Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বনাঞ্চল খেয়ে ফেললে শ্বাস নিতে পারবেন তো?


২৬ অক্টোবর ২০২০ ১৪:৩৩

রংপুর জেলা পরিষদ ভবনের চারপাশের পুরো এলাকাটা যেকোন নিসর্গপ্রেমী মানুষেরই ভালোবেসে ফেলার কথা। শতবছরের পুরোনো বিশাল বিশাল দেবদারু, আম, কাঁঠাল, মেহগনিসহ নানা গাছের ছায়ায় পুরো এলাকাটিই সবুজে ঘেরা ছিল, বড় বড় গাছগুলোতে নানা জাতের অজস্র পাখির স্থায়ী আবাস ছিল। জেলা পরিষদ কার্যালয়ের পশ্চিম পাশের গাছগুলোতে ছিল পাখিদের অভয়ারণ্য। একটা বড় সাইনবোর্ড ছিল। জেলার মানুষ তো বটেই, দূর-দুরান্ত থেকে এমনকি বিদেশিরাও এখানে শেষ বিকালে বা সন্ধ্যায় পাখি দেখতে ও পাখির ডাক শুনতে আসতেন। পাখিদের এই অভয়াশ্রম এবং শান্তসুনিবিড় পরিবেশে যারাই একবার হলেও এসেছেন, প্রবেশ পথের দুই ধারে লাগানো বিশালকায় দেবদারু গাছের ছায়ায় মুগ্ধ হবার কথা তাদের। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই দৃশ্য আর দেখা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

কুড়ালের কোপে এই অনিন্দ্যসুন্দর অভয়ারণ্য ধ্বংস করে ফেলেছেন জেলা পরিষদের কর্মকর্তারাই। সাইনবোর্ডটিও আর নেই। জেলা পরিষদ কার্যালয়ের প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশপথ ধরে দু’ধারে ছায়া হয়ে পাহারা দেওয়া শতবর্ষী প্রাচীন গাছগুলো ছিল সুউচ্চ এবং শাখা প্রশাখায় পরিপূর্ণ। জেলা পরিষদের প্রবেশ পথ প্রশস্ত করার নামে মূল পথটির দু’ধারের এবং প্রাচীরের পাশে থাকা এমন অর্ধশতাধিক শতবর্ষী বা প্রাচীন গাছ গোপনে নিলাম করে বিক্রি করে দিয়েছে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যেই কেটে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে গাছগুলো, বাকি গাছগুলোও কাটা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য পাখির আবাসস্থল, উজাড় হয়েছে তাদের আশ্রয়। বাগানের গাছে-গাছে, ডালে-ডালে নানা জাতের পাখির যে অবিরাম কলরব চলতো, এখন আর তা শোনাই যায়না। বাসস্থান হারিয়ে অনেক বিরল প্রজাতির পাখি এই অভয়াশ্রম ত্যাগ করে চলে গেছে। গাছে বানানো পাখির বাসাগুলো ভেঙে যাওয়ায় সেখান থেকে পাখির ছানা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ধরে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা। সবমিলিয়ে এক বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে!

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে পরিহাসের ব্যাপারটি হচ্ছে জেলা পরিষদের নিদারুণ অসততায় ভরা যুক্তি। প্রবেশপত্র প্রশস্ত করা এবং জীবন্ত এবং সতেজ গাছগুলোকে মরা, শুকনো, ভঙ্গুর ও পোকা খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে সেগুলো কেটে ফেলার জন্য দরপত্র আহবান করেছিলেন তারা। দরপত্রের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭১ হাজার টাকার বিনিময়ে জেলা পরিষদ নগরীর বসুনিয়া ফার্নিচার গাছ কাটার অনুমতি পায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গাছগুলোকে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও উল্লেখ করা হয়। অথচ বঙ্গবন্ধু ম্যুরালসংলগ্ন দু-একটি গাছ থাকলেও জেলা পরিষদ ভবনের সামনে-পেছনে কেটে ফেলা হয়েছে অর্ধশতাধিক গাছ।

১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর জেলা বোর্ডের সময়কার এবং রংপুর শহরের একমাত্র পাখি অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত এই ঐতিহ্য গাছগুলোর নিলাম এবং গাছ কাটা প্রক্রিয়া কঠোর গোপনীয়তার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যেন কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে, না ঠেকাতে পারে। খবর জানাজানি হতে হতে ইতিমধ্যেই কাটা হয়ে গেছে অনেক গাছ, নিসর্গপ্রেমী থেকে সাধারণ জনগণ সবাই ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বেশি করে গাছ লাগাবার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে দেশের অন্যতম পুরোনো জেলা পরিষদ কর্মকর্তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, ব্রিটিশ আমলের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই সবুজের সমারোহ ধ্বংস করছেন নির্দ্বিধায়, “ভেতরে নষ্ট হয়ে যাওয়া গাছগুলো ভেঙে মানুষের গায়ে পড়ে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে” এই যুক্তি দিয়ে সতেজ সবল বিশালকায় গাছগুলো কাটছেন তারা।

ওদিকে করোনার এই কয়েক মাসে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চলছে গাছ কাটার মহোৎসব। সারাবাংলার প্রতিবেদকের সরেজমিন অনুসন্ধানে লাউয়াছড়া বনের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, সবুজ ঝোপজঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে অসংখ্য গাছের গুড়ি। সেগুন, আগর, বনাক, চাপালিশ, লোহা কাঠ, আকাশমণিসহ বিভিন্ন জাতের মূল্যবান গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। শুধু রাতেই নয়, করোনাকালে দিনেও গাছ কাটা হচ্ছে। অথচ করোনার এই সময়ে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় যেখানে সংরক্ষিত এই বনের পরিচর্যা আরো ভালো হবার কথা ছিল, সেখানে বন বিভাগের তথ্যমতেই ১৭১টা বিশাল গাছ চুরি হয়েছে, স্থানীয়দের হিসেবে যার পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। স্থানীয়দের অভিযোগটা পুরোনো। তাদের দাবি বন পাহারার সাথে যুক্ত একদল কর্মকর্তার যোগসাজগেই হচ্ছে এই বন উজাড়। ৩৫ মামলা ও সেগুন, আগর, বনাক, চা পালিশ, আকাশমণিসহ বিভিন্ন জাতের প্রায় ৯০০ ঘনফুট চোরাই কাঠ উদ্ধার হলেও তা চুরি হওয়া গাছের তুলনায় খুবই সামান্য।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে চলতি বছরের ১৬ জুলাই এক কোটি গাছ লাগাবার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যায়ক্রমে ৪৯২টি উপজেলার প্রতিটিতে ২০ হাজার ৩২৫টি করে গাছের চারা রোপন করার এই উদ্যোগের সূচনা করে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে আহবান জানিয়েছিলেন দেশের সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষায় যত বেশি সম্ভব গাছ লাগাতে, গাছ লাগাবার জন্য উৎসাহিত করতে। দেশের বনাঞ্চলের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কেবল কমছেই। সেই ছোটবেলায় পরিবেশ পরিচিতি বইতেই জেনেছিলাম যে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি নাই, আছে ১৭ শতাংশেরও কম। দু’বছর আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১১.২ মতান্তরে সাড়ে ১৩ শতাংশ এলাকায় বনভূমির হিসেব কাগজে-কলমে পাওয়া গেলেও আপনি-আমি-আমরা সবাই জানি ও বুঝি, ক্রমাগত দখলে ও উজাড়ে দেশের বনভূমির পরিমাণ আসলে নেমে এসেছে ১০ ভাগেরও নীচে। এশিয়ার যেসব দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ ঢুকে গেছে সেসব দেশের তালিকায়।

এই দু’বছরে বনাঞ্চলে পরিমাণ কমেছে আরও। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের সময় রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালের প্রথম ৬ মাসেই কক্সবাজার ও টেকনাফের উখিয়া অঞ্চলে উজাড় হয়েছিল পাঁচ হাজার একরেরও বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) ২০১৮ সালের ২৭শে জুন জানিয়েছিল আরও বড় দুসংবাদ। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১১-২০১৮ এই ৭ বছরেই বাংলাদেশের ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এরপরেও পেরিয়েছে আরও দুই বছর। উপরের দুটো ঘটনার মত দেশের নানা অঞ্চলে একদিকে যেমন বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চোরাকারবারীদের হাতে পাচার হচ্ছে সংরক্ষিত বন, বসতি ও শিল্প-কারখানা স্থাপনে উজাড় হচ্ছে ঘন বনাঞ্চলে আচ্ছাদিত এলাকা, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি নানা পক্ষের হাতে বনাঞ্চলের বাইরে প্রাচীন ও শতবর্ষী বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে বিভিন্ন হাস্যকর ও অমার্জনীয় অজুহাতে। একটা গাছ কাটতে খুবই সামান্য সময় লাগে, কিন্তু একটা গাছের বৃক্ষ হয়ে বেড়ে উঠতে, পরিবেশে অবদান রাখতে আর মানুষকে প্রতিদানহীন উপকার করে যেতে সময় লাগে বছরের পর বছর। সেটা এই স্যারদের কে বোঝাবে?

অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বোঝেন, নিজে দেশিয় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের সম্মিলনে এক কোটি গাছ লাগাবার মহতী কর্মসূচীর সূচনা করেন, বনাঞ্চল তৈরি করার জন্য আন্তরিকভাবে আহবান জানান সকলকে, সেখানে রংপুর জেলা প্রশাসন কোন বিবেচনায় পাখির অভয়াশ্রম ধ্বংস করে শতবর্ষী পুরনো বৃক্ষগুলো কেটে ফেলার বন্দোবস্ত করল, তার জবাবদিহিতা জরুরি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও গত বছর শিক্ষার্থীদের জন্য ৫টি হল ও ভবন নির্মাণের উন্নয়ন কার্যক্রমে বিভিন্ন প্রজাতির ১১৩২টি গাছ কাটা পড়বার উপক্রম হয়েছিল, যার ভেতর ছিল বিলুপ্তপ্রায় ৫৩৯টি গাছ। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গাছ কাটা থামাতে বাধ্য হয়। দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো যখন অবিবেচক দখলদারদের বসতি-কারখানার জন্য দখল আর চোরাকারবারীদের জন্য উজাড় হবার মুখে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়-জেলাপ্রশাসন কার্যালয়ের মত শিক্ষিত বিবেকবান সচেতন কর্তৃপক্ষ ঠিক কীভাবে এমন অমার্জনীয় নির্দয় ঘটনা ঘটায়, ভাবতেও অদ্ভুত লাগে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটি হচ্ছে ঠিক এদের হাতেই দেশের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব, তারা দেশের সম্পদ বনাঞ্চল রক্ষায় সাধারণ জনগণকে সচেতন করবেন, আরও গাছ লাগাতে উৎসাহ দেবেন, এটাই কাম্য। অথচ অনেকক্ষেত্রেই ঘটছে ঠিক উল্টো ঘটনা।

আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটায় পরিণত হবে ইতিমধ্যেই ভুগতে শুরু করা বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে তৈরি ঘন ঘন প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানতে থাকবে বাংলাদেশের উপকূলে। অতিবৃষ্টি, বন্যা, গরমের তীব্রতা, শীতকাল প্রায় নাই হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঘরহারা, বাস্তুহারা হবে উপকূলবর্তী কয়েক কোটি মানুষ।

মিল পাচ্ছেন কোন? ঠিক যেভাবে রংপুর জেলা প্রশাসন তুচ্ছ অজুহাতে ধ্বংস করেছে অসংখ্য পাখির অভয়ারণ্য প্রাচীন বৃক্ষগুলো, ঘরহারা, বাস্তুহারা করেছে পাখিগুলোকে, ঠিক সেভাবে বাস্তুহারা হতে হবে আমাদের। সুন্দরবনের মত এই প্রকান্ড বনাঞ্চলগুলো যেমন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় বুক দিয়ে আগলে রাখে উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে, ঠিক তেমনি এই বনাঞ্চলগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাখে সবচেয়ে বড় অবদান। ঠিক এই কারণেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ূ সংকটের আসন্ন মহাদূর্যোগ মোকাবেলায় দেশের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল রাখা আমাদের জন্য এতোটা জরুরি। উল্টো আমরা কি করছি? টেকনাফের উখিয়া অঞ্চল প্রায় সমস্ত বনাঞ্চল উজাড় করার ফলে রীতিমত গনগনে চুল্লি হয়ে উঠেছে সেখানকার আবহাওয়া, মাশুল ইতিমধ্যেই গুনতে হচ্ছে সেখানকার অধিবাসীদের।

মাশুল গোনার আরও অনেক বাকি আমাদের।

করোনা বনাঞ্চল বৃক্ষরোপন রংপুর রা'আদ রহমান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর