ভারতের ‘পেঁয়াজ রাজনীতি’ ও বাংলাদেশ
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৯:০০
ভারতের রাজনীতিতে পেঁয়াজ একটি বড় ইস্যু। এটা শুধু এখন নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এর আগে পেঁয়াজ ইস্যুতে সরকার পরিবর্তনের মতো ঘটনাও ঘটেছে দেশটিতে। ১৯৮০ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনকে ইন্দিরা গান্ধি বলেছিলেন ‘পেঁয়াজ নির্বাচন’। এমনকি পূর্ববর্তী সরকারের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, বিশেষ করে পেঁয়াজে ভর করে ওই সময় লোকসভার ক্ষমতায় এসেছিল ইন্দিরা গান্ধির দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এ কারণে ভারতের সরকার কোনোভাবেই চায় না যে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাক। আর সে কারণেই গতবছর দেশটিতে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করলে সরকার ফসলটি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এমনকি এ বছরও তাই করেছে। যদিও এরই মধ্যে দেশটি রফতানি নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেছে। ফলে বাংলাদেশে এখন কিছু পরিমাণে ভারতীয় পেঁয়াজ ঢুকছে। কিন্তু সেই পেঁয়াজের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত বছর যখন ভারত পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তার কিছুদিন পরই ছিল মহারাষ্ট্র্রের নির্বাচন। আর এবার সামনেই রয়েছে বিহারের নির্বাচন। কাজেই সরকার চায় না যে এই সময়ে পেঁয়াজের দাম নিয়ে কোনো অসন্তোষ তৈরি হোক। সবমিলিয়ে ফসলটি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞাকে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। কারণ, অনেকদিন ধরেই পেঁয়াজ ভারতের ভূ-রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে আসছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃষ্টি ও বন্যার পাশাপাশি এবার নতুন করে আরেকটি সমস্যা যোগ হয়েছে। সেটি হলো করোনা মহামারি। এই করোনাও পেঁয়াজে প্রভাব ফেলেছে। তবে বিশেষ করে ভারি বর্ষণে ভারতের কর্ণাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশে পেঁয়াজ চাষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর মজুদ করা পেঁয়াজ পচেছে গোডাউনে। এছাড়া লকডাউনে এসেছে উৎপাদনে বাধা। সেজন্য ভারতে এখন পেঁয়াজের বাজার বেশ চড়া। দেশটির পেঁয়াজ ভাণ্ডারখ্যাত মহারাষ্ট্রেই গত একমাসে ফসলটির পাইকারি দাম তিনগুণ বেড়েছে, যেখানে দেশটির প্রায় ৫০ ভাগ পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। ফলে পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কেন্দ্রীয় সরকার।
মোদি সরকারের ধারণা, পেঁয়াজ রফতানি চালু থাকলে দুয়েক মাসের মধ্যে দেশটিতে পেঁয়াজের দাম সেঞ্চুরি হাঁকাতো। সামনেই বিহার নির্বাচন। পেঁয়াজের দাম যদি কোনোভাবে সেঞ্চুরির কাছাকাছি যায়, তাহলে ফসলটির ঝাঁজই বিজেপি-জেডিইউ জোটকে নির্বাচনে কাঁদিয়ে ছাড়াবে বলে আশঙ্কা ছিল। এর আগে পেঁয়াজের দাম ১০০ রুপি হওয়ায় দিল্লিতে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল বিজেপিকে। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছর দিল্লির মসনদে ফিরতে পারেনি বিজেপি। তাই বিহার নির্বাচনের কথা ভেবে বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে পেঁয়াজ আমদানি করতেও প্রস্তুত মোদি সরকার।
সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে পেঁয়াজ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের কৃষকরাও এই ফসলটির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। পেঁয়াজ ভাণ্ডার মহারাষ্ট্রে আর কোনো সবজি না পাওয়া গেলে মানুষ রুটির সঙ্গে পেঁয়াজ দিয়ে ‘কানডা ভাকারি’ বানিয়ে খায়। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পেঁয়াজ খুবই জনপ্রিয়। আর এসব এলাকা থেকেই বেশিরভাগ সদস্য দেশটির পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানকার জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের বিষয়টিও নির্ভর করে পেঁয়াজ উৎপাদনের ওপর। ফসলটির দাম কমে গেলেও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও গুজরাটের কৃষকরা পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল। ফলে নির্বাচনি প্রচারেও বিষয়টি গুরুত্ব নিয়ে দেখা হয়। এমনকি দিল্লিতে যখন পণ্যটির দাম বাড়ে, তখন রাজ্য সরকার পেঁয়াজে ভর্তুকি দিয়ে বাজার স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
এদিকে পেয়াঁজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় সরকারের সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠে দেশটির ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, রফতানি বন্ধ করায় ক্ষতির মুখ পড়বে কৃষকরা। রফতানি চালু থাকলে তারা বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারতেন। কিন্তু এখন কম দামে দেশের বাজারে পেঁয়াজ ছাড়তে হবে। এতে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। আর ভারতের বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি কৃষি বিপণন সংস্থার হাতে থাকা পেঁয়াজ বাজারে ছাড়া উচিত ছিল, সেইসঙ্গে মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তাহলে বাজারে স্বাভাবিক মূল্যে পেঁয়াজ পাওয়া যেত। সেটা না করে পেঁয়াজ রফাতানি বন্ধে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করল।
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষেপেছেন মহারাষ্ট্রের নেতারা। দেশটির সাবেক কৃষিমন্ত্রী শরদ পাওয়ার টুইটে বলেছেন, ‘ভারতে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা দেশটির ভাবমূর্তিতে বড় আঘাত। আর এই আঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারেও পেঁয়াজ রফতানিকারক দেশ হিসেবে ভারত পেছনে পড়ে যাবে। সরকারের এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সুবিধা হবে পাকিস্তানের। তারা ভারতের বাজার দখলের চেষ্টা করবে।’
কিন্তু সম্প্রতি ভারতের রাজ্যসভায় ‘অ্যাসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যামেন্ডমেন্ট বিল-২০২০’ পাস হয়েছে। ফলে পেঁয়াজ, ডাল, আলু মজুতের ওপর থেকে সময়-সীমা উঠে গেছে। এই আইন পাসের ফলে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ৬০ বছর পুরনো মজুতদারি রোধের আইনটি বিলুপ্ত হলো। আগের আইনে ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট পরিমাণের এসব পণ্য ৩০ দিনের বেশি মজুদ রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু নতুন আইনে পেঁয়াজ, ডাল, আলু মজুতের যে সীমা নির্দিষ্ট করা ছিল, তা নেই। ফলে দেশটিতে কোনো আপৎকালীন পরিস্থিতি ছাড়া এসব পণ্য মজুত করায় কোনো বাধা থাকল না। আলোচিত এই বিলটি পাসের বিষয়ে সরকার বলছে, এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন এই আইনে চাষি ও ক্রেতা— দুই পক্ষই লাভবান হবেন। আর বিরোধী দলের দাবি, বিলটি মজুতদারদের জন্য পাস করা হয়েছে। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এবার তাকানো যাক ভারতের ‘গোকাণ্ডে’র দিকে। দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেয়। ২০১৭ সালে তারা দেশটিতে প্রকাশ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে। এর পেছনে ধর্মের দোহাই থাকলেও আড়ালে ছিল অন্যকিছু। ভারত প্রকাশ্যে গরু জবাই বন্ধ করে দিলেও বিভিন্ন দেশে মাংস রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাংস রফতানিকারক দেশের তালিকায় ভারত কখনো এক, আবার কখনো দুই নম্বরে অবস্থান করছে। গরু জবাই বা রফতানি বন্ধের পেছনে রাজনীতির পাশাপশি দেশটির অর্থনৈতিক চালও ছিল।
এছাড়া কয়েকবছর আগে ভারত হঠাৎ বাংলাদেশেও গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়। এমনকি চোরাই পথে যেন গরু বাংলাদেশে আসতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে। স্বাভাবিকভাবেই ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে মাংসের সংকট দেখা দেয়। কিন্তু এই সংকট ছিল মাত্র একবছর। এই একবছরের মধ্যে বিশেষ উদ্যোগ ও উদ্যমে দেশের খামারিরা গরুসহ গবাদিপশু পালনে জোর দেন। আর এতেই দেশ গরুতে স্বয়ংসর্ম্পূণতা অর্জন করে। বর্তমানে ভারত কেন, কোনো দেশের গরুরই প্রয়োজন নেই আমাদের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি গরু উৎপাদিত হচ্ছে। অচিরেই দেশ গরু বা গরুর মাংস রফতানিকারী দেশের কাতারে স্থান পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে কোরবানির জন্য গরু-মহিষ উৎপাদনের সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ ৮২ হাজার। আর ছাগল-ভেড়া উৎপাদন হয় ৭১ লাখ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোরবানির জন্য এক কোটি ১৭ লাখ পশু উৎপাদন হয়েছিল গত বছর। আর এই উৎপাদন দেশের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় গরু আমদানি কমে গেছে। এছাড়া দেশীয় উৎপাদন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর পরই সীমান্তগুলোর গরু চোরাচালান পথে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, একসময় ভারত থেকে বছরে ৫০ লাখের বেশি গরু বাংলাদেশে আসতো। এর কিছু বৈধ পথে, আর বেশিরভাগই আসত সীমান্ত গলিয়ে চোরাপথে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির এক হিসাবে দেখা যায়, ভারত থেকে ২০১৩ সালে গরু আসে ২৩ লাখ, ২০১৪ সালে ২১ লাখ, ২০১৫ সালে ১৬ লাখ, ২০১৬ সালে ১১ লাখ। এর পরের বছর সংখ্যাটা ১০ লাখের নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ ২০১৭ সালে গরু আসে ৯ লাখ। আর ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল সাত লাখ। আর ২০১৯ সালে বৈধ পথে মাত্র লাখের মতো গরু বাংলাদেশে আসে। এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, দেশে গরু উৎপাদন বাড়ছে। তাতেই মিটছে চাহিদা। ফলে ভারত থেকেও গরু আসা কমে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক চাল প্রসঙ্গে। বেশ ক’বছর আগে যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরপরই দেখা যেত ভারত থেকে চাল আমাদানির হিড়িক লেগে গেছে। ওই সময় বাংলাদেশের বাজার মানেই ভারতীয় চালের ছড়াছড়ি। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও বছরের একটা সময় বাংলাদেশে চালের সংকট দেখা দিত। সেই সময়টা ছিল চৈত্র-বৈশাখ মাস, যখন খরায় চৌচির হয়ে থাকত বাংলাদেশের আবাদি জমি। চাষাবাদের ওই মৌসুমে জমিগুলো চাষহীন পড়ে থাকত। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে খরার সময়টাতে ‘মঙ্গা’ দেখা দিত। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন ও বরেন্দ্র প্রকল্পের আওতায় সেচ ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের ফলে উত্তরাঞ্চল এখন ধান উৎপাদনে দেশের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফলে ভারত থেকে চাল আমদানি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে।
ভারতে বর্তমানে ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বছরে প্রায় ১২ কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়। সেখানে বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে বর্তমানে বছরে ১ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হচ্ছে। যদি ভারত দেশটির জনগণের জন্য চালের জোগানের পাশাপাশি রফতানি করতে পারে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষেও চাল রফতানি সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এর অভাবেই আমাদের উদ্বৃত্ত চাল দেশের গোডাউনেই থেকে যাচ্ছে। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ চাল রফতানি শুরু করেছে। তবে সবচেয়ে আশার কথা হলো, চালের ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরশীলতা কমেছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। এ গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৫৪ ভাগ বেড়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে হিসাব করে জুন পর্যন্ত দেশে ২০ দশমিক ৩১ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল মজুত ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ১৬ কোটি মানুষের চাহিদা মেটানোর পরও প্রায় দেড় মাসের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া নভেম্বরের মধ্যে আউশ ও আমনের ফলন উঠে যাবে। আর বর্তমানে সরকারি গোডাউনে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। ফলে দেশে আপাতত খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। চালের ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরশীলতা কমেছে কেবল সুষ্ঠু কৃষি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের কৃষকদের ধান উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ার কারণে।
ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাংলাদেশে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভারতের রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে তুলা-ই আসে এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের। ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ। দেশটির তুলার বড় বাজার হলো বাংলাদেশ ও চীন। অথচ ভারতীয় তুলার মান নিয়ে বাংলাদেশের স্পিনারদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তারপরও আমদানি সহজলভ্য হওয়ায় তারা ভারত থেকে তুলা আমদানি করে থাকে। এই আমদানি বাণিজ্য দেশটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, তাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দায়বদ্ধতার কথা।
কিন্তু প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কতটুকু দায়বদ্ধ ভারত— সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। প্রাকৃতিক কারণে ভারতে যখনই কোনো কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখনই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা ভুলে গিয়ে কৃষিপণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়। এ রকম উদাহরণ চাল, তুলা ও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে থাকে। অথচ এর আগে ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করলে আগে থেকে জানাবেন। না হলে আমাদের খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। আগে থেকে জানলে আমরা আগাম কিছু ব্যবস্থা নিতে পারি।’ কিন্তু সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে এ বছরও হঠাৎ-ই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয় ভারত।
বাংলাদেশ এ বছর ভারতে প্রায় ১৫শ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে উপহার হিসেবে দেশটিতে এই ইলিশ রফতানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভারত যেদিন মধ্যরাতে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়, সেদিনই ইলিশের প্রথম চালান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। এতে বাংলাদেশের মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আহ্বান করা হয়েছিল, দু’দেশের কৃষিপণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে পূর্ব ঘোষণার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই ভারত সরকারের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা রক্ষা করা হলো না।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। সনাতনী পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করায় প্রতিবছর মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পেঁয়াজ বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়। সে হিসাবে উৎপাদিত পেঁয়াজের মধ্য থেকে কমে যায় প্রায় ৬ থেকে ৭ মেট্রিক টন। তখন মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আমাদের দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা রয়েছে ২৭ থেকে ২৮ লাখ মেট্রিক টন। ফলে প্রতিবছরই প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
আবহাওয়াগত কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পেঁয়াজ চাষ হয় দুই/তিন মৌসুমে। কিন্তু বাংলাদেশে চাষ হয় কেবল রবি মৌসুমেই। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রবি মৌসুমে অতিরিক্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব নয়। তবে আশার কথা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বর্ষা মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদের জন্য তিনটি জাত অবমুক্ত করেছে। সেগুলো হলো— বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ ও বারি পেঁয়াজ-৫। এই জাতগুলো ফেব্রুয়ারিতে বীজতলায় বপন করে মার্চ মাসে মূল জমিতে রোপণ করে জুন-জুলাইয়ে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা যায়। আবার জুলাইয়ে বীজতলায় বপন করে আগস্টে মূল জমিতে রোপণ করে নভেম্বরে পেঁয়াজ তোলা যায়। তাই বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমাদানি নির্ভরতা কমাতে দুই/তিন মৌসুমে পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে হবে। এতে অতিরিক্ত চাহিদার ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের জন্য আমাদের ভারত মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
এবার আসা যাক একটু অন্য প্রসঙ্গে। ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের প্রায় পুরো সীমান্তজুড়ে ভারতের অবস্থান। ভারতের বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। এমনকি বাংলাদেশের স্থলপথ ব্যবহার করে দেশটি তাদের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো শুল্ক ছাড়াই পণ্য আনা-নেওয়া করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম কোনো সুবিধা নেই। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়— সাম্প্রতিক চীন ও ভারতের যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সেখানে বাংলাদেশকে একটি পক্ষে টেনে নেওয়ার জন্য দুই দেশই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দু’টি দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। আর এটাই বাংলাদেশের রাজনীতি হওয়া উচিত।
ভারতের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ আসে কৃষিপণ্য থেকে। তাই দেশটির সরকারের উচিত ছিল কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবে তা না করে নরেন্দ্র মোদির সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় বেশি নজর দিচ্ছে। কারণ সামনেই রয়েছে বিহার নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে মোদি সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের কৃষকরাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উল্লেখ্য, চীন বিশ্বের প্রথম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। ভারত সেখানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানও পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। ভূ-রাজনৈতিক বিষয়টা যদি এখন অন্যপথে এগোয়, যদি বাংলাদেশ পরবর্তী বছরগুলোতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দিয়ে চীন বা পাকিস্তানকে বেছে নেয় তখন অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে? এই ‘পেঁয়াজ রাজনীতিটা’ তখন কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে— সেটাই এখন দেখার বিষয়!
লেখক: সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
গবাদি পশু চাল আমদানি তুলা আমদানি পেঁয়াজ আমদানি পেঁয়াজ রফতানি পেঁয়াজ রাজনীতি ভারত-চীন ভূ-রাজনীতি ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা