Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আমার দেখা নয়াচীন’ ও বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় ভাবনা


১৬ আগস্ট ২০২০ ২১:৪৬

‘আমার দেখা নয়া চীন’ বঙ্গবন্ধুর লেখা মূলত একটি ভ্রমণকাহিনী। তবে গভীরভাবে দেখলে, এটি ভ্রমণকাহিনীর চেয়েও বড় একটি ক্যানভাস বলে মনে হবে। বইটিতে ১৯৫০ দশকে কমিউনিস্ট সরকারের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত চীন (যা ‘নয়া চীন’ নামে অভিহিত) ভ্রমণের বিভিন্ন স্থান দর্শন ও এর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের পাশাপাশি নিজস্ব আদর্শিক ভাবনাগুলোও বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদের এই পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এই ভ্রমণে চীনের সমাজব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ করে তার নিজের ধর্মীয় চিন্তাগুলো অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এসে সে দেশের সর্বত্র আমূল পরিবর্তন সাধনে সচেষ্ট হয়। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী নতুন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতেও চীন উদ্যোগ নেয়। প্রধানত এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৯৫২ সালের ২-১২ অক্টোবরে আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। চীন সরকারের আমন্ত্রণে স্বাধীনতাপূর্ব তৎকালীন পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু উক্ত সম্মেলনে অংশ নেন। এতে মোট ৩৭টি দেশ অংশ নিয়েছিল। তার এই ভ্রমণের মাঝখানে তিনি থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে যাত্রা বিরতি করেন। ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু ওই ভ্রমণের পাণ্ডুলিপি লিখেন, যা পরবর্তীতে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

বইটি পড়লে বুঝা যায়, বঙ্গবন্ধু রাজনীতির শুরুতেই বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপ কী হবে তার ভাবনাগুলো মুষ্টিবদ্ধ করেন। বিশেষ করে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে তিনি সে সম্পর্কে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তার আলোচনায় স্পষ্ট যে, তিনি সবসময় আধুনিক ও উদার মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি জানতেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই অংশে প্রায় ৯০ ভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং ইসলাম তাদের সমাজ, প্রথা ও আচার-আচরণে মিশে আছে। তবে অন্য ধর্ম ও মতের প্রতি সহনশীলতার ধারাকেও তারা আঁকড়ে ধরে আছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও মুসলিম হিসেবে গৌরববোধ করতেন। তার বইতে তিনি বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী। এবং নিজে একজন মুসলমান বলে গর্ব অনুভব করি।’ (পৃষ্ঠা ১১২)। তবে তার ধর্মচর্চার ভাবনাগুলো ছিল সেকুলার। এই সেকুলার দর্শন ধর্মহীনতা নয়, ধর্মকে রাজনীতিকরণ থেকে বিরত রাখা।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকেই এসেছে। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন তার ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ (নিউ ইয়র্ক, ২০০৫) বইতে এই ঐতিহ্যকে সকল ‘ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষতা’ (religious neutrality) অর্থে বুঝিয়েছেন। অমর্ত্য সেনের মতে, এই ধারাটি অশোক ও মুগল সম্রাটদের লালিত দর্শন থেকে উৎসারিত। পাশাপাশি, প্রাচীন বাংলাদেশ অঞ্চলে পাল রাজবংশের সহিষ্ণুতা ও অন্য ধর্মের প্রতি উদারতা বাঙালি মননে বিশেষভাবে ছাপ ফেলেছে। পরবর্তীতে বাংলায় মুসলিম শাসনব্যবস্থায়ও এই চর্চাটি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। (প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, ২০০৭)। বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণে সেই ধারাটির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে তার লেখনীতে।

বঙ্গবন্ধু ওই সময়ের চীন ভ্রমণে গিয়ে দেখতে পান, সেখানকার মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করছে। তাদের কারোর কোনো অভিযোগ নেই রাষ্ট্র বা শাসকদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে কেউ বিভাজন ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। তিনি মুসলিম চায়নিজদের সাথে একান্তে আলাপ করেছেন এবং ধর্মচর্চা বা রাষ্ট্রীয় চাকরিতে কোন বৈষম্য করা হয় কিনা তা জেনেছেন। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এবং আশ্বস্ত হয়েছেন যে, নয়াচীনে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। আগের চিয়াং কাই সরকারের সময়ে এমনটির নজির থাকলেও তা পরে আর দেখা যায়নি। আগের সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্যে নিজেরাই ধর্মীয় দাঙ্গাকে উস্কে দিত। বঙ্গবন্ধু তার বইতে নতুন চীনের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতার দিকটি তুলে ধরেছেন গুরুত্ব দিয়ে। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশেও চিয়াং কাই সরকারের মতো ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখার জন্যে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপকৌশল প্রয়োগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উস্কে দিতো।এর ফল হিসেবে উপমহাদেশে সংঘটিত অনেক হানাহানি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ কাটেনি এবং এজন্য কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলকে দায়ী করেন। বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোন ধর্মীয় কারণে হয় না। এটি কোন কোন গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেছেনে, ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলতো তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে চালাতে চেষ্টা করেছেন।’ (পৃষ্ঠা ১০৮)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নয়াচীন ভ্রমণ করে চীনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। সেখানে সম্প্রদায় হিসেবে কেউ রাষ্ট্রের কোনো সুযোগ পেত না। বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ পদ তাদের জন্য সংরক্ষিত এমনটি ঘটেনি। মুসলিমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ার পরও শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারের চাকরি, রাজনীতি ও সেনাবাহিনীতে স্থান পাচ্ছে। নয়াচীনের সরকার সকলকে ‘মানুষ’ হিসেবে বিচার করে, কে কোন ধর্মের তা দিয়ে বিচার হয় না। অন্যদিকে, মুসলিমরা সংখ্যায় লঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে যার ইচ্ছে ধর্ম পালন করতে পারে, কেউ তাদের বাধা দেয় না। কেউ ধর্ম পালন না করলেও কেউ তাদের জোর করে পালন করাতে পারে না। আইন করেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লেখক বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিনের সামাজিক ঐতিহ্য ও স্থিতিশীলতা ধ্বংসের জন্য ধর্মকে ব্যবহারকারী রাজনৈতিক নেতাদেরই বেশি দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই রাজনৈতিক নেতারাই নিজেদের স্বার্থের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের নেতৃত্ব রক্ষা করার জন্য। [তারা] জনসাধারণকে ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে তাদের শাসন ও শোষণ করতে চায়। এরাই দুনিয়ায় ধর্মকে মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে ধর্মের যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন ও করছে।’ (পৃষ্ঠা ১১৫)।

ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে যে কোন হানাহানির ঘোর বিরোধিতা স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে। নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মে ধর্মে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মের রাজনীতিকরণই এজন্য মূল কারণ। আবার একই কারণে একই ধর্মের ভেতরেও সমানভাবে রেষারেষি চলছে। যেমন, ইসলাম ধর্মে বহু মত ও পথের সৃষ্টি হয়েছে এই ক্ষুদ্র ও হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানী, ইসমাইলি, আগাখানি, মোহাম্মদি, ওহাবি ইত্যাদি নামে অনেক ধারা তৈরি হয়েছে। এদের কারোর মধ্যে সংঘটিত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কেবল হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা একে অপরের সাথে কলহে লিপ্ত নয়। একই ধর্মের ভেতর বিভিন্ন ধারার অনুসারীরাও এই চরম বাদানুবাদে জড়িত। শিয়া-সুন্নি দাঙ্গায় হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে খোদ পাকিস্তানের পাঞ্জাবে। আবার এই বিভাজনই অনেক সময় ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় এবং সিলেটের গণভোটের সময় এক শ্রেণির মাওলানা ভাড়া খেটে ফতোয়া জারি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রসঙ্গটিও বঙ্গবন্ধু তার বইতে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু এই ধরনের ক্ষুদ্র বিভাজন ও দাঙ্গা যে কোন মানবতার চেতনাকে বাধাগ্রস্ত করে বলে মনে করতেন। বঙ্গবন্ধু তার বইতে এসব বিভাজনের প্রসঙ্গ এনে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সামনে এনেছেন।

বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বইটিতে এর স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি দেখেছেন, চীনে প্রত্যেক মসজিদে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত পাশ করা ইমাম আছে এবং তারা ধর্মচর্চায় অবদান রাখছেন। ইমাম সাহেবরা বেতন পান, তাদের অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। তারা পেট বাঁচানোর জন্য মিথ্যা ফতোয়া দেয় না। তাদের তাবিজ-কবজ, ফুঁ-ফাঁ দিয়ে টাকা নিতে হয় না। কুসংস্কার তাদের সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ধর্মের ভেতরেও দীর্ঘদিনের কুসংস্কার দূর করার প্রাণপণে চেষ্টা চলছে। এই দৃশ্য দেখে বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশেও ধর্মের নামে কুসংস্কার দূর করার সুপ্ত বাসনা পোষণ করেন। ‘তাবিজ-কবজ ফুঁ-ফাঁ’, তথাকথিত হুজুরদের ‘বসে বসে টাকা নেওয়া’, ‘চারটা করে বিয়ে করা’, ‘৬০ বৎছর বয়সে ১৪ বছরের মেয়ে বিবাহ’, টাকার বিনিময়ে ‘ফতোয়া’ দেয়া, জনগণকে ‘ধর্মের নামে ধোঁকা’ দেয়া ইত্যাদি থেকে মুক্তি চেয়েছেন। নয়াচীনের ন্যায় এসব কুসংস্কার দূর করে আধুনিক মনস্ক সমাজব্যবস্থার প্রতি তিনি জোর দিয়েছেন বইটিতে। তিনি ওই সময়ের চীন ও তৎকালীন পাকিস্তানের তুলনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আজ আর কোন কুসংস্কার চীন দেশে নাই। ধর্মের দোহাই দিয়ে সেখানে আজ রাজনীতি চলে না, যা চলছে আজও আমাদের দেশে।’ (পৃষ্ঠা ১১৪)। তিনি বলেছেন, চীনের মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইমাম তৈরি করা গেলে আমাদের দেশের অনেক উপকার হতো, দেশ থেকে অনেক কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর হতো।

নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর লেখা বইটিতে। তিনি লিখেছেন, নয়াচীন ‘পুরুষ শ্রেষ্ঠ’ মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসেছে। আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এই প্রথা। সমস্ত চাকরিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে প্রবেশ করছে। পুরুষ ও নারীরা সমান শক্তি দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, যোদ্ধা সব পেশাতেই নারীদের উপস্থিতি দেখেছেন তিনি। এমনকি তারা জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলে-কারখানায় ও সৈন্যবাহিনীতেও দলে দলে যোগ দিচ্ছে। নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর এই সমান অধিকারের ফলে পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতিত হয় না। পূর্বের পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে।

তিনি লিখেছেন, ‘যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়াছি সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের ওপরে। নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়াছে জাতি গঠনমূলক কাজে। তাই জাতি এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ (পৃষ্ঠা ১০১)।

তবে বঙ্গবন্ধু একইসাথে আমাদের দেশের তৎকালীন হতাশাজনক চিত্রটিও তুলে ধরেছেন ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইতে। আমাদের দেশে আইন করে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্নতর। কিছুসংখ্যক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের ধারণা, ‘পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়।’ এই অবস্থাকে তিনি অত্যন্ত হতাশাজনক হিসেবে মনে করেছেন। এর জন্য প্রধানত মেয়েদের অর্থের জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন। কেউ কেউ ‘পর্দা পর্দা’ করে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাদের ঘরে বন্দী করে রাখতে চায়। তিনি বলেছেন, ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুসলিম মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিতো। আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতো। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা নিজে বক্তৃতা করতেন, ‘দুনিয়ার ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে।’ (পৃষ্ঠা ১০০)।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছেন যে, জনসাধারণের প্রায় অর্ধেক নারী এবং বিপুল সংখ্যক লোককে ঘরে বন্দী রেখে আলোর মুখ দেখা যাবে না। তিনি বলেছেন, ‘সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনোদিন বড় হতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা ৯৯)। তিনি নয়া চীনে যে নারীর ক্ষমতায়ন দেখেছেন তা তিনি নিজ দেশেও বাস্তবায়নের কথা ভেবেছেন। বর্তমান বাংলাদেশে এটা এখন অনেকটা বাস্তব। তবে এই পথে আরও বহু দূর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর নয়াচীন ভ্রমণ ছিল তার চোখ খুলে দেওয়ার মতো বিরল অভিজ্ঞতা। এই ভ্রমণ করার ফলে তার নিজ দেশের অবস্থান কোথায় আছে তা গভীরভাবে পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। একইসাথে, তার দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে তার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার অবচেতন মনে ছিল, এই দেশের অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ, তবে একটা অংশ ‘ধর্মান্ধ’। আবার ধর্মকে বাদ দিয়েও সামনে আগানো সম্ভব নয়। তাই ধর্ম সম্পর্কে সুচিন্তিত পরিকল্পনা করা এবং ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে কীভাবে এবং কতটুকু সম্পর্কিত করতে হবে তার সীমারেখা টানা ছিল তার দূরদর্শিতা।

‘আমার দেখা নয়াচীন’ মূলত একটি ভ্রমণকাহিনী হলেও কমিউনিস্ট বিপ্লবোত্তর চীনে ধর্মকে কীভাবে সমন্বয় করা হয়েছে এবং তা দেশের উন্নয়নের সাথে খাপ খাইয়েছে তিনি সেটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। চীন দেশের ভালো চর্চাগুলো বঙ্গবন্ধুর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। চীন ভ্রমণশেষে তিনি ‘জাতির আমূল পরিবর্তন’ এর উপর গুরুত্ব দেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘নতুন করে সকল কিছু ঢেলে সাজাতে’ বিভোর ছিলেন।

পরবর্তীতে আমরা দেখি তার এইসব ভাবনা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় এবং রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায়ও এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং নারী-পুরুষ ও ধর্মভেদে সকলের সমান অধিকার এবং স্বাধীন ধর্মচর্চার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। এর ফলে সকল স্তরে ‘ইনক্লুসিভ’ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে বক্তৃতায় এই বিষয়টি স্পষ্ট করেন, ধর্মনিরোপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। সবাই যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। কেউ কোন বাধা দিবে না। তবে ধর্মকে ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেয়া হবে না। (তালুকদার মনিরুজ্জামান, ১৯৮৬)।

বঙ্গবন্ধু ধর্মকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন তা অনেকটা মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের সাথে তুলনা করা চলে। মাহাথির ধর্মীয় কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে মালয়েশিয়াকে আধুনিক, উদার ও উন্নত মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুও তাই করতে চেয়েছিলেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা মালয়েশিয়া থেকে আরও ভিন্ন ও অনুকূল। ওই দেশের স্থানীয় মালয় মুসলিমরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬১.৩%, কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ অমুসলিমদের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত। এই বৈষম্যকে পূঁজি করে কোন কোন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দল কর্তৃক ‘ইসলামিক কার্ড’ প্রয়োগের চাপ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় সবাই একই জাতি, বর্ণ ও ভাষার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানে ধর্ম কোন গোষ্ঠীস্বার্থ বা ইস্যুর কারণে দৃশ্যমান হুমকির সম্মুখীন নয়। তাই এখানে ধর্মীয় কার্ড ব্যবহারে তেমন প্রাধান্য পাওয়ার সুযোগও সীমিত। ধর্ম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সেকুলার ভাবনাগুলো এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তার এই বইটি বড় ক্যানভাসে অনুধাবন করলে বুঝতে বাকি থাকে না যে কেন এই অঞ্চলে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বাঙালির মননে মিশে আছে; সেকুলার মূল্যবোধগুলো কেন এত শক্তিশালী; ধর্মীয় উগ্রবাদ কেন পরগাছার মতো-স্রোতহীন।

লেখক: ভ্যাট ইন্টেলিজেন্স এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেটের মহাপরিচালক; তিনি অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককুয়ারি ইউনিভার্সিটি থেকে ইসলাম, রাজনীতি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণা করেছেন।

আমার দেখা নয়াচীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর