Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংগ্রাম ও অর্জনে ৪৪ বছরে যুব ইউনিয়ন


২৮ আগস্ট ২০২০ ২১:৪৯

এক
পুরোপুরি একটি বিরুদ্ধ সময় তখন। এ অবস্থায় যুব আন্দোলন, যুব মানসিকতা, নতুন কাজের ধারা, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় অসীম তারুণ্য নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। ঢাকার গোপীবাগে সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের বাসায় ১৩-১৪ জন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সদ্য-বিদায়ী ছাত্র, যাদের অধিকাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। গুমোট-অন্ধকার পরিবেশে সাহসের সাথে মোকাবেলা করার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৮ আগস্ট যে সংগঠন গড়ে তুলেছিল তার নাম ‘গণতান্ত্রিক যুব ইউনিয়ন’। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর যুব ইউনিয়নের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। পরের দিন তিনি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেফতার হন। ’৭৭ সালে প্রথম সম্মেলনে নাম হয় ‘বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন’। সম্মেলনে নুরুল ইসলাম নাহিদকে (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী) সভাপতি ও বুয়েটের ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রয়াত প্রকৌশলী আবুল কাশেমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

বিজ্ঞাপন

দুই
১৯৮৭ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা হলো। সে সময় বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করার কাজ শুরু হলো। দলে দলে ছাত্র-তরুণরা আসছে। সবাই স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে। যুব আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠলো। সেই সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মোহাম্মদ ফরহাদ চিকিৎসার জন্য মস্কোতে। হঠাৎ একদিন তিনি যুব ইউনিয়নের সবার উদ্দেশ্যে লিখলেন―‘আপনারা এতদিন পর বোধহয় পথ খুঁজে পেয়েছেন। আপনাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতার চিন্তা আসবে এ ধরণের কাজ থেকে আপনাদের উপরও আস্থা বাড়বে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, কমরেড ফরহাদের সেদিনের সেই চিরকুটটি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের আগামী দিনের কাজে প্রাণ সঞ্চার করেছে। প্রণোদনা সৃষ্টি করেছে যুব ইউনিয়নের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ভেতর। সেই চিরকুটটি বর্তমান নেতৃত্বের জন্যও একটি প্রেরণা।

বিজ্ঞাপন

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ’৯০-র গণঅভ্যুত্থান, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন, জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন, গণআদালত, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন, যুব কনভেনশন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি ইত্যাদি বহুবিধ কাজে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন এক সাহসী-উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছে। দেশের অগ্রসর ও প্রগতিশীল যুব গণসংগঠন হিসেবে যুব ইউনিয়ন কার্যকর যুব আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ সংগঠনটি সবসময় চেয়েছে যুবকদের অংশগ্রহণে সমাজতান্ত্রিকধারায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক বিকাশ, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার গণআন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ লক্ষ্যে দেশের যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। সাফল্য আছে অনেক।
বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন ঢাকা-সিলেট পদযাত্রা করেছে, সিমিটারের সাথে ভুয়া চুক্তি বাতিল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছে। এছাড়া প্রতিকূল অবস্থায় সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ নিয়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ আহুত অনশন আয়োজন করেছে। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এতে অংশগ্রহণ করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিক্ষেত্রে ব্যাংক ড্রাফট প্রথা প্রত্যাহার যুব ইউনিয়নের নিরন্তর আন্দোলনে সম্ভব হয়েছে। রোমাঞ্চকর সব ঘটনা। অসংখ্য সফল গৌরবগাঁথা।

তিন.
বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন উদযাপন করছে তার প্রতিষ্ঠার চুয়াল্লিশ বছর। এ মাহেন্দ্রক্ষণে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখন পর্যন্ত সকলকে স্মরণ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে। বহু প্রতিকূলতার ভেতর তাদের সংগ্রামে, শ্রমে শুরু হয়েছিল নবধারার যুব আন্দোলন। এদের নিরলস প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে যুবকরা আজও সংঘবদ্ধ হয়েছে। শক্তি বেড়েছে। আন্দোলনের চেহারা বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি আন্দোলন-গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। কাজগুলো খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন নানান ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যুব সমাজে একটি লড়াকু ও অগ্রসর সংগঠন হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছে। অনেক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত যুবকদের সংগঠন হয়ে রয়েছে, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনে শ্রমজীবী যুবকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় রাঙামাটির যুব ইউনিয়নের জেলা কমিটির সভাপতি শহীদ আবদুর শহীদকে।

চার.
পরিবর্তনকে শৃঙ্খলার আবদ্ধে রাখা যায় না। পরিবর্তন ভবিষ্যতকে উন্নত করে, প্রতিযোগিতার মান বাড়ায়, প্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধি ঘটায়। ইতিহাসও তার সাক্ষ্য বহন করছে। রাজা রামমোহন তুলে দিয়েছিলেন সতীদাহ প্রথা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছিলেন। মাস্টার দা সূর্যসেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে তরুণদের মধ্যে আদর্শ ও চেতনার জায়গাটিকে উস্কে দিয়েছেন। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্র, সৌমেন চন্দ, ইলামিত্র, মণি সিংহ-সহ সকলেই ছিলেন নতুন এক যুগের পথিকৃৎ। সমগ্র জাতি একসময় জেগে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলনে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। মাতৃভাষা রক্ষা করেছে প্রাণ দিয়ে। আজও যুবকরা প্রতিভার বিকাশে-সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে, প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে যুবকদের কৃতিত্ব দৃশ্যমান।

পাঁচ.
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা। ছেলে যুদ্ধে যেতে চান। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া সদ্য এক যুবক। মা কি তাকে যেতে দিতে চান। কিন্তু ছেলে নাছোড়। তিনি যুদ্ধে যাবেনই। মা জাহানারা ইমাম তখন বলে ফেললেন, ‘যা তোকে দেশের জন্যে কোরবানি করে দিলাম।’ রুমি যুদ্ধে যায়। যুদ্ধে শহীদ হয়ে গেলে মায়ের অবুঝ মন বার বার কেঁদেছে। ‘কেন এই কোরবানির কথা বলতে গেলাম’। কিন্তু এরকমই তো ছিলেন। আমাদের মায়েরা। ছেলেদের উৎসর্গ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য।

মায়ের একমাত্র ছেলে আজাদ পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ার পর মা তাকে বলেছিলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’ ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। মা ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন রমনা থানায়। গিয়ে দেখেন ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনদিনও ফিরে আসেননি, আর এই মা আরও ১৪ বছর বেঁচেছিলেন, কোনো দিনও ভাত খাননি।

মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে চার দশকের বেশি সময় আমরা পার করছি। স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তী উদযাপনে কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছি। বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের এ অশ্রুধারা, তার যতমূল্য তা কি কালের ধুলোয় হারিয়ে যাবে? মায়ের, বাবার, বোনের, ভাইয়ের এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটা ব্যর্থতায় হারিয়ে যাবে? এই যে ক্রিকেট বলে আমরা পাগলপারা, সেটাতো দেশকে ভালোবাসি বলেই। এদেশের যুবকরা বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। দেশপ্রেমে মন্ত্র হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, তারাও যুবক, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে জাতীয়তাবোধে সম্মানিত করছে।

এ বাংলাদেশে সম্ভব সকল অশুভ’র প্রতিরোধ আন্দোলন। এ আশা তো যুবপ্রাণরাই জাগিয়ে তুলেছে শাহবাগ থেকে পুরো বাংলাদেশ। একদিন এ জোয়ার শক্তিতে রূপান্তরিত জামাত-শিবির মুক্ত, যুদ্ধাপরাধমুক্ত বাংলাদেশে। সেই পাগলপারা দেশপ্রেমের, আমাদের তারুণ্যের অজেয় সম্ভাবনার দেশটির জন্ম হয়েছিল একটি শোষণ-বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। যেখানে সকলের জন্য ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা, মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকবে। সেটি আমরা করতে পারিনি এখনো। দেশের অমিত সম্ভাবনার এই যুব শক্তির অনেকটাই কর্মহীন। অথচ খবরে প্রকাশ, সরকারি চাকরিতে তিন লাখের উপরে পদ খালি রয়েছে।

ছয়.
করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন বসে থাকেনি। তারা দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মেহনতি-শ্রমজীবী মানুষের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেছে নিজস্ব উদ্যোগে স্যানিটাইজার উৎপাদন শুরু করে। এবং সেগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করে। এছাড়া প্রায় দশ সহস্রাধিক মানুষের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছে। উন্নতমানের মাস্ক তৈরি করে তা বিতরণ করেছে। এমনকি করোনাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া বেকার যুবকদের এককালীন ভাতা প্রদান ও কর্মসংস্থানের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তাছাড়া বন্যা, ডেঙ্গু মশক নিধনে এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করছে।

সাত.
কর্মসংস্থান সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’। একজন সাধারণ যুবক তার শিক্ষা জীবনের পরীক্ষা প্রস্তুতির পাশাপাশি, শিক্ষা শেষে চাকরি পেতে আর্থিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে হচ্ছে। দরিদ্র বাবার জায়গা-সম্পত্তি বিক্রি করে কিংবা সুদে টাকা নিয়ে হলেও চাকরি পাওয়ার জন্য এক ধরণের মানসিক পূর্ব প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হচ্ছে। একদিকে কর্মহীন যুবকদের ব্যাপকতা, অন্যদিকে সীমিত কর্মসংস্থান এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সারাদেশে ‘ঘুষ ছাড়া চাকরি চাই’ দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া সংসদসহ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুবকরা যাতে তাদের উদ্বেগের জায়গাগুলোকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য রাজনীতিতে মেধাবী যুবকদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বর্তমান যুগের যুবকদের বাড়তি সুবিধা হচ্ছে তারা অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে অনেক কিছু সম্পর্কে আগেই তথ্য জানতে পারছেন। এই সুবিধার কারণে যুবকরা সংসদ সদস্য হয়ে সংসদে এলে রাষ্ট্রকে একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দিতে তারা সক্ষম হবে। নাহলে সুস্থধারার রাজনৈতিক চর্চা কখনো হবে না এবং এ দেশ বিত্তশালী-স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিলের আঁতুড়ঘরে পরিণত হবে। তাই প্রত্যাশা- রাজনীতিতে সৎ, তরুণ-যুব নেতৃত্বের সুদিন ফিরে আসুক। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন সেই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ-যুব রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশ ও বৃহত্তর রাজনৈতিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সকল নির্বাচনে যুবকদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানাচ্ছে।

তথ্যসূত্র : সেই চিরকুটটি আর পাওয়া গেল না, মাহবুব জামান

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর

যুব ইউনিয়ন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর