Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘উকিলের হয়েচে জানা, কেবলি চুরের কারখানা’


১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:০৪

স্বাধীনতার পাঁচ দশক হতে চললেও আমরা অনেকগুলো মৌলিক সমস্যার সমাধান আজও করতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অচিরেই এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই। দুর্নীতিতে আমরা অনেকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, এখন চ্যাম্পিয়ন না হলেও কাছাকাছি আছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতভাবে আমাদের দৃশ্যমান উন্নতি দেখে যারা খুব পুলকিত তাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, উন্নতি অর্থ শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়; শুধু জিডিপি বাড়লে বা অবকাঠামোগত উন্নতি হলেই দেশের সার্বিক উন্নতি হয় না। উন্নতি সব দিক দিয়ে হতে হয়। এর সাথে সংস্কৃতি ও সভ্যতার যোগ থাকে। আমরা আমাদের সামগ্রিক জীবনমানের উন্নতি করতে পারিনি।

এটা ঠিক যে পুঁজিবাদের বড় লক্ষ্য হলো যেভাবে হোক পুঁজি বাড়ানো বা ধনী হওয়া। স্বাধীনতার পর পরই কোনো নিয়ম না মেনে সবাই ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতার নামার ফলে সমাজে অনিয়ম চরমভাবে বেড়েছে। আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি। সত্যিকারের গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগে এই চরম অনিয়ম দূর করার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। গণতন্ত্রের অভাব, সামরিকতন্ত্রের কুফল,আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে সত্যিকারের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হতে পারেনি। যার মাসুল আমরা দিয়ে যাচ্ছি। বর্তমান সরকার দুই যুগের অধিক ক্ষমতার থাকার পরও তেমন কোনো আলোর ধারা দেখাতে পারছে না ধারাবাহিক দুর্বৃত্তায়ন কারণে। এখনো আমরা সেই যাঁতাকলে আছি। পশ্চিমা পুঁজিবাদেও দুর্নীতি রয়েছে তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসনতান্ত্রিক শক্তি ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার কারণে তারা দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারে। আমাদের সে সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে বড় লোক হওয়ার সীমাহীন লোভের তাণ্ডবের কাছে আমরা ধরাশায়ী হচ্ছি।

এখন টিভির নিউজ বাচ্চাদের সামনে দেখা যায় না। খবর কাগজ লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রতিদিন একই রকমের বীভৎস -দুর্ধর্ষ সব খবর। চুরি, ঘুষ, জালিয়াতি, খুন, ধর্ষণ, খাদ্য-ওষুধে ভেজাল, নকল হাসপাতাল, লুটপাট, মাদকের ব্যবসা, ক্যাসিনোকাণ্ড, ত্রাণের চাল চুরি, বড় বড় প্রকল্পে চুরি, বালিশকাণ্ড লাল লাল কালিতে শত শত অমানবিক দুর্নীতির খবর। ভাবতে কষ্ট হয় আমরা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ করে একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক ও সাম্যের দেশ গড়তে চেয়েছিলাম।
সরকার জিরো টলারেন্স নিয়ে সব দমন করার ঘোষণা দিচ্ছেন। দুদক মাঝে মাঝে কাউকে ডেকে পাঠায়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিছু চুনোপুঁটি গ্রেফতার করে। তারাও আবার দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বের হয়ে আসে। আবার নতুন খবর আসে মহামারির সময়ে নকল হাসপাতালে বিনা টেস্টে করোনার জাল সার্টিফিকেট। মো. সাহেদ, সাবরিনা গ্রেফতার। এই দুইজন বা তাদের চ্যালাদের গ্রেফতার করে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাহীন অনিয়মের সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যা আরও গভীরে। অনেকেই হয়তো নানা কারণে মুখে অস্বীকার করবেন, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রকৃত সত্যিটা হলো আমাদের সব ডিজি অফিস বা মন্ত্রণালয় দুর্নীতিতে ভরে গেছে। কোনো মন্ত্রণালয়কে আলাদা করে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সরকারের মন্ত্রী সাহেব বা সচিবালয়ের অধীন ডিজি মহোদয় কিছুই করতে পারেন না; সেখানে সমন্বয়ের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। প্রশাসন ক্যাডারের ভয়ে সবাই তটস্থ। সমস্যার জড় এতোটাই গভীরে।

করোনা মহামারিকালের বাজেটে আমরা আশা করেছিলাম সরকার স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক কিছু করবে। যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু করার মত ঘোষণা আশা করেছিলাম যাতে দেশের ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্যখাত আলোর মুখ দেখবে। করোনার জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। অথচ মহামারির সময় আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কংকাল সবাই চোখে দেখেছে। সাহেদ-সাবরিনারা ধরা পড়ার পর আমাদের চরম অব্যবস্থাপনা সবাই দেখতে পেল। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে চিকিৎসার কোনো সুযোগ ও পরিবেশ নেই। চিকিৎসার সুষ্ঠু ও উন্নত সেবাসংস্কৃতি তৈরি হয় নি। সরকারি হাসপাতালের চরম অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে কেউ ভয়ে হাসপাতালে যায় না। নিতান্ত গরীব মানুষেরা বাধ্য হয়ে যায়, তাও ভর্তি হওয়া থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত যে সীমাহীন ভোগান্তি তাতে চিকিৎসা না নেওয়াই অনেকে শ্রেয় মনে করে।

বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে যা চোখে পড়ে তা পুরোপুরি ব্যবসা কেন্দ্র। অনেক হাসপাতাল অনুমোদনহীন, নকল। বড় চকচকে হাসপাতালে শুধুমাত্র বড় লোকেরা (যাদের অবৈধ টাকা আছে) চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পায়। এলিট শ্রেণি চিকিৎসা নেয় বিদেশে। আর মধ্যবিত্তের পরিণতি ভারত। প্রতি বছর যে পরিমাণ মানুষ চিকিৎসা নিতে ভারতে যায় তার হিসেব সরকারের কাছে না থাকলেও ভারত সরকারের কাছে আছে। ভারতের প্রত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ভারতে আগত বাংলাদেশিরা সে দেশের পর্যটন খাতের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। এর মধ্যে সিংহভাগ যায় চিকিৎসা নিতে। মাদ্রাজ বা চেন্নাইয়ের হাসপাতলগুলো লক্ষ্য করলে সেটা বোঝা যায়। সেখানের সিংহভাগ রোগী বাংলাদেশের। এর অর্থ দেশে প্রকৃত অর্থে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই।

দেশে প্রচুর সরকারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হয়েছে সেখানে কিভাবে ডাক্তারি পড়ছে ছেলেমেয়েরা তার চিত্র পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। বেসরকারি কলেজের মান নিয়ে তো মন্তব্য করার কিছু নেই, কারণ সেটা তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; তারা যে টাকা দিতে পারে তাদের ভর্তি করায়। এখন বিদেশি শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধেক। আমাদের অবকাঠামো ও জনশক্তি ব্যবহার করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়ানো কতদূর যুক্তিসঙ্গত সেটা ভেবে দেখা দরকার। পৃথিবীর কোথাও এত সহজে ডাক্তারি পড়া যায় না। শুধু টীকা দেওয়া ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের আর তেমন কোনো পজিটিভ কাজ চোখে পড়ে না। এই হলো স্বাস্থ্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের কাজ কর্ম। নতুন ডিজি মহোদয় কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ তার জন্য তো নতুন কোনো রাস্তা তৈরি নেই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরে সব মন্ত্রণালয়ের অবস্থা প্রায় একই রকম। সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে। দেশের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র যে মন্ত্রণালয় তার কাজকর্ম যদি এরকম হয় তাহলে দেশের সার্বিক সুরক্ষা ও সুব্যবস্থা কিভাবে সম্ভব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার পরিচয় আমরা পেয়েছি; তবে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না এই দুর্বৃত্তায়ন। সাগরের ঢেউয়ের মতো গতি নিয়ে আসছে নষ্ট দুর্বৃত্ত চোরের দল। কবি হূমায়ূন আজাদ তার কবিতায় লিখেছিলেন, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। আমাদের মনে হয়, গেছে। আমেরিকা বা ইউরোপের আগে আমরা সভ্য ছিলাম। ইংরেজি ভাষা সমৃদ্ধ হওয়ার আগে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচিত হয়েছে। তারা উন্নতি করতে পারলে আমরা পারব না কেন?

সরকারের অনেক পরামর্শক আছেন, জানি না তারা কী করছেন। আমাদের সামাজিক মানবিক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়াতে হবে এবং তার নির্যাস কাজে লাগাতে হবে সত্যিকার অর্থে। কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল কাজে লাগিয়ে আমরা ইতিমধ্যে সফলতা পেয়েছি। সামাজিক ও মানবিক গবেষণার ফলাফল সরকারকে কাজে লাগাতে হবে। নদীবিধৌত এই দেশে নদী গবেষণার সুযোগ ছিল, সেটা আমরা কাজে লাগাতে পারি নি। আমাদের নদী বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, অন্য খাতেও বিখ্যাত গবেষক, বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তারা দেশে বিদেশে যেখানে থাকুন তাদের কাজে লাগাতে পারলে আমরা লাভবান হতাম। আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যত নদীগুলোকে শেষ করে ফেলেছে। তারা এমন ব্রিজ বানায় যে নদীতে নৌকা চলতে পারে না। এমন বাঁধ দেয় যে স্থায়ী জলাবদ্ধতা হয়ে থাকে।

দেশের যারা প্রকৃত মেধাবী বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের পরামর্শ নিয়ে, গবেষণার ফলাফল নিয়ে আমাদের এগুতে হবে। প্রয়াত লেখক ড. আনিসুজ্জামান এক লেখায় বলেছিলেন, সরকার আমাদের ডাকেন, তবে আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন না। আমাদের ব্যর্থতাকে আমরা বরণ করতে পারি না, আমাদের এই দুর্বৃত্তের অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে সফল করতে হবে।

বহুকাল আগে লোককবি ও গায়ক উকিল মুন্সি লিখেছিলেন, ‘উকিলের হয়েচে জানা, কেবলি চুরের কারখানা।’ আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু গভীর উপলব্ধি থেকে রাগে ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় তেলের খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। এই সব সত্য কথন আমাদের সামনে থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রকৃত অর্থে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি নি। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে সঠিকভাবে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর