বিভীষিকাময় রক্তাক্ত ২১ আগস্ট
২১ আগস্ট ২০২০ ১৮:৩৬
২১ আগস্ট, গ্রেনেড হামলার রক্তমাখা বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দুঃসহ স্মৃতি। ২০০৪ সালের এই দিনে মানবতাকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। অতর্কিত বোমা বৃষ্টি। সমস্ত মানবতা নিরবে নিভৃতে হার মেনে যায়। বোমা বর্ষণের মধ্য দিয়েও চলে পুলিশের গ্যাস নিক্ষেপ, অনবরত গুলিবর্ষণের মতো ভয়ংকর মহাপ্রলয়।পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের মূল উদ্দেশ্যই ছিল শেখ হাসিনা সহ আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। সেদিন মানবঢাল রচনা করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিলেন নেতাকর্মীরা কিন্তু ঝরে যায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ টি প্রাণ। আহত ৫ শতাধিক নেতা কর্মীর অনেকেই স্পিন্টারের দুর্বিসহ যন্ত্রনা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই। মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মানবঢাল তৈরি করেন শেখ হাসিনাকে নিরাপদ রাখতে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। গাড়িতে ওঠার সময় আওয়ামী লীগ প্রধানকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল যা শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করতে না পারলেও, তার দেহরক্ষী মাহবুবের প্রাণ কেড়ে নেয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীদের সাথে মিশে গেছে বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঠান্ডা মাথার খুনি। তাদের সঙ্গে ছিল তাজা গ্রেনেড। মূল টার্গেট আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। হামলা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে অতি গোপনে সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায়। যা সফল হলে হারিয়ে যেত আওয়ামী লীগ, এমনকি বদলে যেতে পারত বাংলাদেশের পুরো রাজনীতি।
নিরেট সাদামাটা চোখেও ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় চোখ রাখলে সাধারণের মধ্যে তৈরি হবে একটিমাত্র প্রশ্ন। কি ঘটেছিল সেদিন? কি ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন সময়ের নিকৃষ্টতম সেদিনের সেই কালো দিনটির?
আদালতে দেয়া হামলাকারীদের জবানবন্দি অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়-
ঘটনার আগের দিন ২০ আগস্ট মার্কেটের উপর থেকে সম্ভাব্য ঘটনাস্থলের পুরোটা ভালোভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে তারা। পুরো ঘটনার দায়িত্ব ছিল হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য আহসান উল্লাহ কাজল ও আবু জান্দাল। ঘটনার দিন একুশে আগস্ট। সকাল দশটার মধ্যে পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতরা রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের বাসায় মিলিত হয়। সেখানে যোগ দেয় আবু তাহের জাফর, জাহাঙ্গীর এবং মহানগর আমির আবু তাহেরসহ আরও কয়েকজন। যারা সরাসরি হামলায় অংশ নেবে তারা আলোচনার পর হামলার জন্য ১২ জনকে বেছে নিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ১৫ টি গ্রেনেড। তারপরই ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয় খুনিরা। ২১ আগস্ট আসরের নামাজের আগে গোলাপশা মাজারের পাশের পার্কের মসজিদে একত্রিত হয় সেই ১২ জন। একটু দূরেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। কিছুক্ষণ পর রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাবেশে যোগ দিতে থাকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শ্রেণীর নেতাকর্মীরা। খুনী ১২ জন ৪ জন করে ৩ টি দলে ভাগ হয়ে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সাথে মিশে যায়। এর মধ্যে জান্দাল, কাজল, বুলবুল আর লিটনের সমন্বয়ে গড়া প্রথম দলটি অবস্থান নেয় মঞ্চের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। শেখ হাসিনাকে হত্যার মূল দায়িত্ব ছিল এই দলের উপর। সবুজ, জাহাঙ্গীর, মাসুদ ও উজ্জ্বলের দলটি অবস্থান নেয় মঞ্চের পশ্চিম পাশে। আর মুত্তাকিম, মুরসালিন, আরিফ হাসান ও ইকবাল কে নিয়ে গড়া তৃতীয় দলটি অবস্থান নেয় মঞ্চের পশ্চিম-উত্তর দিকে। এই দুই দলের টার্গেট ছিল সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি সময়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ করতেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোঁড়ে ঘাতক জান্দাল। এরপর অন্য জঙ্গীরাও গ্রেনেড ছোঁড়া শুরু করে। এরপর একে একে ১১ টি গ্রেনেড এসে পড়ে সমাবেশে। প্রথম গ্রেনে্ডটি বিস্ফোরণের পর মঞ্চের ফাঁকা অংশ ফাঁকা হয়ে গেলে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেখানে দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ছোঁড়ার কথা ছিল জঙ্গি বুলবুলের। তবে প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরণের পর মানুষের ছোটাছুটিতে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় বুলবুলের আর গ্রেনেড ছোঁড়া সম্ভব হয়নি। পরে ভয় পেয়ে গ্রেনাডটি মাটিতে ফেলে পালিয়ে যায় সে। ধরা পড়ার পর হামলাকারী জাহাঙ্গীর তার জবানবন্দিতে বলেছেন, তার প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়ার পর রক্তাক্ত মানুষের চিৎকার আর ছোটাছুটিতে তিনি আর পরের গ্রেনেডটি ছুঁড়তে পারেননি। হামলা শেষে জঙ্গিরা যার যার মতো পালিয়ে যায়। হামলার পর আহসান উল্লাহ কাজল তার মোবাইল ফোনে মুফতি হান্নানকে জানিয়ে দেন অপারেশন সাকসেসফুল।
ওই ঘটনার আগে এবং পরে কি ছিল তৎকালীন সরকারের ভূমিকা? আওয়ামী লীগের সমাবেশে সবসময় বাড়তি নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকে। কিন্তু সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবকদের আশপাশের কোন বিল্ডিংয়ের ছাদে কোন অবস্থান নিতে দেয়নি। কি ছিল সেই রহস্যময় কারণ? সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা অবস্থায়, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কি ছিল সেই কারণ? বিস্ফোরণের পরপরই পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ও আহতদের সাহায্য না করে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর লাঠিচার্জ করে, আক্রমণকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। কি ছিল সেই কারণ? ঘটনাস্থল থেকে অপরাধের পড়ে থাকা আলামত জোগাড় না করে ডিটারজেন্ট পানি দিয়ে অপরাধের স্থান পরিষ্কার করে প্রমাণ নষ্ট করা হয় কাদের নির্দেশে? একটি রাষ্ট্র কখনই এর দায় এড়াতে পারে না।
গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন ২২ আগষ্ট মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
২০০৪ সালের ২২ অগাস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি।
নাটকীয়তা এখানেই শেষ নয়। জালাল উদ্দীন কে জজ মিয়া বানিয়ে সাজানো হলো মিথ্যে মামলা। একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত অধ্যায় জজ মিয়া। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনবাগ থানায়। ঢাকা থেকে সিআইডির অনুরোধ পেয়ে সেনবাগ থানা পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য সোর্স নিয়োগ করে। পরে ৯ জুন বেলা ১ টার দিকে জজ মিয়াকে আটক করে থানায় খবর দেয়। এরপর পুলিশ তাকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসে। পনের দিন সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গ্রেনেড হামলার মামলায় তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় যখন গণমাধ্যমে ফাঁস হয় যে জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো। আসামী করার বদৌলতে তার পরিবারকে টাকা দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায়, ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ২৮শে মার্চ বুধবার৷ এই মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়েছিল৷ আদালত ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছিলেন৷ আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ গ্রহণ করা হয়েছে। আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ই অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। এ নিয়ে ১১৯তম কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হল। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ কার্যদিবস ব্যয় করেছে। ঘটনার ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা হয়। এই মামলায় মোট ৪৯ জন আসামী ছিলেন। যাদের মধ্যে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৩১ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন। এছাড়া তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছে। বাকি তিনজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় গ্রেনেড হামলা মামলা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তি হওয়া দরকার যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জনের অন্যতম বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক।
রাষ্ট্র যখন রক্ষাকর্তা থেকে কাঠগড়ায় দাঁড়ায় তখন জাতি হিসেবে মানুষ হয়ে যায় অসহায় এবং বাকরুদ্ধ। মানবতা চলে যায় নির্বাসনে। প্রশ্নবিদ্ধ বিবেক কেবলই উপহাসের হাসি হাসে।