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায় তার রাজনৈতিক মনোভাবকে বিশালভাবে প্রভাবিত করেছে।
পটভূমি
১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা করে। নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তা দেশের জনসাধারণ মাত্রই জানত। আওয়ামী লীগ থেকে তৎকালিন সাধারন সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমানসহ কয়েকজন নেতা তখন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে জনাব শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হককে আওয়ামী লীগে জোগদানের জন্য অনুরোধ করে। হক সাহেব তাতে রাজিও ছিলেন। সেবার বগুড়ায় এক জনসমাবেশে হক সাহেব এও বলেন, যারা চুরি করতে চান তারা মুসলিম লীগেই থাকুন। আর যারা ভাল কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন।
এভাবেই আস্তে ধীরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছিলো। চলছিলো নির্বাচনে নিজেদের দল গোছানোর কাজ। সেসময় আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা কথা চালু হল আর তা হল যুক্তফ্রন্ট গঠন করার। এটা ছিল মুসলিম লীগ বাদে বাকি সব দল নিয়ে একটা ঐক্য গঠনের আওয়াজ। কিন্তু আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই একক নির্বাচনের পক্ষে ছিল। তারা জানত, জনগন তাদের সাথেই আছে এবং তারা নির্বাচনে জয়লাভ করবে। তাছাড়া ঐক্যজোট করে নির্বাচন করে পরবর্তীতে সরকার গঠনেও অনেক ঝামেলা তৈরি হয় তাই শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা মানে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর বিপক্ষে অবস্থান করেন।
এরকম সময়ে একবার মাওলানা ভাসানী দলের কারো সাথে আলাপ আলোচনা না করেই ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশের ডাক দেন। কিছুদিন পরই ঢাকায় আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। সেই মহাসমাবেশের আগে এই জনসমাবেশের ডাক শেখ মুজিবর রহমানকে বিরক্ত করলেও দলের হাই কমান্ড মেনে তিনি সেখানে যান। বিভন্ন জেলা থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা আসতে থাকেন সেখানে। আর কিছু আওয়ামী লীগের নেতা যুক্তফ্রন্ট করার ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। যদিও আওয়ামী লীগের নেতাদের তৎপরতায় সে ষড়যন্ত্র বেশিদূর এগুতে পারেনি।
ঠিক কাছাকাছি সময়ে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক নিজের দল গঠন করলেন কৃষক শ্রমিক লীগ নামে। ময়মনসিংহের সভা শেষ করেই আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন জেলায় জেলায় নিজেদের দলের প্রচারণা সভা শুরু করে দেন। শহিদ সাহেব ঢাকায় সভা করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানী একসাথে উত্তরবঙ্গে সভা করতে লাগলেন। এরকম এক সভার দিন একদিন ঢাকা থেকে জরুরি টেলিগ্রাম আসে বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা ভাসানীকে ঢাকা যেতে হবে বলে। কিন্তু পরদিনের সভা ফেলে কিভাবে যাবেন সেটা ভেবে ঠিক হলো মাওলানা ভাসানী তৎক্ষণাৎ ঢাকা ফিরে যাবেন আর বঙ্গবন্ধু সভা শেষ করে আসবেন।
সভা শেষ করে ঢাকায় ফিরে দেখেন মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের হয়ে যুক্তফ্রন্ট করে ফেলেছেন। মাওলানা ভাসানীর ভাষ্যমতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচন করার চুক্তি করতে চান নি। কিন্তু ঢাকায় অন্য আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে বুঝানোর দায়িত্ব নিলে তিনি তাতে রাজি হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু এ নিয়ে অনেক রাগারাগিও করেন। শহিদ সাহেবের পরামর্শও কেন নেওয়া হল না এত গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিতে সে প্রশ্নও তোলেন। শহিদ সাহেব সে সময় পাকিস্তান ছিলেন। দুই তিন দিনের মধ্যেই ঢাকা ফেরার কথা। তার জন্যও কেন অপেক্ষা করা হল না সেকথাও বলেন। কিন্তু যা হওয়ার সেটা হয়েই গেছে। বঙ্গবন্ধুও শেষমেশ যুক্তফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন মেনে নেন।
নির্বাচনের প্রার্থী নির্বাচন
যুক্তফ্রন্ট গঠন হবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নামে-বেনামে রাজনৈতিক দল নমিনেশন চাইতে আরম্ভ করলো। যাদের নামটি পর্যন্ত তার আগে কেউ শোনেনি সেই দলগুলোও তাদের প্রার্থীর নমিনেশন চাইতে লাগলো। তার উপর আরেক উপদ্রব শুরু হলো মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত কর্মীদের নিয়ে। মুসলিম লীগের যত নেতা মুসলিম লীগ থেকে নমিনেশন পায় নি তারা দলে দলে কৃষক-শ্রমিক লীগের হয়ে নাম লেখাতে শুরু করলো। শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক ততদিনে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাকে তার আশেপাশের চাটুকাররা সহজেই প্রভাবিত করে ফেলতে পারতো। আর এই সকল বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে চাইলেও আওয়ামী লীগের অনেক যোগ্য কর্মীকেও সেবার নির্বাচনের নমিনেশন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন চট্রগ্রামের এম.এ আজিজ।
বঙ্গবন্ধুর নির্বাচন ও তার প্রচারণা
নির্বাচনের প্রার্থীতার এসব ঝামেলার কারনে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় পার্টি সেক্রেটারি হিসেবে প্রচুর কাজ করতে হল। এদিকে নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার শেষদিনও এগিয়ে আসছিলো। কিন্তু নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাবার সুযোগই পাচ্ছিলেন না একদম। শেষে নমিনেশন জমা দেওয়ার শেষ তারিখের আগের দিন গোপালগঞ্জে রওনা দিলেন। শেষদিন জমা দিলেন নিজের নমিনেশন।
গোপালগঞ্জ গিয়ে দেখেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন ওয়াহিদুজ্জামান। ব্যবসায়ী মানুষ। সারা জীবন প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের প্রতি যে সমর্থন দেখলেন গোপালগঞ্জে গিয়ে তাতে বঙ্গবন্ধু বুঝে গেলেন জামান সাহেবের টাকা কুলোবে না তাঁর সাথে। বঙ্গবন্ধুই নির্বাচনে জিতবেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য ছিল দুইটা সাইকেল আর অল্প কিছু পারিবারিক নৌকা। কর্মীরা সবাই নিজের নিজের সাইকেল দিয়েই বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। প্রায় গ্রামেই তাকে হেঁটে যেতে হত। কর্মীদের জন্য কোন টাকার ব্যবস্থাও করতে পারেননি। কিন্তু এসব কোন বাঁধাই ছিল না তার জন্য। এরকম একটা ঘটনা বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছিলেন- একবার রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেক্ষণ। কারণ, তিনি জানতেন এই পথ দিয়ে শেখ মুজিব যাবে। বঙ্গবন্ধু যখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বৃদ্ধা তার হাত ধরে বললেন তাকে বৃদ্ধার বাড়িতে কিছু খেতে হবে। বৃদ্ধার সেই ছোট ঘরে বৃদ্ধা তার সাধ্যমত খাওয়ালেন বঙ্গবন্ধুকে। এবং বিদায় বেলায় তার হাতে বৃদ্ধা চার আনা পয়সাও দিলেন নির্বাচনের খরচ চালানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু সে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম ‘তোমার দোয়া রেখ আমার জন্য। তোমার দোয়াই আমাকে জিতিয়ে দিবে। এটাকে টাকা দিয়ে মাপা যায় না’।
নির্বাচনী ষড়যন্ত্র এবং নির্বাচন
মুসলিম লীগের জামান সাহেব দেখতে পেলেন তিনি জামানত হারানোর মত অবস্থায় আছেন। আর তখনই মুসলিম লীগ তার কূট চাল চালে। শর্ষীনার পীরসহ প্রায় দশজন পীরকে মুসলিম লীগের দলে ভিড়িয়ে নিলেন তারা। তারা মুসলিম লীগের হয়ে গ্রামে গ্রামে ফতোয়া দেওয়া শুরু করলেন ‘শেখ মুজিবকে ভোট দিলে, যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে দেশে ইসলাম থাকবে না, কাফের হয়ে যাবে সবাই ইত্যাদি’। বঙ্গবন্ধু তার নির্বাচনী এলাকার এক মাওলানা শামসুল হককে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। তার ধারণা ছিল এ মাওলানা তার বিরুদ্ধে কিছু বলবেনা। কিন্তু সেই মাওলানাও মুসলিম লীগের টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিলেন। সব পীর মাওলানারা স্পিডবোটে করে দ্রুত সব গ্রামে গিয়ে গিয়ে এসব প্রচার করতে শুরু করে।
এদিকে ঢাকা থেকে পুলিশ প্রধান গোপালগঞ্জে গিয়ে মুসলিম লীগের হয়ে সকল সরকারি কর্মচারীকে কাজ করতে আদেশ দিলেন, মুসলিম লীগের হয়ে প্রচারণাও চালালেন। একজন মেজিস্ট্রেট মুসলিম লীগের হয়ে কাজ না করতে চাইলে তাকে বদলী করা হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে নিজের নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে পাশের নির্বাচনী এলাকায়ও অন্য প্রার্থীদের জন্য প্রচারণা চালাতে যেতে হত সেই প্রার্থীরা কিছুটা দুর্বল ছিল বলে।
নির্বাচনের তিনদিন আগে সকল কেন্দ্র বদলে যেখানে জামান সাহেবের সুবিধা হবে সে অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর অনেক কর্মীদের জেলে দেওয়া হল, অনেকের নামে বের হল ওয়ারেন্ট। অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গবন্ধু তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় না এসে নিজ নিজ গ্রামে থাকতে আদেশ দিলেন। এরকম সময় সবকিছুই যখন বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ছিল। তাই দেখে শহিদ সাহেব এসে দুটো সভায় বক্তৃতা দিলেন, আর শেষদিন মাওলানা ভাসানী এসে বক্তৃতা দিলেন।
নির্বাচনের পর ভোট গননায় দেখা গেল সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু দশ হাজারের মত বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু তাইই না, নির্বাচনী প্রচারণার জন্য তাকে মানুশজন মিলে ৫ হাজার টাকাও দিয়েছিলো সেবার। এসব দেখেই উনি সেবার বলেছিলেন, ‘জনগনকে ভালবাসলে জনগনও তোমাকে ভালবাসবে। তুমি তাদের জন্য অল্প কিছু করে দেখ, দেখবা তারা তোমার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবে।’
সেই নির্বাচন থেকে তার আরেকটা ধারণা হয়েছিল যে, এই বাংলায় সাম্প্রোদায়িকতার কোন স্থান নেই। এদেশের মানুষ তাদের ধর্মকে ভালবাসে ঠিকই কিন্তু তাকে মিথ্যা ধর্মের কথা বলে ভন্ডামি করে তার ধর্মকে ভুল পথে কেউ পরিচালিত করতে পারে না। এবং তার প্রমাণ হিসেবে নিজের এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে দেখতেন। সেই নির্বাচনে মানুষের তার প্রতি এই অগাধ বিশ্বাস আর ভালবাসা দেখে নিজের বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে লিখেছিলেন, ‘আমার জীবন গেলেও আমি আমার দেশের এই মানুষগুলোর সাথে কখনও বেঈমানি করতে পারবো না।’
৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রথম নির্বাচন মুসলিম লীগ রেহমান মোস্তাফিজ শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী