বিএনপি’র সামনে আরও দুর্দিন আসছে?
৭ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৩
শিরোনামে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, সেটা আমার নিজের নয়। বিএনপি-দরদি বলে পরিচিত, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আজকে বিএনপি করোনাগ্রস্ত। বিএনপি এতোটা করোনাগ্রস্ত যে তারা রাস্তায় নামতে পারে না। তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। বিএনপি এখন এতো দুর্বল হয়েছে যে তাদের সীমানা এসে গেছে প্রেসক্লাবের সামনে ৫০ জনের একটা মানববন্ধন।
বিএনপি সক্রিয় না হলে সামনে দলটির আরও দুর্দিন আসছে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে জাফরউল্লাহ চৌধুরী অতিদ্রুত দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, খালেদা জিয়াকে দেশবাসী এখনও ভালোবাসে। বাইরে থাকা অবস্থায় (খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে তার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার সরকারের কাছে আবেদন করে খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত রেখে জামিনের ব্যবস্থা করেছেন। দুই দফায় তাকে মোট এক বছরের জামিন দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি জেলের বাইরে আছেন। মার্চ মাস থেকে গুলশানের ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছেন। তবে জামিনের শর্ত অনুযায়ী সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন) উনার (খালেদা জিয়ার) দরকার হবে দ্রুত দলের কাউন্সিল মিটিং করা।
ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর এই পরামর্শ খালেদা জিয়া কানে তুলবেন কি-না, তা আমরা জানি না। তাছাড়া কাউন্সিল করার মতো বাস্তব অবস্থাও বিএনপির আছে বলে মনে হয় না। কাউন্সিল করে দলের নেতৃত্ব জিয়া পরিবারের বাইরে কাউকে দেওয়ার সাহসও হয়তো নেই। কাউন্সিল করে আবারো যদি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে মাথায় রেখে জোড়াতালির একটি কমিটি করা হয় তাহলেও বা কী লাভ? বিএনপিতে নতুন প্রাণ-প্রবাহ তৈরি কীভাবে সম্ভব সেটা পরিষ্কার নয় কারো কাছেই।
দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করেন। মানুষের পক্ষে কথা বলার মতো একটি সৎ ও সাহসী রাজনৈতিক দলের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। বিএনপি সরকারের তোপের মুখে দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই। তারা অনেকটাই অনুগত অবস্থায় আছে।
সবচেয়ে বড় কথা, জাফরউল্লাহ চৌধুরী বিএনপির কেউ নন। দলের কোনো কমিটিতে তিনি নেই। তার অবস্থান অনেকটা গায়ে মানে না আপনি মোড়লের মতো। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিএনপি এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেজন্য কেউ কেউ তাকে খালেদা জিয়ার ‘অবৈতনিক পরামর্শক’ বলেও মনে করেন। নানা কারণে দেশের ভেতরে এবং বাইরে জাফরউল্লাহ চৌধুরীর অনেক ভক্ত আছে। তারপরও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তিনি কিছুটা ‘ব্রাত্যজন’। বিএনপি সমর্থক বলে পরিচিত হলেও কেউ কেউ তাকে কিছুটা স্বাধীনচিন্তার মানুষ বলেও মনে করেন। কিন্তু কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে না থাকায় তার বলা কথাগুলো দ্রুত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, কেনো পরিণতি পায় না। বয়সের কারণে তিনি হয়তো কথা এবং কাজের ধারাবাহিকতাও রক্ষা করতে পারেন না। বিএনপি সম্পর্কে কখনো কখনও বিস্ফোরক মন্তব্য করলেও সেটা ভালোবাসা থেকেই করেন বলে ধরে নেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্রয় পান বলে তিনি দলের অন্য নেতাদের খুব হিসেবে ধরেন বলে মনে হয় না।
বিএনপি সক্রিয় না হলে সামনে দলটির আরও দুর্দিন আসছে বলে ডা. জাফরউল্লাহ যে মন্তব্য করেছেন সেটা যদি আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ করতেন তাহলে বিএনপির অনেকেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। কারণ বিএনপি সমর্থকরা সামনে সুদিন ছাড়া কোনো দুর্দিন দেখেন না। বিএনপির একটা জনপ্রিয় স্লোগান হলো: সামনে আছে শুভ দিন, ধানের শীষে ভোট দিন। কারণ যাই হোক, বাস্তবতা হলো, বিএনপি আর ভোটের বাক্স ভর্তি করতে পারছে না। তাই তাদের সুদিনও কেবল দূরেই সরে যাচ্ছে।
বিএনপির কাছে যারা আন্দোলন আশা করেন, তারা আসলে বিএনপিকে বুঝতে ভুল করেন। বিএনপি আন্দোলনের দল নয়। বিএনপি হলো ক্ষমতার দল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকে এই দলের জন্ম দিয়েছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে যারা উচ্চকণ্ঠ তারা ভুলে যান যে বিএনপির একক আন্দোলনে কোনো সাফল্য নেই। বিএনপি আন্দোলন করে কোনো সরকারের কাছে কিছু আদায় করতে সক্ষম হয়েছে তার কোনো রেকর্ড নেই। বিএনপির যা অর্জন তা আসলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থেকে, এককভাবে নয়। তবু কেন যে বিএনপিকে আন্দোলনের দল মনে করে তার কাছ থেকে আন্দোলন আশা করা হয়— এই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নটির উত্তর কারো কাছে পাওয়া যায় না।
বিএনপির প্রচুর সমর্থক আছে। কিন্তু এই সমর্থকরা দলের জন্য জানবাজি রেখে আন্দোলন করার মতো নন। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা হয়তো এটা বুঝেই জামায়াতের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সন্ত্রাস-সহিংসতার মাধ্যমে সরকার পতনের আন্দোলন করতে গিয়ে সফল না হয়ে দলের শক্তিক্ষয় করে এখন নির্জীব হয়ে ঘরে বসে আছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা কিংবা তার জন্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে একটা ভুল ধারণাও অনেকের মধ্যে ক্রিয়াশীল আছে। খালেদা জিয়ার প্রতি একধরনের মুগ্ধতা অনেকের ছিল। এখন আর তা অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। তার মুক্তির দাবিতে দেশে প্রবল আন্দোলন গড়ে না ওঠা থেকেই সেটা বোঝা যায়। বিএনপির বেহাল দশা কী কী কারণে হলো তার কারণ খোঁজা দরকার ছিল দলটির। কিন্তু তা না করে দলের নেতৃত্ব কেবল আকাশ কুসুম করেছেন চয়ন। বিএনপির এখন হাঁটু ভাঙা ‘দ’-এর অবস্থা। জাফরউল্লাহ চৌধুরী বা অন্য যে কেউ সক্রিয় হওয়ার যতোই তাগিদ দেন না কেন, তাতে কাজ হবে না। একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তার জন্য যে সব উপাদান-উপকরণ দরকার, বিএনপিতে এখন সেগুলোর ঘাটতি আছে।
বিএনপিতে এখন আর খালেদা জিয়ার একক নেতৃত্ব কার্যকর নেই। তিনি নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। বড় ছেলে তারেক রহমানকে দলের নেতৃত্বে অস্বাভাবিকভাবে টেনে তুলে খালেদা জিয়া খুব দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে হয় না। কৃত্রিম কোনো কিছুই টেকসই হয় না। নেতৃত্ব উপর থেকে চাপিয়ে দিলে তার ফল ভালো না হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। এখন খালেদা জিয়া এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তারেক রহমানের প্যারালাল নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। “এক ঘর মে দো পীর”। খালেদার ভুক্তকুল এবং তারেকের ভক্তকুলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। তাছাড়া দলে নবীন প্রবীণের বিভাজনও বিরাট। তারেকের সব সিদ্ধান্তের সঙ্গে খালেদা জিয়া একমত হতে পারেন না, আবার খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তারেকের মতভিন্নতার কথাও শোনা যায়। সব মিলিয়ে বিএনপির অবস্থা এখন ‘ঠেলাঠেলির ঘর, খোদায় রক্ষা কর’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সম্প্রতি এক সমাবেশে বলেছেন, সরকারবিরোধী লড়াইয়ের জন্য দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। বিএনপির নীরবতার সুযোগে অন্য কেউ যদি (আন্দোলনের) ঘোষণা দেন, তাহলে তিনি জিয়াউর রহমানের মতো আকস্মিক প্রসিদ্ধ হয়ে পড়তে পারেন।
বর্তমান সরকারকে বিতাড়িত করার জন্য একটি যুদ্ধের, একটি লড়াইয়ের ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গয়েশ্বর রায়। কার প্রতি তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন? খালেদা জিয়া, নাকি তারেক রহমান? খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান আহ্বান জানালেই মানুষ পিল পিল করে রাস্তায় নামবে এমন ধারণা কি খুব বাস্তব সম্মত। তারা তো তেমন ডাক দিয়েছিলেন, মানুষ তাতে সাড়া দেয়নি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে মোকাবিলা করার জন্য বিএনপির অদক্ষতা একাধিক বার প্রমাণিত হয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি আর প্রকাশ্য রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটা বিএনপিকে বুঝতে হবে।
সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ নেই, তা নয়। তবে বিরোধী দলের ওপরও মানুষের আস্থা নেই। বিশেষ করে বিএনপি মানুষের সমস্যা নিয়ে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে কেবল মানুষকে সঙ্গে পেতে চায় বলে মানুষ একধরনের দূরত্ব বজায় রাখে। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে বলে গয়েশ্বর রায় যে মন্তব্য করেছেন, তা অনেকটা হাওয়াই বাণীর মতো। মানুষের মধ্যে কোন কোন লক্ষণ দেখে গয়েশ্বর রায়ের এটা মনে হয়েছে? মানুষ তার কাছে আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেছে?
বিএনপি নেতৃত্ব সম্পর্কে গয়েশ্বর রায় বলেছেন, “আমাদের মধ্যে একটু ঝগড়াঝাঁটি আছে। দলে পদ নিয়ে টানাটানিতে আছি। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন আছি”। তো, দলের এই নড়বড়ে অবস্থান নিয়ে সরকারবিরোধী যুদ্ধে নামলে ফল কি অনুকূলে আসবে? বিএনপিকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের জমিতে পা রাখতে হবে। হঠকারিতা পরিহার করতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। তা না করে অহেতুক তর্জন-গর্জন করে কোনো লাভ হবে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক