Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আমি মায়ের কাছে যাবো’


১৫ আগস্ট ২০২০ ১৭:৫৫

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সসদ্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শেখ রাসেল। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি।

সেদিন ধানমণ্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, বাদ যায়নি ছোট্ট রাসেলও। তাদের হাতে একে একে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালসহ অনেকে। সেদিনের সেই ভয়াল বীভৎসতা স্মৃতিতে আনলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট খুনিও বোধ হয় আঁতকে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কটিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংগঠিত নারকীয় ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের ভয়াল বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। “কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমত রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ হয়ে। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তার ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজি জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।” এভাবেই ভয়াল ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

বাঙালির ইতিহাসের সেই আঁধার রাতে আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব , আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’। ছোট্ট রাসেলের সেই কান্না, আতঙ্ক আর ভয় খুনিদের মন গলাতে পারেনি। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক নিষ্পাপ অবুঝ শিশুকে হত্যা করে কি উল্লাসই না করেছিল খুনিরা ! প্রিয় মুখগুলোর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল- কী কষ্টই না ও পেয়েছিল তা কখনো অনুভব করতে পারবো না। খবরটি শোনার পর তাঁর হাসু বুবুর কেমন লেগেছিল এ জাতি কি একবার ভেবে দেখেছে ?

রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল। বার্ট্রান্ড রাসেল কেবলমাত্র একজন দার্শনিকই ছিলেন না। বিজ্ঞানী ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও।

১৫ আগস্টের নির্মম সেই রাত বাঙালি জাতির জীবনে না আসলে হয়তো তিনি হতেন বিজ্ঞানী অথবা জাতির পিতার মত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারী। কিন্তু শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে তা নয়, এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তার সব অবিকশিত সম্ভাবনাকেও।

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে এল শেখ রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয়, বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।

সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল। ’

শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি তার বাবা শেখ মুজিবও। যা স্পষ্টত ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনীতেও।

‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। ’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’

আগস্ট মানে বাঙালির শোকের মাস, বেদনার মাস। বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালি জাতির ইতিহাসে রক্তের আখরে লেখা শোকাবহ আগস্ট। বিশ্বাস করি শোকের মাসে প্রত্যয় ও শপথে শোককে শক্তিতে পরিণত করার অভয়মন্ত্রে আবার উদ্দীপিত হবে বাঙালি। কারণ বীর বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে এ মাসেই। ১৯৭৫ সালের এ মাসেই বাঙালি জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করে। দীর্ঘ আইনি-প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে ১২ খুনির মধ্যে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হল, কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), মেজর (অব.) এ কে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)।

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য ছয় খুনিকে ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলাতক ছয়জনকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। না হলে যে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের কলঙ্কমোচন হবে না, শেখ রাসেলের আত্মাও শান্তি পাবে না।

খুনিরা সেদিন শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করেনি, নির্মমভাবে হত্যা করেছিল নিষ্পাপ শিশু রাসেলকে; হত্যা করেছিল গর্ভবতী মাকে; হত্যা করেছিল নারীকে। তাই বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু ও পৃথিবীর অন্যতম মানবিক রাষ্ট্র কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন ও যুক্তরাজ্য এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত জঘন্য খুনির নিরাপদ আবাসভূমি হতে পারে না!

লেখক-  সভাপতি, শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ

১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড ডা. ফেরদৌস খন্দকার বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমান শেখ রাসেল

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর