রাজনীতির ঘুঘুরা এখন কোথায়?
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১৭
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু ঘুঘু চরিত্রের নেতা আছেন। এদের আমি খল চরিত্র বলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, বয়স সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্কে খুব খারাপ শব্দ ব্যবহার করতে মন সায় দেয় না। কিন্তু বস্তুত গত কয়েক বছর ধরে তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা অন্তত আমার মতো আরও অনেকের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন। তবে তাদের শ্রদ্ধা করেন এমন মানুষও দেশে নিশ্চয়ই আছেন। আমাদের দেশে আমরা অনেকেই অনেকের সঙ্গে মারাত্মক সব আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই চরম ঘৃণিত ব্যক্তিটিরও কারো না কারো সমর্থন, সহানুভূতি পেতে অসুবিধা হয় না।
যাহোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। বছর দুয়েক আগে আমার এক সজ্জন সাংবাদিক বন্ধু তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘বি চৌধুরী, ড.কামাল হোসেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মান্না প্রমুখ জোট বেধেও যদি কোনো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবেন না বলে শিওর/ওভার শিওর হয়েই থাকেন,তাহলে তাদের নিয়ে এতো আলোচনা কেন?’
আমি তাৎক্ষনিকভাবে ফেসবুকে যে জবাব দিয়েছিলাম সেটা প্রথমে উল্লেখ করে পরে আমার মূল আলোচনায় যেতে চাই। আমি লিখেছিলাম, ‘আলোচনা করছে কারা? কিছু জনবিচ্ছিন্ন ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট, খুচরা গণমাধ্যম এবং আওয়ামী লীগবিরোধী গণমাধ্যম তো? বি চৌধুরী, কামাল হোসেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মান্নাদের নিয়ে যারা আশার উচ্চ মিনার গড়ে তুলছেন তারা রাজনীতির অ আ ক খ কিছুই জানেন না। কোনো বিশেষ শক্তির সহযোগিতা ছাড়া তাদের কোনো মূল্য নেই। তাদের নিয়ে মাঝেমাঝে স্বপ্নসৌধ রচনা করা বা সুবচনের মালাগাঁথা আমাদের সৌখিন রাজনীতিচর্চাকারীদের একটি উত্তম বিনোদন মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির জন্য যে ত্যাগ, সাহস এবং নিষ্ঠা থাকা দরকার সেটা এদের নেই। এরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে চিন্তাভাবনায় তারা সবাই চরম স্বৈরাচারী। তারা রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন বা আনবেন বলে যারা মনে করেন, তাদের দুদণ্ড শান্তি দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন কবির কল্পনার ‘নাটোরের বনলতা সেন’।
আমার এই মন্তব্য কথিত নেতাদের ভক্তদের মনে কষ্ট দেবে জেনেও আমি এটা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবেই বলতে চাই যে রাজনীতিতে ভালো কিছু দেওয়ার ক্ষমতা, সামর্থ্য– কিছুই তাদের নেই। এরা আলোকলতা। অন্যের ডালপালা অবলম্বন করে সৌন্দর্য দেখায়, নিজেদের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই।
ড. কামাল রাজনীতির পাদপ্রদীপে এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বদান্যতায়। তিনি বড় আইনজীবী। বিদেশে শিক্ষালাভ করেছেন। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু তিনি বারবার এই শক্তির হয় অপব্যবহার করেছেন অথবা অপচয় করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা-পরবর্তী সময়ে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কাপুরুষজনোচিত। তিনি যদি সাহস নিয়ে দাঁড়াতেন, বিশ্বাসীর প্রতি খুনিচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাতেন তাহলেও বাংলাদেশকে একটি সুসংবাদ দিতে পারতেন। তিনি তার কিছু না করে পলায়ণবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি এখন হাসিনাবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। নিতেই পারেন। কিন্তু তিনি কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে শেখ হাসিনা শাসনের অবসান হলেই বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত হবে? আওয়ামী লীগের অসৎ বা দুর্নীতিবাজ সরকারের বিপরীতে কাদের নিয়ে তিনি সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকার গঠন করবেন?
বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক কৌতুক চরিত্র ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আওয়ামী লীগ নেতা কফিলউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র বি চৌধুরীকে রাজনীতিতে এনেছেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। তিনিও জিয়ার আলোয় আলোকিত। ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধ থাকলে তার মতো প্রবীণ মানুষের রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত ছিল। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যেভাবে তাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতাড়ন করেছিলেন, তিনি এত সহজে তা ভুললেন কীভাবে? তিনি ২০০১ সালের আগে আওয়ামী বিদ্বেষী যে নির্বাচনী প্রচারচিত্র বানিয়েছিলেন, সেটা কি তার মর্যাদার সঙ্গে মানানসই ছিল? রাজনীতি তাকে কেন এখনও টানে? কারণ ক্ষমতার রাজনীতি সম্পদ অর্জনের যে অবাধ সুযোগ দেয়, অন্যকোনোভাবে সেটা সম্ভব নয়।
ড. কামাল এবং ডা. বি চৌধুরীর মতো রাজনীতিবিদদের ভীরুতা, আত্মসমর্পণবাদিতা, সুবিধাবাদিতার কারণেই আজ দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ লুটেরা-দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে বা যাচ্ছে। তাদের তো বিত্তবৈভবের অভাব নেই। খাওয়া-পরার অভাব নেই। তাহলে তারা কেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে নামছেন না? কেন এই ঘোষণা দিচ্ছেন না যে, দেশের মানুষ যদি তাদের দেশ শাসনের সুযোগ দেন তাহলে তারা নিজেরা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নেবেন না এবং তাদের সরকারের কেউ অন্যায় ও দুর্নীতি করলে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করা হবে। তারা এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কারণ এখন তারা তার ভাগীদার হতে পারছেন না। বি চৌধুরী যখন ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন তখন তার মন্ত্রণালয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি? তখন তার ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়েনি? তার সুবাদে তার পুত্র মাহী বি চৌধুরী একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ পাননি? তারেকের সঙ্গে মাহীর দ্বন্দ্ব কি কারণে তৈরি হয়েছিল?
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার একটি ভক্ত বা সমর্থক গোষ্ঠী আছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার গৌরবে তিনি গৌরবান্বিত। কিন্তু রাজনীতিতে তার অবস্থান বিএনপির অনুকূলে। তিনি বঙ্গবন্ধুরও প্রশংসা করেন আবার খালেদা জিয়ারও পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি যে রাজনীতিতে সব সময় সমান সক্রিয় থাকেন তা নয়। বিশেষ বিশেষ সময়ে তাকে অতি সক্রিয় দেখা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করার কাজটি তিনি গত কয়েক বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাচ্ছেন। তাতে তার কী অর্জন কিংবা রাজনীতির গুণগত মান পরিবর্তনে কতটুকু ইতিবাচক অবদান রাখছেন, সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
রাজনীতির আরেক ডিগবাজি বিশারদ মাহমুদুর রহমান মান্না। ছাত্র আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ডাকসুর একাধিকবার ভিপি নির্বাচিত হয়ে ভেবেছিলেন তার মতো জনপ্রিয় মানুষ আর নেই। তিনি বার বার রাজনৈতিক দল বা অবস্থান বদল করেছেন। জাসদ, বাসদ, আওয়ামী লীগ কিছুই বাদ নেই। এখন নিজেই একটি নতুন দোকান খুলে জোটে সামিল হয়ে আরও বড় কিছুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। তার এই ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনো খানে’ মার্কা রাজনৈতিক অস্থিরতা কার্যত তাকে হাস্যকর রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত।
আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকীও রাজনীতির এমন দুই চরিত্র, যাদের অবস্থা গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। তারা নিজেরাই নিজেদের রাজনীতির কৌতুক চরিত্রে পরিণত করেছেন। কিছু গণমাধ্যম এই রাজনীতিকদের নাম মাঝে মাঝে প্রকাশ করে তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে এই করোনাকালে তারা গভীর আইসোলেশনে আছেন বলেই মনে হয়। তারা এখন আর সেভাবে জাতির উদ্দেশে কোনো বাণীও দিচ্ছেন না। মানুষের দুঃসময়ে যারা শীতনিদ্রায় কাতর থাকেন তারা কীভাবে রাজনীতির পালে হাওয়া তুলবেন?
জাতির বিবেকের ভূমিকায় নামতে হলে এই সব রাজনীতিকদের এখন জাতির সামনে জবাবদিহি করতে হবে। অতীতে যেসব ভুল করেছেন তা স্বীকার করে ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি না করার অঙ্গীকার করতে হবে।
রাজনীতির ঘুঘুদের মানুষ চিনতে পারছে । তাই বার বার ধান খেতে নিতে চাইবে কি? গণমাধ্যমে তাদের নাম এখন আসছে বলে মনে করার কারণ নেই যে রাষ্ট্র ক্ষমতাটা তাদের নাগালের মধ্যে এসেছে।
পরিশেষে সেই চীনা প্রবাদটা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই, ‘মৃত সিংহের চেয়ে জীবন্ত কুকুর শ্রেয়’।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আ স ম আবদুর রব ড. কামাল হোসেন মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনীতি