Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তুলার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রম আরও বেগবান হোক


৭ অক্টোবর ২০২০ ১১:১১

“তুলা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আঁশ” প্রতিপাদ্যটি নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সারা বিশ্বে “বিশ্ব তুলা দিবস-২০২০” পালিত হচ্ছে আজ। প্রথম দিবসটি ২০১৯ সালের ৭ই অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পালিত হয়েছিল। মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দিবসটি এবার আন্তর্জাতিকভাবে পালিত না হলেও বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করছে। বাংলাদেশে এবার প্রথমবারের মতো তুলা উন্নয়ন বোর্ড দিবসটি উৎযাপন করতে যাচ্ছে। দিবসটিতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড ওয়েবিনার, কর্মশালা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে রাজধানীসহ দেশের তুলা উৎপাদন এলাকায় মানব উদ্দীপন পালন, বিভিন্ন ধরণের পোস্টার ও ফেস্টুন প্রদর্শনীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করবে।

দিবসটি বাংলাদেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণ এবং দেশের উৎপাদিত তুলা দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তুলা একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল যা বিশ্বব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং এটি আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের তুলার তৈরি সকল বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। খাদ্য ছাড়া আমরা কিছুদিন বাঁচতে পারলেও তুলা এবং তুলার তৈরি বস্ত্র ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারব না।

বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। বিশ্বে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে চার ধরনের তুলার আবাদ হয়।  Gossypium hirsutum, Gossypium berbadense, Gossypium Arboreum এবং Gossypium herbaceum. আমাদের দেশে  Gossypium hirsutum, এবং Gossypium Arboreum এর চাষ করা হয়। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশ সমূহের মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং ব্রাজিল অন্যতম। সমগ্র বিশ্বের প্রায় ২৬ শতাংশ তুলা ভারত এবং ২২ শতাংশ তুলা চীনে উৎপাদিত হয়।

প্রতি টন বীজতুলা বছরব্যাপী প্রতি দিন গড়ে পাঁচ জন লোকের কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করে। বিশ্বের ২.১ শতাংশ চাষযোগ্য জমিতে তুলার আবাদ হয় এবং সেই তুলা টেক্সটাইল সেক্টরে ২৭ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশে তিনটি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিপ-২ তে মাত্র ০.৫২ ভাগ জমিতে তুলা চাষ করা হয়। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্য তেল, খৈল, জ্বালানি উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। ভোজ্য তেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টরেল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে তেল পাওয়া যায় যা উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। খৈলে রয়েছে উচ্চ প্রোটিন ২৪%, উচ্চ ফ্যাট ২০% হারে এবং ৪০%  ক্রুড আঁশ যা পশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

তুলার ইতিহাস পৃথিবীতে ৭ হাজার বছরের পুরাতন। আর্যদের যুগ থেকে ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাত। বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় ও অন্যান্য সুতি বস্ত্র সমগ্র ইউরোপে রফতানি হতো— এর বিনিময়ে আসতো বহু মূল্যবান ধাতু। সে সময় বাংলাদেশের নিতান্ত দীন-হীন নারী-পুরুষের গায়েও দেখা যেত সোনা রুপোর আংটি, অলংকার, মন্দিরে মন্দিরে দেব-দেবীর স্বর্ণমূর্তি। ম্যানচেস্টারের কাপড় বাংলাদেশি কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠত না বলে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশি কাপড় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের উপনিবেশিক নীতির ফলে শুধু যে কার্পাস চাষ আর তাঁত শিল্পই ধ্বংস হলো তা নয়, এদেশের কৃষককে বাধ্য করা হলো তৎকালীন বিশ্বের কারখানা, ইংল্যান্ডের কলকারখানার জন্য কাঁচামাল প্রস্তুত করতে। এর উদাহরণস্বরূপ নীল চাষের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করে, তাঁতিদের বাড়ি বাড়ি সিপাহী বসিয়ে তাঁত চালানো বন্ধ রাখতো। এ নিয়ে দুই বার তাঁতি বিদ্রোহ হয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের তুলা চাষ স্থানান্তর হয় ইংরেজদের নির্ভরযোগ্য উপনিবেশ আমেরিকায় আর আমেরিকার নীল চাষ আনা হয় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায়। (খনার বচন, কৃষি ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি – ড. আলি নওয়াজ)।

বাংলাদেশ তুলা আমদানিকারক দেশ হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয়। যেসব দেশ থেকে তুলা আমদানি করা হয় তা হলো আফ্রিকা থেকে ৩৭%, ভারত থেকে ২৬%, সিআইএস দেশসমূহ থেকে ১১%, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১%, অস্ট্রেলিয়া থেকে ৫% এবং অন্যান্য দেশ থেকে ১০%।

বিশ্ব তুলা দিবসের গুরুত্ব হলো তুলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটি প্লাটফর্মে আনা। তুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত তুলা উৎপাদনকারী, জিনার, মিলার, গার্মেন্টস মালিকপক্ষ, গবেষক, মিডিয়া-কর্মী, কনজ্যুমারের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো এবং তুলাকে স্বীকৃতি প্রদান ও দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনে জাতিসংঘকে অনুরোধ করা। বাংলাদেশে এই দিবসটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে তুলা চাষের সম্প্রসারণ, গবেষণা জোরদারকরণ, তুলার সাথে সম্পৃক্ত সকল অংশীজনের সাথে সমন্বয়, দেশীয় তুলার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান নামক দু’টি দেশের সৃষ্টি, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো তুলা উৎপাদন হতো না। সমস্ত তুলা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হতো। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া ৩২৫ জন চাষিকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং ঠাকুরগাঁও এর রাণীশৈংকেলে ৭৯৬ একর জমি তাদের মধ্যে তুলা চাষের জন্য বরাদ্দ করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তুলা চাষের শুভ সূচনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা হত্যার মধ্যে বাংলাদেশে তুলা চাষ কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জন্য একটি নিজস্ব ভবনের জায়গা ও অর্থ বরাদ্দ করেছেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বর্তমান মাননীয় কৃষিমন্ত্রী তুলা ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। গত ২০১০ সাল থেকে তুলা চাষের দিকে বর্তমান সরকার গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তুলার আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১,৭৭,৮৮৭ লাখ বেল তুলা উৎপাদিত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০% তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চাষ উপযোগী জমি নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই লাখ হেক্টর এবং তুলার উন্নত জাত ও হাইব্রিড জাত তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রকল্প যা ইতিমধ্যে একনেকের অনুমোদন পেয়েছে। তাছাড়া বিটি কটনের ট্রায়াল সম্পন্ন পূর্বক এ বছরে অনুমোদন পেতে যাচ্ছে চাষাবাদের জন্য।

তুলাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর গবেষণা, সংরক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশেই ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন ২০৪১ সালের মধ্যেই সম্ভব হবে।

তুলা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। বর্তমান বাৎসরিক জিডিপির ১১.১৬ শতাংশ আসে বস্ত্রখাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই সেক্টরে আয় হয়েছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি বছরে কোভিড-১৯-এর কারণে অর্জন কিছুটা কম হলেও বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব তুলা দিবস-২০২০ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তুলার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রম আরও বেগবান হবে এবং অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার।

লেখক: ড. মো. তাসদিকুর রহমান (সনেট), সাধারণ সম্পাদক, কেআইবি, ঢাকা মেট্রোপলিটন এবং উপ-পরিচালক (স: দ:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫।

টপ নিউজ তুলা দিবস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আইভরি কোস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪০

সম্পর্কিত খবর