সত্যের ভারেই মিথ্যা নুয়ে পড়ে
১ অক্টোবর ২০২০ ০২:২৪
জন্মদিন উদযাপন নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের বিষাদময় এক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বাঙালির বুকে রীতিমত ছুরি দিয়েই যেন একটা মিথ্যা উল্লাসে (একটা সময়) নিজেকে এবং দলের নেতাকর্মীদের মাতিয়ে রাখতেন। পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং একশ্রেণীর স্বার্থলোভী মুক্তিযোদ্ধাও সেই মিথ্যা উল্লাসে নিজেদের অংশগ্রহণ নিয়ে গর্ববোধ করতো। দেশ ও জাতির সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদেরও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে এই মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লাসের আয়োজন ছিলো দেশজুড়ে বিদ্যমান।
এখানে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ ও ‘সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা’ উল্লেখ করেছি এই কারণে, আমরা জানি মানুষ যত উপরে উঠে ব্যক্তি হিসেবে সে ততটাই নরম হয়। মানুষ যতটা জ্ঞানী হয়, তিনি ততটাই মানবিক হয়ে পড়েন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটা সময় শাসন করেছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মত শাসক। তিনি নিজেও জানতেন তার পাঁচ-পাঁচটি জন্মদিনের মূলত কোনটি সত্য। তিনি নিজেও জানতেন ১৫ আগস্ট তার জন্ম তারিখটি ছিলো পরিকল্পিতভাবে সাজানো, মিথ্যা।
তাহলে এই মিথ্যা জন্মদিন পালন করার উদ্দেশ্য কী? কেন বিএনপির এতো-এতো নেতাকর্মীদের সামনে একটি ভুয়া-মিথ্যাকে তুলে ধরা হয়েছে? বিএনপির সকল নেতাকর্মীরাই অসচেতন? অশিক্ষিত? ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে তাদের কোনো পড়াশোনা-গবেষণা নেই? তারা কি কখনো সত্য জানবে না?
আসলে পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী খালেদা জিয়া তার ওই ভুয়া-মিথ্যা জন্মদিন পালনের মাধ্যমের শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অশ্রদ্ধা, অসম্মানই প্রদর্শন করেননি বরং স্বাধীনতাকামী বাঙালির বুকে ছুরি চালিয়ে রক্তক্ষরণ করেছেন। ঔদ্ধত্য প্রকাশের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক শিষ্টাচার আর রাষ্ট্র পরিচালক হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতাকে তিনি বার-বার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, অযোগ্যতাকে তুলে ধরেছেন।
তবে ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ওই ভুয়া-মিথ্যাচার উল্লাসের কোনও আয়োজন করা হয়নি বলে আংশিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু পুরোপুরি সেই মিথ্যাচারের খোলস থেকে বেরও হতে পারেনি। আশা করি খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। প্রকৃত জন্মদিন পালন করবে এবং আমরা সবাই সেই জন্মদিনে সমবেত হয়ে শুভেচ্ছা জানাতে পারবো।
এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন ছিলো।
আওয়ামী লীগসহ দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন উদযাপন করতে চাইলেও তিনি বরাবরের মতো এবারও এক প্রকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু কখনো নিজের জন্মদিন ঘটা করে পালন করেননি। আর শেখ হাসিনাও বরাবরের মতো ঘরোয়া আয়োজনে সন্তান, নাত-নাতীদের খুশি রাখতে কেক কেটে থাকেন। মহামারি করোনাভাইরাসের এই দিনগুলোতে বরং মানুষের পাশে থেকে মানবতাবোধ নিশ্চিত করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিনগুলো সব সময় সাদাসিধা হতে দেখা গিয়েছে। একযুগ, বলতে পারেন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রতিবছর জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কারণে জন্মদিনের সময় তিনি বিদেশের মাটিতেই থেকেছেন। আর তিন মেয়াদের প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগের বছরের জন্মদিনেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তবে সফরসূচি ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবস্থানগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শহরে তার জন্মদিনগুলোতে বরাবরের মতো ঘরোয়াভাবেই সময় কাটিয়েছেন।
বিশ্ব মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথমবার ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে জাতিসংঘের ৭৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এবার দেশে থেকেই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এবার দেশের মাটিতে থাকলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলের সভাপতিমন্ডলীর সভায় তিনি জন্মদিনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা না করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে ২০০৮ সালের জন্মদিনটিও শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রে কাটে। ষড়যন্ত্রের ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১১ মাস কারাবন্দী থাকার পর ২০০৮ সালের ১২ জুন তিনি চিকিৎসার স্বার্থে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি দেশে ফেরেন। ফলে সেই বছর তার ৬২তম জন্মদিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে থাকলেও তার জন্মদিন পালিত হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন সংসদ ভবন এলাকার সাবজেলে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষভাগে জাতিসংঘ সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কারণে সেখানেই বেশিরভাগ জন্মদিন ঘরোয়াভাবেই পালন করেন তিনি।
২০০৯ সালে স্বামী বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পরের এ জন্মদিনটি তিনি ওয়াশিংটনের বাল্টিমোরে ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বাসায় পারিবারিকভাবে কাটিয়েছেন। ২০১০ সালে ৬৪তম জন্মদিনটি তার বিমানেই অতিবাহিত হয়। আর ২০১১ সালে ৬৫তম জন্মদিন পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে জন্মদিন তিনি নিউইয়র্কে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পালন করেন।
২০১৬ সালে ৭০তম জন্মদিনটিও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবেই পালন করেন। ২০১৭ সালে জাতিসংঘ সম্মেলনে যাওয়ার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর গলব্লাডারে অপারেশন করা হয়। ওয়াশিংটনের একটি হাসপাতালে অপারেশনের পর ওই সময় সেখানকার আবাসস্থলে বিশ্রামে ছিলেন তিনি। সেখানেই তিনি ঘরোয়া পরিবেশে জন্মদিনের সময় কাটান।
২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ৭২তম জন্মদিনের সময় তিনি নিউইয়র্কে হোটেলেই ছিলেন। সেখানেই বরাবরের মত আড়ম্বরহীনভাবে পালন করা হয় তার জন্মদিন। ৭৩তম জন্মদিনও নিউইয়র্কে কাটিয়েছেন তিনি। অবশ্য এরমধ্যে দু-একটি জন্মদিনের সময় দেশের পথে যাত্রা করে বিমানেও কাটিয়েছেন।
একটি দেশের শাসক কতটুকু মানবিক ও উদার-এটি তার কর্মকাণ্ড আর বস্তুনিষ্ঠ বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ বোঝতে পারে। মানুষ বিচার-বিশ্লেষণ করে। সাদা-কালো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সেভাবেই যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে উৎসাহ ও উদ্যমী করে তুলে।
অথচ স্বয়ং খালেদা জিয়া ও বিএনপি পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে মিথ্যা জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে ঔদ্ধত্য-উল্লাস করে দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, পরিবারের সবার ছোট্ট ভাই প্রিয় রাসেলকেও হারিয়ে যিনি মানুষ, মানবতাবোধ নিশ্চিত আর জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে আজ বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই পিতা-মাতা, ভাই-পরিবার পরিজনহীন অসহায় এতিম বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে মিথ্যা জন্মদিন পালনের মাধ্যমে প্রতিবারই মানবিক আঘাত করে জর্জরিত করেছেন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করিয়েছেন।
একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত, মিথ্যার ক্ষণস্থায়ী ঔদ্ধত্য-উল্লাস চিরস্থায়ী সত্যের কাছে বরাবরই পরাজিত হয়। যে বিশ্বাসঘাতক খুনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের হাত দিয়ে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়, যে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’কে কালো আইনে রূপান্তর করেন জিয়াউর রহমান, সত্যের কাছে, সঠিক তথ্য-প্রমাণের কাছে সেই ‘ইনডেমনিটি’ লুটিয়ে পড়ে। জাতির পিতার খুনিদের বিচারকাজ বাংলার মাটিতে হয়েছে। খুনি চক্রের মুল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ঘৃণা অক্ষরে ইতিহাসে লেখা আছে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের নাম।
এদেশে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়নি, যুদ্ধাপরাধী নেই বলে একটা সময় যারা ঔদ্ধত্য-উল্লাস করেছিল; মানবতাবিরোধী সেই অপরাধীদেরও বিচারকাজ আজ বিশ্বময় দৃষ্টান্ত। তথ্য-প্রমাণের ভারে তারাও তাদের ঘৃণ্য অপরাধ লুকাতে পারেনি। ইসলামকে ব্যবহার করে প্রকৃত মুসলমানকেও বিভ্রান্ত করে বেশিদিন নিজেদের ঔদ্ধত্য-উল্লাস ধরে রাখতে পারেনি।
তাই খালেদা জিয়াসহ বিএনপির উচিত হবে পাকিস্তানি রাজনীতির খোলস থেকে বেরিয়ে আসা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরা, দেশাত্মবোধে উদ্যমী করা এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করা।
একবিংশ শতাব্দীর তথ্য-প্রযুক্তি আর তথ্য-প্রমাণের এই সভ্যতায় মেধাভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী গড়ে তুলতে হলে ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্প-সাহিত্যের সঠিক চর্চা অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যত বেশি জনগণের মাঝে তুলে ধরা হবে, জনগণকে সচেতন করা হবে; ততই দেশাত্মবোধের জায়গা থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)