আত্মহত্যা: প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করনীয়
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:৩৫
আত্মহত্যা বলতে বোঝায় নিজের ইচ্ছায় জীবন বিসর্জন দেওয়া। আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘সেইডেয়ার’ থেকে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এক জরিপ অনুযায়ী সারাবিশ্বে আত্মহত্যায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন এবং অগণিত মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। সংস্থাটির আশঙ্কা মতে, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন। এর ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন। পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিবছর এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে আর এই আত্মহত্যার হার শহরের চেয়ে গ্রামে ১৭ গুণ বেশি।
ফরাসি দার্শনিক ডেভিড এমিল ডুর্খাইমকে উদ্ধৃত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চার ধরনের মানুষ আত্মহত্যা করে। তারা হলেন— ব্যক্তিগত জীবনে অনেক নিয়ম মানা ব্যক্তিরা, একদমই নিয়ম না মানা ব্যক্তিরা, যারা অনেক সামাজিক এবং সমাজচ্যুতরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার দুই ধরন। এগুলো হলো, ইমপালসিভ (হঠাৎ আত্মহত্যা) এবং ডিসিসিভ (সিদ্ধান্ত নিয়ে বা পূর্বপরিকল্পিত)। তবে ডিসিসিভ আত্মহত্যাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য।
যারা পরিকল্পনা করে আত্মহননের চেষ্টা করেন তারা বিভিন্ন সময় আচরণের মাধ্যমে তাদের আত্মহননের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন:
- তারা বন্ধু বান্ধবদের কাছে বা বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যমে তাদের এই ইচ্ছার বিষয়টা প্রকাশ করে।
- খুব প্রাণবন্ত একটা ছেলে বা মেয়ে হঠাৎ করেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, একা একা থাকতে শুরু করে।
- বিষণ্ণতা বা হতাশায় ভুগে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে।
- বিষণ্ণতা বা মন খারাপ ভুলে থাকতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
- অতিরিক্ত ঘুমায় কিংবা হয়তো সারারাত জেগেই কাটিয়ে দেয়।
- অযৌক্তিক তর্ক করে।
এই লক্ষণগুলো আমাদের আশেপাশে পরিচিতদের কারো মধ্যে দেখা গেলে আমাদের সচেতন হতে হবে। আত্মহত্যা বা মৃত্যুইচ্ছার কথা বলা মানুষগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া বা দূরে ঠেলে না দিয়ে যদি বোঝানোর সুযোগ পাওয়া যায়, তাদের কথা শোনা যায়, তাহলে আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের ভেতরে দুটো সত্তা আছে। ভেতরের যেই সত্তাটি বাঁচতে চায়, সে সংকেত দেয়। সেই সত্তাটির প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে হবে। এই সংকেত বা বাঁচতে চাইবার আকুতিকে আমাদের বুঝতে হবে।
যতটা সম্ভব আত্মহননের ইচ্ছা প্রকাশ করার মানুষটিকে লোকজনের মধ্যে রাখতে হবে। নানারকম সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাকে একা রাখা যাবেনা।
সে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সকলেই তাকে ভালোবাসে এই অনুভূতিটা তাকে বোঝাতে হবে। তার পাশে থাকতে হবে। যে কেউ যখন মৃত্যু ইচ্ছা প্রকাশ করবে সেই বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ না করে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তাকে তার জীবনের অর্জনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়
আত্মহত্যা বা আত্মহনন অমূল্য জীবনের অপচয়। তবু মানুষ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না। এর বেদনাদায়ক প্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির জীবননাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠজন, পরিবার ও সমাজে এক ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনে। তাই একমাত্র কার্যকর উপায় হলো আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা।
আত্মহত্যা সম্পন্ন হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকেনা, তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং সেই সাথে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে হবে-
– আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনতে শিশুকাল থেকেই মা-বাবার আন্তরিক আচরণ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে মেয়েরা বেশি স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। এ সময় অভিভাবক, স্কুল শিক্ষক বা বন্ধুদের কোন আচরণ তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে কিনা, তাদের আচার-আচরণে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা বাবা-মা কেই বুঝতে হবে, বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বাবা মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ সন্তানের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। একই সাথে সে পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। জীবনে সফলতা যেমন আসবে তেমনি ব্যর্থতাও থাকবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকে ব্যর্থতা মেনে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবার সাহস দিতে হবে।
– স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে হবে।
– আত্মহত্যার প্রবণতা আছে এমন ব্যক্তির সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখতে হবে, তাদের সময় দিতে হবে এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
– খোলা বাজারে কীটনাশক বিক্রি বা চিকিৎসাপত্র ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি করার ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় কীটনাশকের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ১৯৯৫-২০০৫—এই এক দশকে আত্মহত্যার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
– মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে বিশেষ গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। এটি অনুসরণ করে হংকংয়ে আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে নাটকীয়তা পরিহার, হেডলাইন ও কাভার পেজে সংবাদ না ছাপা, ব্যক্তির ছবি পরিহার, বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মহত্যার খবর মৃত্যু সংবাদ হিসেবে দেওয়া, মানসিক ও শারীরিক কারণে আত্মহত্যা করে থাকলে সেটি উল্লেখ করা ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। প্রয়োজনে গণমাধ্যমগুলো এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সাংবাদিকতার নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, যা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
– প্রয়োজনে যোগাযোগ করে যে কেউ যে কোন সময়ে যেন সহায়তা নিতে পারে সেজন্য জাতীয় পর্যায়ে হটলাইনের ব্যবস্থা করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী এসব চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে এর প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, সকলকে সচেতন করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র লেকচারার
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ