বঙ্গবন্ধু এবং একবিংশ শতাব্দীর এশীয় রাজনীতি
১৬ আগস্ট ২০২০ ২০:৫৬
একবিংশ শতাব্দীর এশীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ও তার প্রদর্শিত পথ আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করতে পারি? বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এবং এশীয় শতাব্দী হিসেবে গণ্য হওয়া একবিংশ শতাব্দীতে তার ৪৫তম শাহদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালনকালে এশীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত এবং তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের অবস্থান অনুধাবনের জন্য প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনীতি বা নীতি প্রক্রিয়ায় প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনা। এই ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে অথবা অভ্যন্তর ও বাইরের মিথস্ক্রিয়া দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে। সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুন্নার মিরডাল ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার ‘এশিয়ান ড্রামা’ বইতে তখনকার এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় যে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছিল তার ফলে নাটকীয় কিছু ঘটে যাওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মিরডাল তার ভাষায় যা ব্যক্ত করেছিলেন তা ছিল পাকিস্তানের ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের আন্দোলন। মিরডালের বই প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পরেই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া এবং সমগ্র বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রীয় ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বাঙালি গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তখন যথার্থই ব্যক্ত করেছিলেন— ‘…এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিল, কার সে কণ্ঠস্বর, মুজিবর সে যে মুজিবর…।’
প্রাথমিকভাবে পূর্ব এবং উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত মহাদেশ। চার কোটি পঁয়তাল্লিশ লাখ ঊনআশি হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এশিয়া মহাদেশ বিশ্বের শতকরা ৩০ ভাগ ভূমি এলাকায় বিস্তৃত। বিশ্বের মোট ৭৮০ কোটি লোকসংখ্যার মধ্যে এশিয়া মহাদেশের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৪৬৫ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ। বিশ্বের মূল ধারার সব ধর্ম হিন্দু, জরথুস্ত্রবাদ, ইহুদি, জৈন, বৌদ্ধ, কনফুসিয়াসবাদ, টাওবাদ, খ্রিস্টবাদ, ইসলাম, শিখ এবং আরও অনেক ধর্মের উৎপত্তিস্থল এশিয়া। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জাতিগোষ্ঠী, সংস্কৃতি, ভাষা, পরিবেশ ও জলবায়ু, অর্থনীতি, ঐতিহাসিক বন্ধন এবং সরকারি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য বিদ্যমান।
এশিয়া মহাদেশে মোট প্রায় ৫৪টি দেশ। এশিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩১ ভাগ লোক বাস করে চীনে এবং শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ লোকের বাস ভারতে। বর্তমানে এশীয় রাজনীতির শীর্ষ ঘটনা হচ্ছে ভারত-চীন সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং একে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে মেরুকরণ। এই মেরুকরণ শুধু দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সীমিত নেই। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে এই মেরুকরণ সমগ্র এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে একশ চুয়াল্লিশ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত, ৯৫ লক্ষ ৯৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ‘কর্তৃত্ববাদী’ চীন, অন্যদিকে একশ উনচল্লিশ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ও ৩২ লক্ষ ৮৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ‘গণতান্ত্রিক’ ভারত। দুইটি এশীয় রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মেরুকরণ, অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি, এশিয়া কেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এদ্বারা এটিও বোঝা যাচ্ছে যে বিশ্ব রাজনীতির ‘ভরকেন্দ্র’ আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে ক্রমান্বয়ে এশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের লগ্নে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দ্বিতীয় বিশ্বযোদ্ধত্তরকালে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ধর্মীয় উপনিবেশের অধীনে বাংলাদেশের ভাগ্য সমর্পিত হয়েছিল। এসময় স্নায়ুযুদ্ধের যুগে বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় ছিল দ্বিমেরুর বিশ্ব। স্নায়ুযুদ্ধকাল বা দ্বিমেরুর বিশ্বে সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুন্নার মিরডাল ১৯৫৭ যখন তার ‘এশিয়ান ড্রামা: অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু দ্য পোভার্টি অব ন্যাশনস’ বই টি লেখার কাজ শুরু করেছিলেন। সেই বছরই তখনকার একজন উদীয়মান তরুণ রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৫৭ সালের কোন এক সময় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সৈয়দ বদরুল হাসান (২০১৯) তার লেখায় উল্লেখ করেছেন এবং আমি উদ্ধৃত করছি, , “Was it not possible, for East Pakistan to become independent someday?” কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে কী স্বাধীন হওয়া সম্ভব নয় ? সোহরাওয়ার্দী এসময় বঙ্গবন্ধুকে এমন চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, সৈয়দ বদরুল হাসান লিখেছেন এবং আমি উদ্ধৃত করছি, “We’ll do our job when the time comes.”
মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমসাময়িককালের দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রীয় ঘটনা। বিশ্ব তখন আমেরিকান শতাব্দী এবং প্যাক্স সোভিয়েতিকা প্রত্যক্ষ করছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতের পর থেকে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । মানব সভ্যতার ইতিহাসে নজিরবিহীন গণহত্যা ও রক্তপাতের মাধ্যমে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তান থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল ফরাসি দার্শনিক, মুক্তিযোদ্ধা, ঔপন্যাসিক ও সেসময়ের সেদেশের সাংস্কৃতিক মন্ত্রি আঁদ্রে মালরো বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সেসময় খ্যাতিমান পণ্ডিত খান সরওয়ার মুর্শিদ মালরোকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কী মনে করেন মুজিব বাংলাদেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে পারবেন ? এ প্রশ্নের উত্তরে মালরো তখন সন্দেহোক্তি করে বলেছিলেন, ‘, ‘If you don’t kill him.’ অর্থাৎ আপনারা যদি তাকে হত্যা না করেন। এর মাত্র দুই বছর চার মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের কতিপয় কুলাঙ্গার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল।
এশীয়করণ ও এশীয় রাজনীতি
একবিংশ শতাব্দীতে, বিশ্ব অপরিবর্তণীয়ভাবে এশীয়করণ প্রত্যক্ষ করছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড. পরাগ খান্না ২০১৯ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য ফিউচার ইজ এশিয়ান: কমার্স, কনফ্লিক্ট এন্ড কালচার ইন টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ শীর্ষক বইতে বলছেন, ‘আমরা যা চিন্তা করি ‘এশীয় শতাব্দী’ তারচেয়ে অনেক বৃহৎ। শুধু চীনের চেয়ে অনেক বড়, নতুন এশীয় ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে একটি বহু-সভ্যতাগত নিয়ম হিসেবে গড়ে উঠছে। যা সৌদি আরব থেকে জাপান এবং রাশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, যা ৫০০ কোটি মানুষকে বাণিজ্য, আর্থিক ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করছে এবং যা বৈশ্বিক জিডিপির শতকরা ৪০ ভাগ। এশিয়াব্যাপী নতুন সিল্ক রোড তৈরির জন্য চীন নেতৃত্ব নিয়েছে, তবে চীন একাই নেতৃত্ব দেবে না। বরঞ্চ, এশিয়া স্থায়ী বহুমেরু নিয়মে ফিরে আসছে যা ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং মার্কিনি প্রাধ্যান্য সৃষ্টি হওয়ার অনেক আগে বিদ্যমান ছিল। যার সাথে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভরকেন্দ্র নিয়ে এগিয়ে আসছে। ইরান থেকে ইন্দোনেশিয়ার মত বৃহৎ অথচ স্থবির সমাজ তরুণ ও শহুরে, উচ্চাভিলাষী এবং উদ্যোক্তা যুবকদের নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আবির্ভূত হচ্ছে, যখন সউদি আরব থেকে ভিয়েতনামে প্রাইভেটাইজেশন অগ্রগতির নতুন তরঙ্গ নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। আগে কখনো যা হয়নি এমনভাবে এখন এশীয়রা অর্থনৈতিক ও গভর্নেন্স মডেল নিয়ে এগিয়ে আসছে, এবং তাদের আত্মবিশ্বাসী বহির্মুখী প্রভাব- ধাক্কা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকাব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পুনরাকৃতি দান করছে। পোর্টফোলিও বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য যুদ্ধ হতে হলিউড সিনেমা এবং অবকাশ ভ্রমণ, জীবনের কোনকিছুই এখন এশীয়করণ থেকে মুক্ত নয়।
আরও পড়ুন-
- মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
- ভয়ঙ্কর সেই সকালের স্মৃতি
- আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতি
- শাওনের নিস্তব্ধ রাতে রাসেলের কান্না
বিশ্ব ‘আমেরিকা প্রথম’ শুনতে অভ্যস্ত, কিন্তু বিশ্ব কী ‘এশিয়া প্রথম’ শোনার জন্য প্রস্তুত ? কেমন হবে যখন এশিয়া কেবল আর পশ্চিমের জন্য উৎপাদন করবে না কিন্তু এশিয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব উৎপাদন করবে ? এবং যখন কেবল এশিয়রা পশ্চিমের মত বসবাসে আগ্রহী থাকবে না বরঞ্চ পশ্চিমা সমাজ এশিয়া স্থিতিশীলতা এবং দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের ইচ্ছা পোষণ করবে ? এশীয় দৃষ্টিতে বিশ্ব দেখার জন্য বিশ্বাবাসীকে প্রস্তুত হতে হবে। বিশ্ব রাজনীতির ‘ভরকেন্দ্র’ আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে এশিয়ায় স্থানান্তরের এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রসিদ্ধ নীতি ও ভিশন থেকে দু’টি সুনির্দিষ্ট ইস্যু উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক, একটি হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং অপরটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পুননিশ্চিতকরণ।
বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি প্রদান করেন। অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি এই বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু কৃষি, শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগত পরিবর্তনের কথা বলেন। বৈষয়িক ও জনসম্পদকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতা কমিয়ে আনার লক্ষ্য সামনে রেখে উৎপাদন আরও বাড়ানোর কথা বলেন। এই বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ‘বিশ্বের সব রাষ্ট্র, স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ ও আন্তর্জাতিক মানবিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবক্ষেত্রে, বিশেষ করে অতীব প্রয়োজনীয় নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সরবরাহ বজায় রাখার জন্য আমাদেরকে উদারভাবে সাহায্য করার আবেদন জানান।
১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল স্বাধীন স্বদেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নীতি নির্ধারণী ভাষণ প্রদান করেন। এখানে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে এক কোটি মানুষকে আশ্রয় এমনকি অস্ত্র দেওয়ার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। এছাড়া রাশিয়ার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশের জনগণ, পত্র-পত্রিকা এমনকি আমেরিকার জনসাধারণের প্রতি ধন্যবাদ জানান । কিন্তু আমেরিকার সরকারকে ধন্যবাদ জানানো থেকে বিরত থাকেন। পাশাপাশি চীন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সতর্কতার সাথে মন্তব্য করেছিলেন।
সমৃদ্ধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে তার স্বপ্ন ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে। এই লক্ষ্যে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। মাত্র অল্প কয়েক মাসের মধ্যে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনাকে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন। এসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ছিল শূন্য। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোসহ অনেক অনতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা এবং বস্তুত কোণ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারাবদ্ধ নেতৃত্বের কারণে অর্থনীতি সচল হওয়া শুরু করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য শস্যের ব্যাপক ঘাটতি ছিল।
এটিও ভুললে চলবে না যে সেসময় বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সঙ্কট ও খাদ্য ঘাটতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল— বঙ্গবন্ধু খুবই সীমিত সম্পদ দিয়ে তাও মোকাবিলা করছিলেন। খুবই স্বল্প পরিমাণের সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক মানবিক সমর্থন নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী ও প্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের কারণে দেশের জনগণ তাদের নিজেদের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস— ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায়। এর পর থেকে দেশ উল্টোদিকে যাত্রা শুরু করে।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ পরিচালনা করে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশকে টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও আমরা আশ্চর্যান্বিত হই এই ভেবে যে— যদি আমরা আমাদের প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে না হারাতাম তাহলে আমরা কোথায় পৌঁছাতে পারতাম। তিনি ছিলেন একটি সংগ্রামী জাতির মূল বাতিঘর। তবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে আমাদের বিস্ময়কর ভ্রমণে তার কন্যাদ্বয় আমাদের মাঝে আছেন।
অবশ্য, আয় বৈষম্যের কুৎসিত মুখাবয়ব কিছুটা হলেও দৃশ্যমান যা করোনাকালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যার যোগ্য নেতৃত্বে একবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিখা শুধু বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়া নয় সমগ্র এশিয়ার রাজনীতিকে আলোকিত করার পাশাপাশি সর্বজনীন এই মানবতাবাদী আদর্শের আলোকবর্তিকা একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বকেও প্রভাবিত করছে। আজকের অনিশ্চিত এবং চ্যালেঞ্জিং সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রাসঙ্গিক। তার গণমুখী নীতির লক্ষ্য হচ্ছে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। তার ক্লান্তিহীন সক্রিয়তার মধ্যে সামাজিক অন্তর্ভূক্তিকরণ, ক্ষমতায়ন এবং ন্যায়বিচার এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিগত দশকব্যাপী বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে । এটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নীতি ও চালিকাশক্তি অনুধাবনের ক্ষেত্রে একটি অনন্য পরীক্ষা যা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহ অনুসরণ করতে পারে।
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (Economic and Social Commission for Asia and the Pacific[ESCAP]) এ বাংলাদেশের অবদানও বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব কর্তৃক মহাসমুদ্র ও ব্লু অর্থনীতির আঞ্চলিক সহযোগিতা ধারণা ২০১৬ সালে এ সম্পর্কীয় সিদ্ধান্তের পর থেকে প্রশংসিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক সংযুক্ততা, প্রযুক্তি, এবং ব্লু অর্থনীতির ক্ষেত্রে কৌশলগত অগ্রাধিকারসমূহে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে সাধারণ চ্যালেঞ্জসমূহের সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও রূপকল্প বাংলাদেশের সকল নীতি ও পরিকল্পনা স্তম্ভগুলোতে অনুরণিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলায় প্রদত্ত ভাষণের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার এই প্রবন্ধ পাঠ শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এবং আমি উদ্ধৃত করছি, “মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখভোগ করতে পারি। কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্ব-নির্ভরতা।”
আজ, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল দেশ যখন যুদ্ধ করছে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়ার উন্নয়ন এবং আন্তসীমানা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন তখন মানবতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় আশাবাদ ও বিশ্বাসের মধ্যে আমরা এর সমাধান খুঁজে পাই এবং মানুষের জন্য দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও সমৃদ্ধি বাস্তবায়নের প্রতি সম্মিলিতভাবে সমর্থন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই ।
[জাতীয় শোক দিবস ২০২০ উপলক্ষে গত ১৫ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় উপস্থাপিত প্রবন্ধ। ঈষৎ সংক্ষেপিত]
লেখক: অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক; পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল এবং অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।