বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে শহিদুল আলমের হীন কূটনীতি
১৮ আগস্ট ২০২০ ১২:১৬
শামীম আহমেদ
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন তার টুইটার অ্যাকাউন্টে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি ছবি দিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। কানাডিয়ান সময় ১৪ আগস্ট করা তার এই ছবিসহ টুইটটিতে তিনি লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুকে এই শোক দিবসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। ছবিটি ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট করে ঢাকা ফিরে একটি নতুন স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে অংশগ্রহণ করা তার প্রথম ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলনের।”
হাইকমিশনার মহোদয় তার ভাষায় তিনি লিখেছেন, “Remembering Bangabandhu with respect on this sad anniversary. Photo shows his historic first press conference at Claridges Hotel in London, January 1972, before he returned to Dhaka on a British aircraft to lead a newly independent Bangladesh.”
যারা কেবল ফেসবুকের সাথেই পরিচিত, টুইটার কী তা জানেন না কিংবা বোঝেন না, তাদের জন্য সংক্ষেপে বলছি; টুইটার কী? ফেসবুক যেমন ব্যক্তিগত জীবনযাপন প্রকাশ করার প্লাটফর্ম হিসেবে বেশী জনপ্রিয়, লিংকডইন যেমন জনপ্রিয় প্রফেশনাল প্লাটফর্ম হিসেবে, তেমনই টুইটার জনপ্রিয় সাম্প্রতিক ঘটনা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আপডেটের জন্য। মাত্র ১৬০ অক্ষরে ছোট ছোট আপডেট দেয়া হয় টুইটারে। পৃথিবীর প্রায় সকল রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সেলিব্রেটির টুইটারে অ্যাকাউন্ট আছে। সেখানে তারা সংক্ষেপে মতামত ব্যক্ত করেন। ফেসবুকের মতো ফ্রেন্ডলিস্টে ঢোকা, গল্প, কবিতা, গান, ছবির আধিক্য নেই বলে অনেকে টুইটারকে বেশী পছন্দ করেন। এই টুইটারেই ব্রিটিশ হাইকমিশনার তার মন্তব্য দিয়েছেন। ডিকসনের করা টুইটটি শেয়ার করেছেন যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা তাদের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও।
এছাড়া আরও অনেকে এই টুইটে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা আক্কু চৌধুরী লিখেছেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সালাম জানাই… জানুয়ারির যেদিন তিনি আমাদের মাঝে ফিরে এলেন সেটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন ছিল। ১৯৭১ সালে তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি এবং অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার হত্যাকাণ্ড ছিলো পরাজিত শক্তিদের একটি ষড়যন্ত্র, যারা পাকিস্তানীদের পদলেহন করে খানদানী বাঙালি হতে চেয়েছিলেন!”
দাতব্য সংস্থা “Seafarers UK” এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাথেরিন স্পেন্সার লিখেছেন, “দারুণ ছবি। এই ছবিটি আগে দেখিনি।”
এখানে উল্লেখ করতে চাই, ছবিটিতে বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়িয়ে তার দিকে গভীর মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদকে।
মহিউদ্দিন আহমদ আমার আপন বড় চাচা। একাত্তরে ইউরোপের পাকিস্তান দূতাবাসগুলোতে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম বাঙালি কূটনীতিবিদ, যিনি লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারির পদ ছেড়ে দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই খণ্ডের বিখ্যাত উপন্যাস “পূর্ব-পশ্চিম’ এর কথা। এটিতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ পরবর্তী ওপার বাংলা-এপার বাংলার কথা আছে। বাংলাদেশের বিক্রমপুর থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত বিস্তৃত এই উপন্যাসের ক্যানভাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা এবং কুশীলবের বর্ণনাও আছে এই উপন্যাসে। দেশ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি ২৫ বছর আগে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন এটি দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখনো হাজার হাজার মানুষ নিত্য এটি পড়েন। এই উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তিযুদ্ধের অবদান সম্পর্কে নিচের অংশটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করি- ‘……সেখান (ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি) থেকে ওরা (উপন্যাসের দুই চরিত্র- অলি ও বিশাখা) দুজনে চলে এলো ট্রাফালগার স্কয়ারে। লন্ডন শহরে যে কত বাঙালি থাকে, তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল এখানে এসে। আজ এখানে শুধু বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে। চতুর্দিকে বাঙালি মুখ। বাংলাদেশের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আজ এখানে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত। তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন…ট্রাফালগার স্কয়ারে সব সময় টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। আজ সেখানে প্রায় চার-পাঁচ হাজার বাঙালি এসে জড়ো হয়েছে। প্রথমে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হলো, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। তারপর বিভিন্ন বক্তা শোনাতে লাগলেন বাংলার গ্রামগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি। একজন প্রস্তাব তুললেন, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সকে পৃথিবীর সব দেশের বয়কট করা উচিত। কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়। একজনের বক্তৃতার মাঝখানেই হঠাৎ একটা উল্লাসের কোলাহল শোনা গেল। এইমাত্র লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাতে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠল, জয় বাংলা! জয় বাংলা!”
এ বিষয়ে চাচা মহিউদ্দিন আহমদের নিজের বক্তব্য শোনা যাক, তিনি বলেন, “একাত্তরের ১ আগস্ট, বাংলাদেশিদের বৃহত্তম সমাবেশটি হয় সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আমি সকাল সাতটার দিকে টেলিফোন করে বললাম, স্যার, এতো বড় একটি সমাবেশে যদি প্রকাশ্যে আমার পদত্যাগের ঘোষণাটি দিতে অনুমতি দেন, যুক্তরাজ্যের বাঙালি মহলে তো বটেই, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মিডিয়া জগৎ এবং কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস। অপরাধ বোধ করছি, স্যার। আবু সাঈদ চৌধুরী তখনই কিছু না বলে ১০ মিনিট পর আমাকে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন বললেন। ১০ মিনিট পর তিনি আমাকে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তার বাসায় যেতে বললেন। দ্রুতই আমার গাড়িটি চালিয়ে তার উত্তর লন্ডনের বাসায় চলে গেলাম। স্ত্রীকে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, কায়সার, খালেদ ও শিরিনের তত্ত্বাবধানে রেখে স্যারের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ট্রাফালগার স্কয়ারে যাই। তারপরের ঘটনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপরের উদ্ধৃতিতে আছে। সেদিন বিকেল থেকে রেডিওতে এবং পরদিন লন্ডন টাইমস-এর ওভারসিজ নিউজ সেকশনে আমাকে নিয়ে সচিত্র প্রথম এবং গার্ডিয়ান-এর পেছনের পাতায় বড় খবর। তিন সপ্তাহ পর, ২৩ আগস্ট প্রথম সন্তান অরুর জন্ম।” তাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সেই দিনগুলোর কথা আমরা ছোটকাল থেকেই পরিষ্কারভাবে জেনে বড় হয়েছি।
যাই হোক ফিরে আসি ব্রিটিশ হাইকমিশনারের টুইট প্রসঙ্গে। ওখানে শেখ ইয়াহিয়া খান প্রণব মুখার্জির একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন তার টুইট জবাবে, “বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বন্দরনায়েকে; এরা জীবিত থাকলে আজ হয়ত দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা অন্যরকম হতো। দূরদর্শী এই সকল রাষ্ট্র নেতাদের আজ বড়ই অভাব।”
নানা ধরণের টুইট এবং তার জবাবের মধ্যে আক্কু চৌধুরীর উত্তরটি খুবই প্রাসঙ্গিক এবং আলোচনার দাবীদার। আক্কু চৌধুরী একজন নামকরা এবং স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দীর্ঘ সময়ে বিএনপি, জামাতের নানামুখী প্রতিরোধের মুখে দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের নিদর্শনের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর আগে আক্কু চৌধুরী স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করে নেপালে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সেখানেই একটি রিসোর্ট বানিয়ে ব্যবসা ও বসবাস করছেন। তিনি নিজেকে বলেন “Global Citizen for Conscience”, এবং তিনি বর্তমান সরকারের একজন যৌক্তিক সমালোচকও বটে।
আক্কু চৌধুরীর কমেন্টের পরেই ব্রিটিশ হাইকমিশনারের টুইটে কমেন্ট করেছে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তার অন্যতম অবদান হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ফটোগ্রাফি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা। এছাড়াও দৃকের প্রতিষ্ঠাতাও এই শহিদুল আলম। শহিদুল আলম আলোচনায় আসে মূলত “নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে” মিথ্যা গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বিসিএসে কোটামুক্তি ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকলেও এর পেছনে মূল কল-কাঠি নাড়ে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদেরকে অর্থায়ন ও সাহায্য করে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারসহ অনেকেই। শহিদুল আলমের পরিবারের অতীতে যুদ্ধাপরাধের সংশ্লিষ্টতা আছে। এই ব্যাপারটা আমি অগ্রাহ্য করি যদি ব্যক্তি নিজে তার পারিবারিক সেই অতীতের জন্য অনুতপ্ত হন, এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত থাকেন। এই ক্ষেত্রে উদাহরণ দেয়া যায় সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খানের। তিনি তার বাবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবদানের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন, এবং নিজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; সেই প্রমাণ রেখেছেন।
কিন্তু শহিদুল আলম এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার নিজের ভেতর সবসময় স্বাধীনতাবিরোধী একটি অবস্থানের চিত্র পাওয়া যায়। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় তিনি আল-জাজিরাসহ বিশ্ব সংবাদ সংস্থাগুলোর কাছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যা বক্তব্য দেন। মিথ্যা গুম, খুন, ধর্ষণের সংবাদের পালে হাওয়া দেন, প্রচারে সাহায্য করেন। এবং আদতে তিনি স্বাধীনতাবিরোধী অন্যান্য শক্তিদের সহযোগিতায় এই আন্দোলনকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করে সরকার পতনের চেষ্টা করতে থাকেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন কামনা করা দোষের কিছু নয়। শাসন ব্যবস্থায় যে কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারেন এবং সেটি প্রকাশ্যে জানান দিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে জলজ্যান্ত উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। আসিফ নজরুল সরকারবিরোধী এবং তার লেখার মুন্সিয়ানায় তিনি সরকার বিরোধী নানা তথ্য কৌশলে ঢুকিয়ে দেন যা পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু তার লেখা গ্রহণ এবং বর্জন করার স্বাধীনতা মানুষের আছে। অন্যদিকে শহিদুল আলম একটি গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি নষ্ট করেছেন তা নয়, বিশ্ব মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের স্বাধীন সার্বভৌম চিত্রকে ভঙ্গুর দেখানোর চেষ্টা করেছেন এই আশায় যে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে যাতে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটানোয় সাহায্য করা যায়।
আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের এমন উদ্যোগ আমরা আগেও দেখেছি। বাংলাদেশ অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট কবীর চৌধুরী তন্ময়ের বক্তব্য থেকে জানা যায় শহিদুল আলম শাহবাগ আন্দোলনের সময় একই সাথে নানামুখী ভূমিকা রাখেন। একদিকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নিজেকে ব্লগার দাবী করতেন, অন্যদিকে যারা আসলেই ব্লগিং করতেন, এবং কাদের মোল্লার ফাঁসির আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তাদেরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ইসলামী মৌলবাদীদের উস্কে দিতেন। হেফাজত আন্দোলনের সময় অধিকার নামক সংগঠনের মিথ্যা তথ্যের সাথে সহমত পোষণ করে শহিদুল আলম আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আন্দোলনকারীদের হত্যার মিথ্যা গুজব ছড়ান। আদতে শহিদুল আলম যাদের সাথে কাজ করেন তারা সেদিন সরকারে পতন ঘটাতে না পেরে চরমভাবে হতাশ হয়েছিলেন, এবং পরবর্তী কাজের রূপরেখাও সেভাবেই গুছিয়ে নিয়েছেন বলে এখন প্রতীয়মান হয়।
শুধু তাই নয়, শহিদুল আলম ফটোশপের মাধ্যমে স্বাধীনতার পদক প্রদানের মিথ্যা ছবি অনলাইনে ছড়িয়েছেন। তিনি ফিল্ম মেকার হিসেবে জিয়াউর রহমানের দুটো ভুয়া কন্ঠস্বর যুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর বদলে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উত্থাপনের চেষ্টা করে ধরাও পড়েছেন। শহিদুল আলমের বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী শক্তির সহযোগী। শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ কুখ্যাত রাজাকার এম এ সবুরের দূর সম্পর্কের ভাগ্নি। উল্লেখ্য, কুখ্যাত রাজাকার এম এ সবুর একাত্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, ১৯৭২ সালে দালাল আইনে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার আওতায় ছাড়া পান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই বেইমান ১৯৭৬ সালে মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় সংসদ সদস্য তকমা গায়ে লাগান।
যাই হোক, শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ ২০১৪ সালে আরেক দেশদ্রোহী ডেভিড বার্গম্যানের আদালত অবমাননার দায়ে সাজা হলে তার পক্ষে জামায়াতপন্থী ৫০ বুদ্ধিজীবীর একজন হিসেবে বিবৃতি দেন। উল্লেখ্য, ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে সবসময় সক্রিয় ছিলেন এবং সারা বিশ্বে রাজাকারদের পক্ষে জনমত গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং আছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বইয়ে শহিদুল আলমের পরিবারের অন্য এক সদস্য পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৭১ সালে কাজ করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
শহিদুল আলমের এমন “মুক্তিযুদ্ধবিরোধী” অবদানের কথা লিখতে আজ বাধ্য হলাম ব্রিটিশ হাইকমিশনারের টুইটের জবাবে তার উদ্দেশ্যমূলক জবাবের কারণে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে শোক প্রকাশ করে যে বার্তা দিয়েছেন, শহিদুল আলম জবাবে সেখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে লিখেছেন, “Every father, mother, son, daughter, brother, sister, spouse, lover and friend of these people killed in ‘crossfire’ also mourn in Bangladesh. Which day of the year shall we allocate for their mourning?” ভাবানুবাদ করলে যা দাঁড়ায় শহিদুল আলম বলছেন, “বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত মানুষের জন্য তাদের বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, সহধর্মী, প্রেমিক এবং বন্ধুর শোক প্রকাশের জন্য বছরের কোন দিনটিকে আমরা শোক পালনের জন্য বরাদ্দ করতে পারি?”
শহিদুল আলমের এই জবাবটি সম্পূর্ণভাবে অযাচিত ও অপ্রাসঙ্গিক নানা কারণে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধু নিজেও নিহত হয়েছেন নজিরবিহীন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে। যদিও বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে বিচারের প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক, তবুও তাকে হত্যা করা হয়েছে এমনই একটি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। বলা চলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে “এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং” এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, যা আইনগত ভিত্তি পায় জিয়াউর রহমান সরকারের ইনডেমনিটি অ্যাক্ট পাস করার মাধ্যমে। জিয়াউর রহমানের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাসদস্যদের গণহারে হত্যা করা হয়, সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল কিংবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি তাদের। সেই যে অন্যায়ভাবে হত্যার শুরু তারই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া সরকারের আমলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে অপারেশন ক্লিনহার্ট নামক নজিরবিহীন মানব হত্যার অভিযানে নামানো হয় এবং তখন থেকেই মূলত বিচার বহির্ভূত ক্রসফায়ারের শুরু বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যদি আইনের ছত্রছায়ায় মানুষ হত্যার বিচার করতে হয়, তবে তার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায় নিতে হবে খালেদা জিয়া ও গোলাম আযম-নিজামির ২০০১ সালের সরকারকে।
শহিদুল আলম যে ষড়যন্ত্রের আগুনে হাওয়া দিতে গিয়ে নিজেদের ঘরে আগুন দিয়ে ফেলেছেন, সেটা বোধহয় সে কিংবা তার আশ্রয়দাতারা টের পাননি। শহিদুল আলম কি ভেবেছে বাংলাদেশের মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে? সেনা শাসনের পক্ষে? না। বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষই ক্রসফায়ার চায় না, বিচারবহির্ভূত হত্যা চায় না। বাংলাদেশের মানুষ অপারেশন ক্লিনহার্ট যেমন ভুলেনি, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর গোপালগঞ্জে সংখ্যালঘু নারীদের উপর ধর্ষণ অত্যাচারের কথা ভুলেনি, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে অন্যায়ভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যার কথাও ভুলবে না। সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না শহিদুল আলমের মতো মানুষদের কথা যারা এই দেশের মাটি শুষে ফুলে-ফেঁপে উঠে বহিঃবিশ্বে এই দেশকেই ছোট করতে বদ্ধপরিকর, ভুলবে না শহিদুল আলমের মতো মানুষকে যারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যাদের আনুগত্য এখনো পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি রয়ে গেছে।
শহিদুল আলম বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ করা জন্য অন্য যে কোনো একটি দিন বা মাধ্যম বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু ১৫ অগাস্ট জাতির জনকের মৃত্যুদিনে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের শোক বার্তায় তার জবাব দেখে বোঝা যায় এটি দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্ত্বার প্রতি সুপরিকল্পিত হামলার অংশবিশেষ। শহিদুল আলম তার জবাবের সাথে বিতর্কিত সংগঠন অধিকারের প্রস্তুতকৃত যে তালিকাটি সংযুক্ত করেছেন তা দেখলে বোঝা যায় তারা দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে শাহবাগ আন্দোলনের ব্লগারদের বিরুদ্ধে অবস্থান, নিরাপদ সড়ক চাই ও কোটা আন্দোলনে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির পক্ষে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, নিজের বাবা মায়ের ছবি নিয়ে কেরামতি করে স্বাধীনতা পুরস্কারকে হেয় করা, বঙ্গবন্ধুর জায়গায় জিয়াউর রহমানের মিথ্যা কন্ঠস্বর জুড়ে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার তথ্য বিকৃতি করা, নিউইয়র্ক কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের পতনের চেষ্টা করা এবং সর্বশেষ একটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকের অফিশিয়াল বক্তব্যের জবাবে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য ও তথ্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা থেকে এটি স্পষ্ট যে শহিদুল আলম বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এমন একজন দেশদ্রোহীকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকার প্রমাণ করেছে যে তারা গণতান্ত্রিক মত প্রকাশে বাধা দেয় না। কিন্তু সাথে সাথে এটিও মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আমরা বারবার ক্ষমা করে দিতে পারি না।
মনে রাখা দরকার যে, শহিদুল আলমের মতো সুশীল মানুষ যারা শুদ্ধ বাচনভঙ্গি ও পরিচ্ছন্ন পোশাকে অভিজাত এলাকায় ক্লাসিকাল সঙ্গীত বা সাহিত্যের চর্চা করে তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেননি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন ‘আঞ্চলিকতায় দুষ্ট’ সাধারণ কৃষক শ্রমিক যাদের মুখের ভাষা আটপৌরে এবং পরনের কাপড় মলিন। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার জন্য আমাদের সেইসব সাধারণ মানুষদের উপরই ভরসা রাখতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে শহিদুল আলমের মতো দুর্জনদের কাছ থেকে।
লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ হাইকমিশনার মহিউদ্দিন আহমদ রবার্ট সি ডিকসন শহিদুল আলম