করোনাভাইরাস সচেতনতা: কতটুকু পরিবর্তন এই আট মাসে?
২৬ অক্টোবর ২০২০ ১৯:২১
দুদিন ধরে মাঠেঘাটে ঘুরছি, অচেনা অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার মধ্যে মাস্ক পরা দেখেছি সব মিলিয়ে ছয়জনকে। তাদেরই একজনের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলাম। কেন মাস্ক পরেন—একথা জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন, ‘আমি পরতে না চাইলেও আমার মেয়ে জোর করে পরিয়ে দেয়। বাড়ি ফিরে গেলে মেয়ে জীবাণুনাশক স্প্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।’
তার কথায় বুঝতে পারলাম—বাড়িতে স্ত্রী, মা, মেয়ে সচেতন থাকলে অন্যরাও সচেতন হতে বাধ্য।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সাত মাস পার হলো। দীর্ঘ সাত মাস পর মানুষের সচেতনতার মাত্রা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চিত্র এবং মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য গিয়েছিলাম গাজীপুরে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়া উপজেলায় কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্র্যাক একটি বহুমুখী কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছে। তার প্রস্তুতি হিসেবেই এই ফিল্ড ভিজিট।
মার্চে যখন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় তার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির অনেকটাই পার্থক্য চোখে পড়ে। তখন গণমানুষের মধ্যে যে সচেতনতা ছিল, তার অনেকটাই এখন বিলুপ্তপ্রায়। লকডাউনের সময়ে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল। জরুরি কাজ না থাকলে মানুষ পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হতো না। পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে।
তরুণ-যুবক নানা বয়সের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘরের ছোটোখাটো কাজে যেহেতু তারাই বেশি বের হন, তাদের মানসিকতা বোঝা জরুরি। কলেজ পড়ুয়া একজন ছাত্র বলছিল, ‘মাঝে দুই তিনমাস ঘর থেকে বের হইনি। এখন আবার স্বাভাবিক। আগের মতো বের হচ্ছি। চা খেতে আসি। বিকালে ৮-১০ জন বন্ধু মিলে আড্ডা দিই।’ যখন জানতে চাইলাম, করোনার ভয় কাজ করে কি না। তখন একজনের সহাস্য জবাব ‘খেলাধুলা করি, সারাদিন হাঁটি, যে পরিমাণ ঘাম বের হয়, এতে করোনা কেমনে হবে? ঘামের সাথেই তো বের হয়ে যাওয়ার কথা।’ তার কথা শেষ হতে না হতেই আরেকজন বলে উঠল, ‘আমরা জোয়ান, আমাদের ভয় নেই। হইলেও সুস্থ হইয়া যাব।’ তাই মাস্কের প্রয়োজন পড়ে না। উপজেলার সব জায়গায়ই তরুণদের এই ‘অকুতোভয়’ মনোভাব চোখে পড়ল; ফলাফল, মাস্ক না পরে অবাধে ঘোরাফেরা।
তবে অনেকে বাসায় মা-বাবাসহ অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন বলেও সচেতন থাকছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন।
সচেতনতা যা চোখে পড়ল কিছুটা বয়স্কদের মধ্যেই। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটার সময় এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ হলো। বয়স ৬০-এর কাছাকাছি। মাস্ক পরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। মাস্ক পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘বাবা, আমি অসুস্থ হলে আমাকেই তো ভুগতে হবে। কেউ আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে না। তাই যতটুকু পারি সচেতন থাকি।’ ব্র্যাক অফিসে আরেকজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনিও বলছিলেন, ‘মার্চের শুরুতেও অনেকে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, এই বিষয়গুলো মেনে চলতেন। আমি কিন্তু এখনও বাইরে গেলে এক মিনিটের জন্যেও মাস্ক খুলি না। আমার এমনিতেই অনেক রোগব্যাধি। করোনা হলে বাঁচি কি না। মৃত্যুভয় তো আছে।’
তবে তার ব্যতিক্রমও চোখে পড়েছে। চায়ের দোকানে বসে ছিলেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক। কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। গ্রামে তার বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। আসা-যাওয়ার পথে সবাই সালাম দিচ্ছিল। পাঁচ-ছয়জন সঙ্গিসাথি নিয়ে বসে গল্প করছিলেন। বিনয়ের সাথেই মাস্কের কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে করোনা আসছে কয়দিন? ছয় মাস। আমরা এই ছয় মাসে এত এত জায়গায় গেলাম, ঘুরলাম, কাজ করলাম। এরপরেও যেহেতু হয় নাই, আমাদের আর হবে না।’
একজনকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। রাস্তায় চলার পথে ৭৫ বছর বয়সি এক বৃদ্ধের সাথে দেখা। প্লাস্টিকের খেলনা, চুড়ি-ফিতা, হাড়িপাতিল মিলিয়ে কাঁধে বিশাল এক ঝাঁকি নিয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছেন। এত ভারী ঝাঁকি তার কাঁধ নিতে পারছে না, নুইয়ে পড়ছে। এই বয়সেও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, এত ছুটছেন, করোনায় ভয় মনে বাসা বাঁধে না? জিজ্ঞেস করলাম তাকে। বললেন, ‘বাবা, তিন মাস বাসায় বসে ছিলাম। নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাকে খাওয়ানোর কেউ নাই। নিজেরটা নিজেরই খেতে হবে।’
একটু থেমে বললেন, ‘আপনি কিছু কিনবেন? অনেক কিছু আছে।’ এরকম মানুষেরও অভাব নেই। ঘরে বসে থাকা তাদের জন্য অসম্ভব, ১০ টাকায় মাস্ক কেনাও তার কাছে বিলাসিতা, বার বার হাত ধোয়ার ফুরসত কই?
আসলেও তাই, এই যুদ্ধে মানুষের ভয় কেটে গেছে। যা হওয়ার হবে, সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করবেন এমন বিশ্বাস নিয়ে সবাই সবার জীবনের রথ ছোটাচ্ছেন। একজন বললেন, ‘লকডাউনের সময় ব্র্যাক অফিসের সামনের রাস্তাটির অনেক ভেতরে একটি বাড়িতে একজনের শুধু জ্বর হয়েছিল, ওই রাস্তা বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। বহুদিন ওই তো বাসা দূরে থাক, কেউ রাস্তার ধারেকাছেও যায়নি।’ মায়েদের কাছে শুনলাম, এই গ্রামের অনেক পাড়া লকডাউন করা ছিল। বাইরের কেউ আসেনি, বাচ্চাদেরও বাড়ির বাইরে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি, সকল নিয়নকানুন মেনে চলেছেন। তার সাথে বর্তমানের অনেক পার্থক্য দেখলাম। ভয় কেটে তার মধ্যে বেঁচে থাকতে শিখে গেছে সবাই।
মহামারির এই সময় মানুষকে সচেতন রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ব্র্যাক। ফিল্ড অফিস, এরিয়া অফিস থেকে শুরু করে হেড অফিস, দেশজুড়ে ব্র্যাকের কর্মীরা নিজেরা সচেতন থেকেছেন, অন্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করেছেন। মহামারি প্রতিরোধে ব্র্যাকের সিএসটি (কমিউনিটি সাপোর্ট টিম) এর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন, নিজেদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন অন্যান্য কর্মসূচির কর্মীরাও।
এদেশের মানুষ যুদ্ধ, আন্দোলন, বন্যা, ঝড়ের মধ্যেই লড়াই করে বেঁচে থেকেছে। খুব বেশি দিনের জন্য জনজীবন স্থবির করা যায়নি। এবারেও যায়নি। অনেকে তো বাংলাদেশে করোনার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান। তাই সবাইকে বর্তমান বাস্তবতায় আবারও মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার কথা বলা এবং তাতে অভ্যস্ত করা যে চ্যালেঞ্জিং হবে, তা বুঝতে পারলাম। তবে, ব্র্যাক কখনো হাল ছাড়েনি। ৯০-এর দশকে প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেশের সবাইকে স্যালাইন বানানো শিখিয়েছে ব্র্যাক। আরও একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক।
লেখক: উন্নয়নকর্মী, ব্র্যাক