প্রাণী-প্রকৃতির জন্যও যেন মানবিক হই
৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৪১
অতি মূল্যবান একটি চিত্রকর্ম চুরির উদ্দেশ্যে ইতালি থেকে আসা ভুয়া রুদ্রশেখর সেজে নিয়োগীবাড়িতে প্রবেশ করেন এক অসাধু ব্যক্তি। তার উদ্দেশ্য যিশু খ্রিষ্টের প্রাচীন ছবি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া এবং এর বিনিময়ে মিলিয়ন ডলার কামানো। ভারতের ছত্তিসগড় রাজ্যের করিয়া জেলার একটি শহর বৈকুন্ঠপুরের সাবেক জমিদার ছিলেন নিয়োগীরা। এখনও রয়েছে তাদের জমিদার বাড়ি। বাড়িতে আসার আগে সেই অসাধু ব্যক্তি পাশের বাঁশবনে কুকুর খুন করেন। ফক্স টেরিয়ার জাতের এগারো বছরের ‘ঠুমরী’কে হত্যা করেন সেই ব্যক্তি। কুকুরটি ছিল পরিবারের একজন সদস্যের মতোই। তাকে মারার মূল কারণ হলো, চুরির জন্য রাস্তা পরিষ্কার করা। যেন বাসা থেকে কিছু সরালে, কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। মানুষ কোনো জিনিসের এদিক-সেদিক বুঝতে না পারলেও, কুকুর ঠিকই পারে। আর তাই এ পদ্ধতি অবলম্বন।
পরে অবশ্য ঘটনাক্রমে ওই বাড়িতে গোয়েন্দা ফেলুদার আগমন হয়। রহস্য উদঘাটন তার লক্ষ্য ছিল না বটে, তবে কথায় কথায় কুকুর খুনের বিষয়টি শুনে; ফেলুদা মনে করেন, মানুষের মৃত্যুর রহস্যজট যেমন খোলে তেমনি একটি প্রাণীর মৃত্যুর রহস্যও খোলাসা হওয়া উচিত। যে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, সেটার পেছনে সংশয়শূন্যভাবে কোনো কারণ আছে। সেই কারণ খুঁজতে গিয়েই খটকা লাগে। সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়, যখন ফেলুদা নিয়োগীবাড়ি থেকে চলে আসার কিছুদিন পর সেখানে একটি খুনের সঙ্গে যীশুর সেই মহামূল্য ছবিটি লোপাট হয়। হংকং পর্যন্ত সেই রহস্যের বীজ ছিল, তা ঠিকই বের করেন বিখ্যাত গোয়েন্দা।
আশির দশকে লেখা সত্যজিত রায়ের উপন্যাস ‘টিনটোরেটোর যীশু’র কথা বলছি। কুকুর ‘ঠুমরী’ খুনের মধ্য দিয়েই তার রচনা এগিয়েছে। এখানে শুধু গোয়েন্দাগিরি আর চিত্রকর্ম চুরিই প্রাধান্য পায়নি, পেয়েছে প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশও। কোনো একটি প্রাণী হত্যাও যে বিচারের দাবি রাখে; সেটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিখ্যাত এই চলচ্চিত্র নির্মাতা।
সত্যজিত রায়ের অন্য লেখাগুলোতেও উঠে এসেছে প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ। যুগে যুগে সাহিত্যিকরা প্রাণীপ্রেম তাদের লেখার বিষয়বস্তু করেছেন। বিখ্যাত সব লেখা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর। অথচ এই আধুনিক একুশ শতকে এসে আমরা প্রাণীর প্রতি আরও উদার হবো কি, হচ্ছি সংকীর্ণচেতা। এমনকি আমাদের লেখা ও সাহিত্যেও প্রাণ-প্রকৃতির বন্দনা কমে আসছে।
‘জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মাত্রাতিরিক্ত কুকুর প্রেম, কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়’। ‘কুকুরের উপদ্রব থেকে আমাদের বাঁচান, বেওয়ারিশ কুকুর নিধন করুন’— এগুলো মানববন্ধনের ব্যানারের লেখা। একটি সভ্য সমাজে প্রাণীকে হত্যার দাবি নিয়ে কিছু মানুষ রাস্তায়। তাদের দাবি, মেরে ফেলা হোক কুকুর। তাহলে তো প্রশ্ন জাগে, মনে কি অসৎ উদ্দেশ্য আপনাদের যে, কুকুর মেরে ফেলার দাবি করছেন। সমাজ ব্যবস্থাটাকে আপনাদের মতোই কিছু মানুষ দুর্বল করেছে, দুর্নীতি-অসততায় ভরে গেছে চারপাশ, এখন স্বেচ্ছাচারিতা চান। হত্যার দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা অবশ্যই বড় অপরাধ।
সম্প্রতি রাজধানী থেকে ৩০ হাজার কুকুর শহরের বাইরে স্থানান্তরিত করার ঘোষণা এসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কাছ থেকে। যত দূর জানা গেছে, এখনও সিটি করপোরেশন কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। তাদের দাবি, কুকুর সরানোর বিপক্ষে যেমন আন্দোলন চলছে, তেমনি সরানোর পক্ষেও প্রচুর মানুষ রয়েছেন। বিশেষ করে শিশুদের ধাওয়া দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে, এতে শিশুরা ভয় পাচ্ছে। তাদের মধ্যে মানসিক প্রভাব পড়ছে বলে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান। ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে কুকুর সম্পর্কিত নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ রোজই পাচ্ছেন তারা।
সিটি করপোরেশনের কর্তারা শুধু মানুষের কথা ভাবছেন। তাও কতিপয় মানুষের কথা। কিন্তু শহরের প্রাণীরাও যে, তাদের আওতায় রয়েছে তা কি তারা কখনও ভেবে দেখেছেন? এতো সংখ্যক কুকুরকে এক সঙ্গে কোনো একটি এলাকায় ছেড়ে দিলে সেখানে বিপর্যয় দেখা দেবে। খাদ্য সংকট তৈরি হবে। যে এলাকায় রেখে আসা হবে, সেখানে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হবে আরও। এমনকি সেখানকার স্থানীয় কুকুরদের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়ার ঘটনাও ঘটবে। মেরে ফেলা ও অন্যত্র রেখে আসা সমান বিষয় তাই।
একটা ঘটনা বলি, বহু বছর আগে, ঢাকার মিরপুরে কুকুর ধরে নিয়ে যাওয়া হলো (তখনো উত্তর-দক্ষিণ ভাগ হয়েছে কিনা মনে পড়ছে না)। সেসময় বেশ কয়েক বাড়ি থেকে পোষা কুকুরও ধরে নিয়ে গেলো কর্তৃপক্ষ। পোষা বলতে বাসার পাশেই তারা থাকতো, খাবার দেওয়া হতো- তবে বেশিরভাগেরই গলায় কোনো চিহ্ন ছিল না। ধরে নেওয়ায় যারা পালতো তাদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। আমি নিশ্চিত- পরিচিত অনেক কুকুর এবারও ঢাকা দক্ষিণে ৩০ হাজারের সংখ্যায় পড়ে তার প্রিয় পথঘাট, জন্মস্থান হারাবে। কোনো অধিকার নেই, প্রাণীদের তার জন্মস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করার। কর্তৃপক্ষকে বিকল্প ভাবতে হবে।
কোভিড-নাইনটিনের সময়ে প্রথমে যখন হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল, তখন কুকুরগুলো ঠিক মতো খেতে পারেনি। দুই লাখের বেশি কুকুরের মধ্যে হঠাৎ লকডাউন পরিস্থিতি প্রভাব ফেলেছে। না খেতে পেয়ে তাদের ভেতর হিংস্রভাব এসেছে ঠিকই, কিন্তু এটা সমাধান করার দায়িত্ব সিটি করোপেশনেরই। তারা খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি নিতে পারতো। করোনাকালে শুধু নয়, দুই সিটিতে যত কুকুর আছে, তারা সুস্থ কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করা উচিত নিয়মিত। টিকা কর্মসূচি নেই, এ নিয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। যা সারা বছর চলবে। অসুস্থ হলে পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত। প্রাণীরা নিজে হাসপাতালে যাবে না, তাদের মাধ্যমে যেন রোগবালাই না ছড়ায় তা দেখার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষেরই।
সমাজের পরিবেশ ঠিক রাখতে কুকুর, বিড়ালের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজে থেকে না বুঝলে এটা নিয়ে কাউকে বোঝানো কষ্টকর। ইঁদুর, চিকার সংখ্যা রোধ করা, ময়লা-আবর্জনা কমানোসহ নানা কাজে এই প্রাণীদের ভূমিকা রয়েছে। বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করার এখতিয়ার মানুষের নেই। এছাড়া কুকুরের প্রভু ভক্তের নজির জগদ্বিখ্যাত। এই প্রাণীকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রশ্নই আসে না।
আমরা তো আইন মানি না। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানও আইন মানে না। তাই তো প্রচলিত আইনে যে, বেওয়ারিশ কুকুরও নিধন বা কোথাও ফেলে আসা অন্যায় তা কে বোঝাবে কাকে। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গণহারে কুকুর ধরে ফেলে আসা হচ্ছে। বন্ধ্যাকরণ কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এখন কুকুর বেড়ে গেছে বলে তড়িঘড়ি করে তা সরাতে ব্যস্ত সিটি করপোরেশন। কি উত্তর, কি দক্ষিণ, দুই সিটিই ব্যর্থ। কুকুরগুলোকে বন্ধ্যা করা ও জলাতঙ্ক টিকার ব্যবস্থা করেনি কোনো করপোরেশনই। গুটি কয়েক কাজ দিয়ে পুরো অঞ্চলের কাজ দেখানোর প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। দক্ষিণের সাফাই, তহবিলের অভাবে গেলো কয়েক বছর ধরে বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি বন্ধ আছে। যার কারণে শহরে কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে। উত্তরেও কাজ হয় না। ঢাকার দুই মেয়র কত কাজই করেন, মানবিক ঢাকা তাদের অঙ্গীকার। অথচ প্রাণীর প্রতি অবিচার করে কী করে তারা মানবিক শব্দটাই উচ্চারণ করেন- তাই ভাবাচ্ছে আমাদের।
ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশনগুলো ও পৌরসভাগুলোকেও এ নিয়ে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে, কারণ কুকুরের সংখ্যা সেখানেও অনেক বেশি। যা রোধ করা প্রয়োজন এখনই। বন্ধ্যা করা ও জলাতঙ্ক টিকার ব্যবস্থা থাকতে হবে সেখানেও।
আমরা সংবাদে দেখি, ঢাকার বাইরে এলাকার লোকজন মিলে কুকুর, বিড়াল হত্যা করেছে (ঢাকাতেও হয় এমন)। পিটিয়ে মারে। এই ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার হয় না। স্বপ্রণোদিত হয়ে কেউ মামলা করলে তা নিয়ে কিছু কাজ হয় ঠিক, কিন্তু এমনিতে ততটা গুরুত্ব পায় না। কুকুর, বিড়ালই শুধু নয়, বেজি, কাঠবিড়ালি, সজারু, গন্ধগোকুল, শেয়াল, মেছোবাঘ, বাঘডাশসহ নানান প্রাণী প্রায়শই পিটিয়ে মারা হয়। বন্যপ্রাণী আইন-২০১২ অনুযায়ী, এসব প্রাণীকে হত্যা বা এর কোনো ক্ষতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। লোকালয় থেকে উদ্ধার করা হলে বন বিভাগকে জানিয়ে অভয়ারণ্যতে ছেড়ে দেয়াই নিয়ম। কিন্তু ঢাকার বাইরে অহরহ উদ্ধারের পর নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন প্রাণীকে। এক সঙ্গে বহু মানুষ এর সঙ্গে জড়িত থাকায় কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
প্রকৃতিতে বিষধর, নির্বিষ প্রতিটা সাপের নিজস্ব ভূমিকা আছে। এজন্য জীবনের ঝুঁকি না থাকলে কোনোভাবেই সাপ মারা যাবে না। কিন্তু আমরা কি তা মানছি? না, সাপ দেখলেই লাঠিপেটা যেন গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি। এমনকি নিরীহ পাখি হত্যা করতেও বুক কাঁপে না আমাদের। কৃষকের দেয়া কীটনাশকে পাখি মৃত্যুর ঘটনা অনেকবার শিরোনাম হয়েছে। শীতে অতিথি পাখি আসে, বিভিন্ন খাল-বিল ভরে যায়। সেখানেও মানুষের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। মূল্যবান বিদেশি পাখি আহার হিসেবে পাতে ওঠে। সার্বিকভাবে জীববৈচিত্র্য আমরা মানুষ যেভাবে ধ্বংস করছি ক্রমাগত— এতে আগামীর বিশ্বে মানুষ ও ভাইরাস ছাড়া আর কোনো প্রাণই টিকবে না প্রকৃতিতে। বাড়বে নতুন নতুন রোগ সংক্রমণ। গাছপালা ধ্বংস করতেও আমরা পিছিয়ে নেই। আমাদের লোভ, নিচু মনোভাব, নগ্ন প্রতিযোগিতা, কূপমণ্ডুকতায় ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে আগামী প্রজন্মের মৃত্যুকূপ।
সৈয়দ ইফতেখার: টেলিভিশন সাংবাদিক, সাহিত্যিক।