কোভিড-১৯ নির্মূলে তিন ধাপের পরিকল্পনা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:২৫
বিশ্ব এখন এক বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের দ্বারপ্রান্তে— আগামী বছরের শুরুর দিকে একটি নিরাপদ, কার্যকর করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। আসলে ওই সময়ের মধ্যে একের অধিক ভ্যাকসিন প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা। করোনাভাইরাস মহামারি থেকে বিশ্ব মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরার জন্য এটাই এ পর্যন্ত অগ্রগতি।
যখন আমরা এই রোগের প্রতিষেধক সরবরাহ করতে পারব তখন সরকারগুলো সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের পদক্ষেপগুলো উঠিয়ে নিতে সক্ষম হবে। মানুষ তখন মাস্ক পরা বন্ধ করে দেবে। বিশ্ব অর্থনীতি তখন আবার পূর্ণ গতিতে চলতে পারবে।
তবে করোনার নির্মূল আপনা আপনি হবে না। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিশ্বকে প্রথম তিন জিনিস নিশ্চিত করতে হবে: কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করার সক্ষমতা সৃষ্টি করা, এগুলো তৈরির জন্য অর্থের যোগান দেওয়া, এবং এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের বেশিরভাগ করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন ধনী দেশগুলোতে যাবে বলে কথা হচ্ছে। এসব দেশ বড় বড় ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে। তারা কোটি কোটি ডোজ করোনার ভ্যাকসিন যাতে তাদের দেশে আসে তা নিশ্চিত করছেন।
তবে দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা কী? এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলো যেমন দক্ষিণ সুদান, নিকারাগুয়া, মিয়ানমার এসব দেশের কী হবে ? এসব দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বসবাস। বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ভ্যাকসিন কেনার মতো ক্রয় ক্ষমতা তাদের নেই। এখন পর্যন্ত যা অগ্রগতি, এতে বুঝা যাচ্ছে এসব দেশ তাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পারবে।
নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির করা নতুন একটি মডেলিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের সম বণ্টন না হলে কী হতে পারে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়। সেখানকার গবেষকরা দুটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। একটিতে, বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের জনসংখ্যার আকারের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। আরেক পরিস্থিতিতে, বিশ্বের প্রায় ৫০টি ধনী দেশ করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের প্রথম ২ বিলিয়ন ডোজ পায়। দ্বিতীয় পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, ভাইরাসটি চার মাস ধরে বিশ্বের তিন চতুর্থাংশে আরও ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এসময় মৃত্যু হয় প্রায় দ্বিগুণ মানুষের।
এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় তবে এটি হবে বিশাল এক নৈতিক ব্যর্থতা। ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ কে একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগে পরিণত করবে, আর এই প্রতিরোধযোগ্য রোগটির জন্য কেউ কেউ মারা যাবে, যারা কি-না এমন দেশে বাস করে যার সরকার ভ্যাকসিনটি পেতে কোনো বড় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে সক্ষম নয়। তবে “ধনী দেশ কেবল” এই পরিস্থিতির সমস্যাটি বুঝার জন্য ন্যায়ের দৃষ্টিতে না দেখলেও চলবে।
“ধনী দেশ কেবল” পরিস্থিতিতে আমরা অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো হয়ে যাব। এই দুই দেশেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কম, তবে তাদের মিত্র দেশগুলো লকডাউনে থাকায় দেশ দুটির অর্থনীতি মন্দায় ভুগছে। এবং মাঝেমধ্যে ভাইরাসটির কোনো বাহক প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে দেশগুলোতে ঢুকে যাচ্ছে। ভাইরাসের বাহকের এসব দল বড় হয়ে আবার তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আবারও স্কুল, অফিস ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেছে।
এমনকি অতিরিক্ত ভ্যাকসিন সরবরাহ হলেও ধনী দেশগুলোতে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাবে। কেননা দেশগুলোর প্রত্যেকেই টিকা দিতে চাইবেন না। তাই ‘কিছু কিছু এলাকায়’ এই রোগ নির্মূল করার একমাত্র উপায় হলো ‘সব জায়গায়’ তা নির্মূল নিশ্চিত করা।
ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার ব্যবধান বন্ধ করার সর্বোত্তম উপায়টি অবশ্যই ধনী দেশগুলোকে লজ্জা দেওয়া নয়। তারা যা করছে তা খুবই বোধগম্য, কারণ তারা চাচ্ছে তাদের মানুষকে আগে রক্ষা করতে। এর পরিবর্তে আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো— বিশ্বে ভ্যাকসিনের উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো। এই উপায়ে আমরা পৃথিবীর যেখানেই মানুষ বাস করে সেখানে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারি।
এক্ষেত্রে চিকিৎসা-বিভাগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। একে অন্যের উৎপাদন কারখানা ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়াতে ইতিমধ্যে রাজি হয়েছে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। যেমন উদাহরণস্বরূপ: জিল্যাডের রেমদেসভির এখন ফিজারের কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে। এর আগে এভাবে কোনো প্রতিযোগী কোম্পানির ওষুধ উৎপাদনের জন্য কেউ তার কারখানা খুলে দিত না। কিন্তু এবার ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কোম্পানিগুলো একে অন্যকে সহযোগিতা করছে।
এখন প্রস্তুতকারীদের উৎপাদন সক্ষমতা নিশ্চিত করা ছাড়াও দরিদ্র দেশে কয়েকশ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাঠানোর জন্য আমাদের ফান্ডিং প্রয়োজন। একাজে এসিটি-এক্সিলেটর সাহায্য করতে পারে। গাভি (ভ্যাকসিন জোট) ও গ্লোবাল ফান্ড এর মতো সংস্থাগুলো এ উদ্যোগকে সহযোগিতা করছে। হয়ত খুব বেশি মানুষ এদের সম্পর্কে এখনও জানে না, তবে এই দুই সংস্থা দুই দশক ধরে ভ্যাকসিন, ওষুধ ও চিকিৎসার জন্য অর্থ সংস্থান করে আসছে।
অন্য ধনী দেশগুলোর এখন যা করতে পারে তা জানার জন্য ভালো উদাহরণ হলো যুক্তরাজ্য। দেশটি এসিটি- এক্সিলেটরে ইতিমধ্যে প্রচুর টাকা অনুদান দিয়েছে। যার ফলে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কয়েকশ মিলিয়ন ভ্যাকসিন ডোজ প্রস্তুত করা সম্ভব হবে। জাপানও একই কাজ করেছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম দেশ যারা দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অর্থ অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর দেশটি ১৬ মিলিয়ন ডলার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছিলো। তবে এখনও অনেক অনুদান প্রয়োজন। আমি আশা করি অন্য দেশগুলোও এ ব্যাপারে উদার হবে।
সবশেষে, এমনকি যখন ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে, এবং অর্থ সংস্থানও হবে তখনও আমাদের দরকার হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। এজন্য দরকার কর্মীবাহিনী ও অবকাঠামো নিশ্চিত করা যাতে বিশ্বের সব মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া যায়।
পোলিও নির্মূলের কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ভারতে পোলিও নির্মূলের একটি বিখ্যাত চিত্র হলো, স্বাস্থ্য কর্মীদের বিশাল বিশাল সারি। তারা ভ্যাকসিন কোলার মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে এমনকি বন্যকবালিত দুর্গম এলাকাতেও ভ্যাকসিন নিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের গরীব অঞ্চলগুলোতেও কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন প্রায় এরকম একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে- যেখানে যাওয়ার জন্য কোনো রাস্তাই নেই সেখানেও এসব স্বাস্থ্যকর্মীরা পৌঁছে যেতে পারেন।
অন্যকথায়, কোভিড-১৯ নির্মূল করতে গিয়ে আমরা এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারি যা পরবর্তী মহামারির ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়ও কাজে আসবে।
মহামারির ইতিহাস পড়ে আমি একটা জিনিস শিখেছি তা হলো- নিজ স্বার্থ ও পরার্থপরতার এই দুই ক্ষেত্রে মহামারিগুলো এক দারুণ গতিশীলতা সৃষ্টি করে। মহামারিরক্ষেত্রে নিজেদের সাহায্য করার ইচ্ছা অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত। নিজ স্বার্থের সঙ্গে পরার্থপরতার এই সম্পর্কই দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করে থাকে।
[বিল গেটস মাইক্রোসফট এবং বিল এন্ড মালিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। সম্প্রতি বিল গেটসের একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। কলামটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সারাবাংলাডটনেটের নিউজরুম এডিটর আতিকুল ইসলাম ইমন]