জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এক আদিগন্ত বিস্তৃত সূর্য
১৫ আগস্ট ২০২০ ০৮:০৩
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি ভাস্কর্য, যে ভাস্কর্যের পদতলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মানুষ। বাঙলার মানুষ প্রথমবারের মত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলায় নিয়েছিলো প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস, সেই তর্জনী পর্বতসম উঁচু, সেই কণ্ঠ স্লোগানে আগুন ধারা, সেই ভাস্কর্য ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে মিশে আছে এই বাংলার শাশ্বত বুকে।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামের সেই ছোট্ট কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান যাকে আজ সমগ্র পৃথিবী স্মরণ করে পরম শ্রদ্ধায়। যে মানুষ মধ্যবিত্ত বাঙালীর ছাপোষা জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন এক দীর্ঘ আপোষহীন সংগ্রামী জীবন। অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনা, ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম নিয়ে যিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর বন্ধু, জাতির জনক, একজন বিশ্ব নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। বাংলার আপামর জনসাধারণকে দেখিয়েছেন মুক্তির স্বপ্ন। তিনি জীবনে কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি এবং নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি। একজন বিশ্বনেতার সকল গুণে গুণান্বিত এই বাংলার নিঃসঙ্গ শেরপা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজন্মকাল তরুণদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন। যেভাবে তার আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা এ রাষ্ট্র তারই আদর্শে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বাংলার ঐতিহ্য, তিনি বাঙালির গর্ব। তার জন্যেই এই পৃথিবীতে বাঙালি পেয়েছে বাংলা নামক স্বর্গ। সেই বঙ্গবন্ধু ছোটোবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। এরপর একে একে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ এর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে বাঙালীর মুক্তির প্রয়াসে ছেষট্টির ছয় দফা প্রস্তাব পেশ, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তার অসাধারণ নেতৃত্বের পদচিহ্ন অঙ্কন করেছেন। তিনি তার দেশের মানুষের মুক্তির জন্য জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় বরণ করে নিয়েছেন কারাবাস। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বাঙালীর মুক্তি আন্দোলনের কবি শত আপোষহীন সংগ্রাম শেষে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ৷ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার বজ্রকন্ঠ বাণী সেদিন উজ্জীবিত করেছিলো বাঙলার আপামর জনসাধারণকে। সর্বশেষ ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আন্দোলনরত বাঙালীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর অপারেশন সার্চ লাইটের মত ঘৃণ্য অভিযান চালায় এবং বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেফতারের আগে তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণে সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির মত ঘোষণা করলেন ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’।
অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম ‘শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভায়, পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিলে ফসলের মাঠে, কৃষকের হাসিতে, রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতারে, মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশীতে, অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিকে’। এই ছোট্ট ভূ-খণ্ডের স্বাধিকার অর্জনের কবি বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশে। এখন আর আন্দোলনকারীর ভূমিকায় নয় বরং এক যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভূখণ্ড সুষ্ঠুভাবে পুনর্গঠনে কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তিনি। দেশের শাসনব্যবস্থাসহ সকল উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে গ্রহণ করেন বিরাট মহাযজ্ঞ, পালন করেন আরেক ঐতিহাসিক মহান দায়িত্ব।
এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। কিন্তু সোনার বাংলাকে নিয়ে তার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করতে দেওয়া হলো না। অসমাপ্ত সকল প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নকে এবং একটি সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে ‘৭৫-এর পনেরই আগস্ট নেমে আসে এক ভয়াবহ কালরাত। অপশক্তির কালো ছায়ায় সেদিন ঢেকে গিয়েছিলো বাংলার আকাশ বাতাস। সেই রাতে বাঙালি হারিয়েছে জাতির পিতা এবং বিশ্ব হারিয়েছে এক মহান নেতা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের এই মহান নায়ক সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন এক মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ। সৌভাগ্যবান বাঙালীর জন্য আজন্মকাল অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন এই বাংলার নিঃসঙ্গ শেরপা।
তার সেই আদর্শেই এই বাংলাকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের বুকে গর্বভরে আমরা আজ উদযাপন করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এক আশ্চর্য মহিমান্বিত মুজিব বর্ষ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ এবং সৌভাগ্যবান বাঙালী জাতি আজো সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সূর্যের আলোয় আলোকিত। বিশ্বের কাছে এই দেশ আজো সেই মহিমান্বিত নামেই পরিচিত।
লেখক:
ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
উপাচার্য
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
সুমাইয়া তাহসিন হামিদা
প্রভাষক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।