একটি অবহেলার গল্প
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৪৩
সামাজিক খাতে অর্থবহ বিনিয়োগ ছাড়া একটি দেশের দারিদ্র্যের সমাধান করা যায় না। এর মূল কারণ সামাজিক বিনিয়োগগুলো অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি করে। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি ছাড়াও সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দারিদ্র্য হ্রাসে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর বড় উদাহরণ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ইতিহাস ঘাঁটলেই সেটি প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর যে দেশটিকে দেশে-বিদেশে নানা প্রতিবন্ধকতা, বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল দেশটিকে। অথচ সেই দেশটিই এখন বিশ্বে অনেকক্ষেত্রেই উন্নয়নের উদাহরণ। প্রায় শূন্য থেকে পথ চলতে শুরু করা দেশটি আধা শতকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। দারিদ্র্য হ্রাসসহ সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
দুই দশক আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো অনেক কম। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিলো মন্থর। এখন সেখানে মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে বেশি এবং ভারতের পরে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে আমাদের (পাকিস্তান) মাথাপিছু আয় গত দুই বছরে অনেক কমে গেছে এবং প্রবৃদ্ধি আফগানিস্তানের চেয়েও কম।
সামাজিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নারী অধিকার নিশ্চিত করা। সামাজিক খাতে বিনিয়োগের মানে কেবল সরকারের লোক দেখানো বিভিন্ন সংস্থার জন্য বরাদ্দ নয়। এই সংস্থাগুলোর কাজের জবাবদিহিতা ও বিচারিক দায়বদ্ধতাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের এখনই আরও স্কুলের প্রয়োজন নেই, যদি সরকারি স্কুলগুলো তাদের দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালন করে। কিন্তু এতোগুলো বছরেও শিক্ষাদানের কাজটিই করে উঠতে পারেনি সরকারি স্কুলগুলো। সরকারি স্কুলগুলোতে আমরা নিম্নমানের শিক্ষা দিয়েছি আর শিক্ষার এই সংকট কাটাতে সুযোগ পেয়ে যায় বেসরকারি মুনাফা অর্জনকারী স্কুলগুলো। তারা বিপুল অংকের অর্থ নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো শিক্ষা দিয়েছে। অথচ সরকারি স্কুলে এখনও শিক্ষাদানের পর্যাপ্ত অবকাঠামো অব্যবহৃত পড়ে আছে।
এই সংকটে শিক্ষার ক্ষতি তো আমরা দেখতেই পাই কিন্তু সামাজিক ক্ষতির পরিধি অনেকেই অনুধাবন করতে পারি না। এতে সমাজে একটা স্পষ্টত বিভাজন তৈরি হয়েছে। প্রচলিত হয়ে গেছে একটি কথা— সরকারি স্কুলে যে মানের শিক্ষা মেলে তা দরিদ্রদের জন্যে আর বেসরকারি স্কুলের শিক্ষা ধনীর সন্তানদের জন্য। যারা বড় হয়ে দেশকে বিভিন্নখাতে নেতৃত্ব দেবে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাবিত হচ্ছে। শিক্ষার এই বিভাজন এক দেশে দুই সমাজব্যবস্থা তৈরি করছে।
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি; দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিকে তালিকাভুক্তির হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানের সবচেয়ে কম। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের হারও পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি। যদিও পাকিস্তান সরকার শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতনে নিয়োগ দিচ্ছে কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়ের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না সরকার। ফলে অর্থের অপচয় হচ্ছে।
পাকিস্তানের সরকারি স্কুলগুলোতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের হারও সবচেয়ে বেশি। লক্ষ লক্ষ নিরক্ষর যুবকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তারা দেশের বোঝা হয়ে থাকছে। এই যুবকদের বেশিরভাগ দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করে। কিন্তু শিল্পায়ন ও অন্যান্য খাতে এগুতে না পারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো চাকরি নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতির উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানে জনসংখ্যার অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী এবং রাষ্ট্র পরিচালিত ক্লিনিক থাকলেও বাংলাদেশিরা পাকিস্তানিদের চেয়ে গড়ে তিন বছর বেশি বাঁচে। অন্যদিকে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু অর্ধেক। এছাড়া বাংলাদেশ একটি পোলিওমুক্ত দেশ। অথচ বিশ্বের যে দু’টি দেশ এখনো পোলিওমুক্ত হতে পারেনি, তাদের মধ্যে পাকিস্তান একটি। সম্প্রতি নাইজেরিয়াকেও পোলিওমুক্ত দেশ হিসাবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের (পাকিস্তানের) সরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো চলছে মানহীনভাবে। সেই সুযোগটা নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। শিক্ষার মতো স্বাস্থ্য খাতেও আমরা পাশাপাশি দুটো সমাজ তৈরি করছি।
পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ নারীদের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং মর্যাদা উন্নয়নের রেখাচিত্রে সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে। বাংলাদেশের সরকার নারীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা করেছে। দেশটি সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কেবল অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণই কমায়নি, পরিবারের আকার নিয়ন্ত্রণ করেছে। নারীদের জীবনমানেও পরিবর্তন এনেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি পরিবারে নারীর মর্যাদা বাড়িয়েছে।
লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রেও পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে অনেক পিছিয়ে। অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই এইক্ষেত্রেও পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাকারীদের অযোগ্য ও আন্তরিকতাহীন কাজের মূল্য দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার সবচেয়ে বেশি। নব্বইয়ের দশকের পরে বাংলাদেশে টেক্সটাইল শিল্পের সূচনা হয়েছিল এবং এখন সেখানে ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী। শিল্পে কাজের সুযোগ নারীদের আয় এবং জীবনমান দুটোরই উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাবার এবং সন্তানদের লেখাপড়ায় অনেক অর্থ ব্যয় করেন। বেড়েছে শিশু কল্যাণ। কিন্তু পাকিস্তানে সেই চিত্র ঠিক উল্টো।
বাংলাদেশে বড় বড় বেসরকারি সংস্থা দেশব্যাপী নানা কর্মপরিকল্পনা করে কাজ করছে। এনজিওগুলোও বসে নেই, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে অবদান রেখে চলছে তারা। এক দশক আগেই অর্থনৈতিক সাফল্যের চেয়েও সামাজিক খাতে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সামাজিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ব্যয়ের কারণে একটি উন্নত মানবসম্পদ ব্যবস্থা তৈরি করতে পেরেছে দেশটি; এটা বলাই বাহুল্য।
নিঃসন্দেহে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য উপাদান। তবে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ট্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতির জন্য কালক্ষেপণ করা বোকামির নামান্তর। অপরদিকে দেশের নীতি-নির্ধারকরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করার পরিণতি যে জনগণকেই নানাভাবে দিতে হয় তার উদাহরণে পাকিস্তানের নাম এগিয়ে আছে।
[বাংলাদেশের কাছে অনেকক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে পাকিস্তান- এমন মন্তব্য করে দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের বিজনেস পেইজে লিখেছেন পাকিস্তানের একজন কলাম লেখক। ‘এ স্টোরি অব নেগলেক্ট’ শিরোনামে লেখা সেই কলামটি প্রকাশ করেছে দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউজ।]
লেখক: জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদক, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তান
ভাষান্তর: সন্দীপন বসু, ফিচার ডেস্ক, সারাবাংলা ডটনেট