Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা সমস্যার তিন বছর: নারী-শিশুদের বাস্তবতা ও প্রত্যাবর্তন


৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:২৫

খুব নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ঘটনার শুরু।  মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে, গ্রামের অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়, ব্যাপক যৌন সহিংসতা চালায়। ফলে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। মানবিক এই বিপর্যয়ে রাষ্ট্র হিসেবে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। মানুষ হিসেবে মানবতার দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়।  এর পর থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। ২৫ আগস্ট, ২০১৭। শুরু হয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ। নাফ নদী পার হয়ে ছোট ছোট নৌকায় তারা আসতে থাকেন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাজুড়ে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের জেলা কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায়। তার মধ্যে টেকনাফ এবং উখিয়া অন্যতম।

বিজ্ঞাপন

এরপর এতদিনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার কথা ছিল, ফিরিয়ে নেবার কথা ছিল, কিন্তু আজ তিন বছর পরে এসে বাস্তবতা হলো, জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ১৫ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা কম নয়। বেশিরভাগ পরিবারে কোনো পুরুষ নেই, অধিকাংশই নারী ও শিশু। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় নিয়োজিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি নারী ছিল। বিভিন্ন ততথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ৯০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে।  কোন কোন দফতরের হিসেব মতে এই সংখ্যা লক্ষাধিকও হতে পারে। কেননা, ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিলো, সেই বছরেই প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক শিশু জন্ম নেয়।

বিজ্ঞাপন

এই বিপুল সংখ্যার নারী ও শিশুদের রয়েছে নানারকম মানবিক নিরাপত্তা ঝুঁকি। এর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং মানব পাচারসংক্রান্ত নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়। শুরুর দিকে প্রায় ৫৪ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীর প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পুষ্টি সহায়তা সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকার আশঙ্কা থাকলেও পরবর্তীতে ক্যাম্পে স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে এখন সেই ঝুঁকি অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু বেড়েছে সহিংসতার আশঙ্কা ও ঝুঁকি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা একটি এনজিও এর মহিলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র  থেকে পাওয়া তথ্য সূত্রে, করোনার আগে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৯টি আশ্রয় শিবিরের প্রায় ২১ হাজার ৫১৭ জন মহিলা ও মেয়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রমাণ ও সম্ভাবনা পাওয়া যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ৫৭ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের,  ২২ শতাংশ সম্পদ ও পারিবারিক সুবিধা বঞ্চনার রিপোর্ট করেছেন ১৬ শতাংশ মানসিক বা মানসিকভাবে নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন, ৩ শতাংশ ধর্ষণ এবং ২ শতাংশ অন্যান্য ধরণের যৌন নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। এসকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংগঠিত ৮১ শতাংশ সহিংসতাই পারিবারিক সহিংসতা। অনেকক্ষেত্রে আত্মীয় পুরুষদের দ্বারাই ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। পারিবারিক সংস্কৃতি, নারীদের ক্ষমতায়নের অভাব নানারকম কারণে এসকল সহিংসতা হচ্ছে বলে ক্যাম্পে কাজ করা সংস্থাগুলো মনে করছে।

সাম্প্রতিক লকডাউন ব্যবস্থাসমূহের কারণে “শিশু এবং মহিলা-বান্ধব জায়গাগুলি”-তে কাজ করা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা তদারকি সহ সকল সুরক্ষা কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে। নারী অধিকারকর্মীরা বলেছেন যে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের কাছে পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান রিপোর্ট রয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে, মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীরা সমর্থন এবং সুরক্ষা পরিষেবাদি দূর থেকে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। জাতিসংঘের একটি শরণার্থী সংস্থা, “লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা থেকে বেঁচে থাকাদের জন্য অতীব জরুরি সেবাগুলি অত্যাবশ্যক হিসাবে চিহ্নিত করা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য সহজগম্য” নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কা ছাড়াও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টাও উদ্বেগের কারণ।

নানারকম আশঙ্কার সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে করোনা সংক্রমণের আতংক। গত ২৩ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণ শুরু হবার পর প্রায় ৩ হাজার ৮০৯ জন রোহিঙ্গার নমুনা সংগ্রহ করা হয় যাদের মধ্যে ৮৭ জনের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, এদের মধ্যে মারা গেছেন ৬ জন। আক্রান্তদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) আইসোলেশন সেন্টার ও এমএসএফ হসপিটালে আইসোলেশনে চিকিৎসা চলছে। এছাড়া আক্রান্ত পরিবারগুলোর ২শ’ মানুষকে নিজ নিজ ঘরে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন করোনা রোগী বাড়ছে। সেখানে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব এবং অন্যান্য নির্দেশনাও মেনে চলা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সকল আশঙ্কাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই লাখ লাখ মানুষ তাদের মতোই, তাদের নিয়মেই চলছেন। এতে করে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। সেই সাথে স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো এসকল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে উঠতে হবে হাজার হাজার কিশোরীদের। হাজার হাজার মায়েদের নিশ্চিত করতে হবে তাদের নিজেদের এবং মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা আর সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। তারা মনে করেন রোহিঙ্গা নারী ও মেয়ে শিশুদের ক্ষমতায়নের একটি হাতিয়ার হলো জ্ঞান অর্জন, এর কোন বিকল্প নেই। এই সকল রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী কিশোরীদের জীবন তাদের সামনের দিনগুলোতে কঠিন ও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে আর তাই রেডিও লিসেনারস ক্লাব এবং ইনফরমেশন অ্যান্ড ফিডব্যাক সেন্টারগুলো মূল্যবান জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নারী ও মেয়ে শিশুদের ক্ষমতায়িত করছে। এসকল ক্লাবে যোগদানের পরে ক্যাম্পের কিশোরীরা আরও সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বর্তমানে ৯৩টি রেডিও লিসেনারস ক্লাবে সহযোগিতা করছে নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর মধ্য দিয়ে ৯৩০ জন কিশোরী এবং ১৩৯৫ জন কিশোর সেবা পাচ্ছে।

এ সকল ক্লাবে মানবপাচার, শিশু বিয়ে, কন্যা শিশুর শিক্ষা এবং কোভিড-১৯ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নারী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন গ্রুপ ও আদর্শ মায়েদের নিয়ে কাজ করছে এ সংস্থাটি। তাছাড়া রোহিঙ্গা কিশোরী মেয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে তাদের সমবয়সীদের কাছে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অভিযোগ করা বা পরামর্শের ব্যবস্থা কমিউনিটিতে নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করছে তারা। ঘরে ঘরে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ও মেয়ে শিশুরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। শিশুদের সঠিকভাবে হাত ধোয়া শেখানো থেকে শুরু করে অপুষ্টির ঝুঁকি প্রশমন, প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে নারীদের অবগত করাসহ জীবন রক্ষাকারী তথ্য প্রদান এবং সব ক্ষেত্রে আচরণগত পরিবর্তনে নারী কমিউনিটি কর্মীরা দারুণ ভূমিকা পালন করছেন।

সম্প্রতি ২৫ আগস্ট, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট সহ তার পথচলার তিন বছর পূর্ণ করেছে। এই তিন বছরে বাংলাদেশকে নানারকম উদ্ভূত মানবিক ও সামাজিক সংকটের মোকাবেলা করতে হয়েছে। সামনের দিনগুলোতেও বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে যেতে হবে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য। স্থানীয় বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, শিক্ষা, ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি এবং পরিবেশ-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া পর্যন্ত, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাহিদা মেটাতে ও জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার এবং সেক্ষেত্রে প্রায় ৬১টি নিবন্ধিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করে যাচ্ছে।

নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের বুকে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ, এই বিষয়টি যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে এই বিপুল জনসংখ্যা সামনের দিনগুলোতে নিজেরাও যেমন সংকটের মুখে পড়বে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও নানাবিধ সংকটে ফেলবে।  তাই আদতে নিরাপদ প্রত্যাবাসনই এর একমাত্র সমাধান।  ২৩ নভেম্বর, ২০১৭ বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৩০০ এবং প্রতি সপ্তাহে ১৫০০ করে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফেরত যাবার কথা এবং দু’বছরের মধ্যে এভাবে সকল উদ্বাস্তুকে মিয়ানমার সরকারের ফেরত নেওয়ার কথা। এই উদ্দেশ্যে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ দু’দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠন করা হয়। বলা হয়েছিল যে, মিয়ানমার সাইডে দু’টি ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। একটিতে উদ্বাস্তু গ্রহণ করা হবে, দ্বিতীয়টিতে যাচাই-বাছাই করা হবে। ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে এই প্রত্যাবসানের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অসহযোগিতার কারণে তা শুরু না হয়ে স্থবির হয়ে যায়।

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য শক্তিশালী দেশ, বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বশক্তি হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অমানবিকতার অবসানে এগিয়ে আসতে হবে।

যেহেতু নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনই একমাত্র সমাধান, সেই প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশের আরও কৌশলী হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ যা করতে পারে-

এক
জাতিসংঘের প্রস্তাবিত সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনের মূল শর্ত হিসেবে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক তাদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করিয়ে নিতে হবে। জাতিসংঘের সদস্য দেশ ও সংস্থাগুলোর একসঙ্গে একযোগে দাবি উত্থাপন করতে হবে যে, এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকারের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাদের আগের বাসস্থানে পুনর্বাসন করতে হবে, তাদের ভূমির মালিকানা বা অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রান্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণসূচক সহায়তা লাভের অধিকার স্বীকার করতে হবে।

দুই
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃথিবীব্যাপী ম্যাগনিটস্কি মানবধিকারের জবাবদিহিত্ব সম্পর্কিত আওতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। এই আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মানবতাবিরোধী যে কোন ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবহারের সুযোগ না দিতে, যে কোন অপরাধী ব্যক্তির আর্থিক সম্পদ জব্দ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তার বা তাদের আগমন বন্ধ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ করে মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট সামরিক অফিসারদের এই কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিশ্বব্যাপী ম্যাগনিটস্কি আইনের আওতায় তালিকাভুক্ত করার দাবি জানানো যেতে পারে। এছাড়াও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তরফ থেকে বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করার প্রস্তাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ইউরোপীয় আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করতে পারে। স্পেনের পিনোচেটের বিরুদ্ধে এই ধরনের আদালত গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউরোপ যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল।

তিন 
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে হত্যা, ধর্ষণ ও অত্যাচার করেছে তার সাক্ষ্য-প্রমাণাদি যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এই সব সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকার, বিশেষত তার সংশ্লিষ্ট সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করা সহজ ও সম্ভব হবে। সেইজন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউনসিল গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার লক্ষ্যে বিশেষ আদালত স্থাপন করার প্রস্তাব দিতে পারে। আশা করা যায়, এই আদালত স্থাপনকল্পে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রাশিয়া বা চীন বিরোধিতা করবে না। কেননা রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ২০১৮ সালে তিনটি ইতিবাচক প্রস্তাব করেছিল। তিন ধাপের প্রস্তাবে প্রথমটি রাখাইনে দ্রুত অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব। এতে বলা হয়েছিলো, ওই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে, যাতে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র চলে যেতে না হয়। যদিও এই পরিকল্পনায় যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আছেন, তাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলা হয়নি।

প্রস্তাবের দ্বিতীয় ধাপ ছিলো, সব পক্ষের মধ্যে সংলাপ। চীনা পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে এই সংকটের সব পক্ষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আলোচনার প্রক্রিয়া চালু রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যাতে ‘সমতার ভিত্তিতে এবং সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে’ সংকটের সমাধান করা যায়।

আর তৃতীয় ধাপে রাখাইনে উন্নয়ন প্রস্তাব। চীনা পরিকল্পনার তৃতীয় ধাপে রাখাইনের উন্নয়নের প্রস্তাব রাখা হয়েছিলো। এতে বলা হয়েছিলো, রাখাইন রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। কিন্তু সেখানে উন্নয়নের ধারা থমকে গেছে। রাখাইনের উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা করার ব্যাপারেও চীনা পরিকল্পনায় তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে কেবল চীনকেই নয়; ভারত, রাশিয়া, মুসলিম বিশ্ব, পশ্চিমা বিশ্ব তথা সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মুখে বা প্রস্তাবে সীমাবদ্ধ না থেকে কাজের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই প্রস্তাব দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনা করে একযোগে এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে।

চার
মিয়ানমারে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান থেকে যারা বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে তাদের স্ব স্ব দেশে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক সংশ্লিষ্ট আদালতে অভিযুক্ত করে মিয়ানমার থেকে তাদের লব্দ আয় রোহিঙ্গাদের ত্রাণকার্যে ব্যবহার করার দাবি জানানো ও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারের স্বদিচ্ছাটাই এখন মুল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু তারপরও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। এবং বাংলাদেশকে আরও দৃঢ়তা ও দ্রুততার সাথে এই সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। কেননা সময়ের সাথে সাথে এই বিষয়টি তার গুরুত্ব হারাবে।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা

বিজ্ঞাপন

ফের দাপট দেখালেন সাকিব
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর