Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নবীর ভাবমূর্তি: তার শিক্ষা বনাম বাস্তব অবস্থা


৩০ অক্টোবর ২০২০ ২১:৪৪

সহিংসতা দাবানলের মতো। একবার শুরু হলে থামতে চায় না। বড় বড় দাবানলগুলো থামানোর জন্য কি করা হয় জানেন? আগুন যেখানে লেগেছে তার থেকে বেশ কিছুটা সামনে একটা বড় এলাকাজুড়ে গাছ কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সিদ্ধান্তটা অমানবিক কিন্তু দাবানল ঠেকানোর জন্য এর চেয়ে কার্যকরী পথ আর হয়না। দাবানলের আগুন যখন গাছ থেকে গাছে ছড়িয়ে ওই জায়গায় পৌঁছে, তখন আর নতুন করে ছড়ানোর জন্য গাছ পায় না, দাবানল থেমে যায়। ফলশ্রুতিতে বাকি জঙ্গলের গাছগুলো আগুন থেকে রক্ষা পায়।

সহিংসতাও অনেকটা দাবানলের মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত এক বা উভয় পক্ষ সরে না দাঁড়ায়, ততক্ষণ এটি চলতে থাকে। নবী করিম (সাঃ) এর ব্যঙ্গচিত্র কেন্দ্রিক ফরাসি সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং অবস্থানের কারণে সারাবিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে কার্টুন আঁকা নিয়ে ফ্রান্সের একটি ম্যাগাজিনের উপর অনেকদিন ধরেই ক্ষুব্ধ মুসলিম বিশ্ব। এটা নিয়ে বেশ কিছু খুন-জখমও হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। সম্প্রতি ফ্রান্সের একটা স্কুলে নবী করিম (সাঃ) এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি দেখান এক শিক্ষক। এটি নিয়ে ওই এলাকায় ব্যাপক হৈ চৈ শুরু হয় এবং একজন ১৮ বছর বয়স্ক চেচেন উগ্রবাদী সেই শিক্ষকের মাথা বিচ্ছিন্ন করে তাকে হত্যা করে।

এরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এই কার্টুন আঁকা এবং তার প্রচারকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে ঘোষণা দেন এবং বলেন তার সরকার এই ধরণের ছবি ও কার্টুন প্রকাশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে সমর্থন করবে। ফরাসী সরকার নবী (সাঃ) এর কার্টুন চিত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নানা ভবনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিরক্ষায় দেখানো শুরু করে। ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সরকার এখন সংসদে নতুন বিল উত্থাপনের প্রক্রিয়ায় আছে যা মুসলমানদের ফ্রান্সের সংস্কৃতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের সাথে যেকোন সাংঘর্ষিক অবস্থানে যেতে বাঁধা দেবে।

এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় নানা দেশের নাগরিকেরা ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্ক এবং পাকিস্তান মোটামুটি রাষ্ট্রীয়ভাবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সবচেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশের মুসলমানরা এবং সারা বিশ্বের মিডিয়া বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতিক্রিয়াকে সবচেয়ে বেশী ‘হাইলাইট’ করেছে। ফ্রান্স সরকার তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক এবং মৌরিতানিয়ায় ভ্রমণে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) ভোরে ফ্রান্সের নিস শহরে মুসলিম উগ্রবাদীরা একটি গির্জায় হামলা চালিয়ে তিনজনকে খুন করেছে যার মধ্যে একজনের মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ তামাশা করা অহেতুক এবং উস্কানিমূলক। ইসলাম ধর্মে এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা আছে। অনেকে বলতে পারেন, ফ্রান্সের কার্টুনিস্ট বা রাজনীতিবিদরা তো মুসলিম নন, তাহলে এই নির্দেশনা তাদের মানতে হবে কেন? আমি ব্যাপারটা ভিন্নভাবে দেখতে চাই। আমার কাছে এটি ইসলাম ধর্মের নির্দেশ মানার বিষয় নয়, আমার কাছে এটি পারস্পরিক রুচি ও শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপার। আমি যেটা বুঝতে পারি না সেটি হচ্ছে আপনি কেন আগ বাড়িয়ে একটা গোষ্ঠীর আবেগের জায়গায় আঘাত করবেন? নবী (সাঃ) বা ইসলাম ধর্মের বাণী বা আদর্শ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, এবং যে কেউ এই বিষয়ে গঠনমূলক ও রুচিশীল বিতর্কে শামিল হতে পারেন, কিন্তু সরাসরি ব্যক্তি আক্রমণ পরিস্থিতি খারাপ করা ছাড়া কোন সে বাক-স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেয়, আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত নই।

দেখুন সারা পৃথিবীতেই নানা সমাজ, রাষ্ট্রে কিছু রীতি-নীতি আছে। যেগুলো অন্য দেশ ও নাগরিকরা মেনে চলে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে law against ‘holocaust denial’ এর কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি ধর্মালম্বীকে মেরে ফেলা হয়। পৃথিবীর ১৬টি দেশে সুষ্পষ্ট আইন আছে যে এই হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করা যাবে না। অর্থাৎ কেউ যদি বলে যে এই ইহুদি হত্যাযজ্ঞ ঘটেনি বা ঘটলেও সেটি ঠিক ছিল, তবে তারা আইনত অপরাধী বিবেচিত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হবে। ফ্রান্সও তাদের সংবিধানের মাধ্যমে ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে আইনি বিধিনিষেধ জারি করেছে। আসুন দেখা যাক সেখানে কী বলা আছে-

“In France, the Gayssot Act, voted for on July 13, 1990, makes it illegal to question the existence of crimes that fall in the category of crimes against humanity as defined in the London Charter of 1945, on the basis of which Nazi leaders were convicted by the International Military Tribunal at Nuremberg in 1945–46. When the act was challenged by Robert Faurisson, the Human Rights Committee upheld it as a necessary means to counter possible antisemitism.[26] Similarly, the applications of Pierre Marais and Roger Garaudy were rejected by the European Court of Human Rights, in 1996 and 2003.[27]”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যেই ফ্রান্স ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করাকে বাক-স্বাধীনতা মনে করে না, তারাই আবার মুসলমানদের নবী করিম (সাঃ)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন বানানোকে বাক-স্বাধীনতা মনে করছে। সুতরাং ফ্রান্সেরই বিদ্যমান আইনের আলোকে এটাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ঘৃণা ও আক্রমণ না ভাবার কোন কারণ আমি দেখছি না।

আবার খেয়াল করে দেখুন, পৃথিবীর অনেক দেশের নাগরিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আসার সময় তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে মাথায় রাখার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ ভ্রমণের সময় বিদেশী নাগরিকরা এখানকার স্থানীয় পোশাক পরেন। তুরস্কে মসজিদ ভ্রমণের সময় নারীরা মাথায় ঘোমটা ও নারী-পুরুষ সকলে শরীরে লম্বা কাপড় জড়িয়ে নেন। এটি করেন সেই দেশের সংস্কৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য। এটি একটি ভদ্রতা, এখানে জোরাজুরির কিছু নেই।

সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ভূমিকাকে উদার দৃষ্টিতে দেখবার কিছু নেই। কিন্তু যেটি ভাববার বিষয় সেটি হচ্ছে তাদের আক্রমণের সূত্রপাত বুদ্ধিবৃত্তিক। তারা বাক-স্বাধীনতার মতো জনপ্রিয় ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে তাদের যুক্তি-উপাত্ত উত্থাপনের জন্য। কিন্তু বিপরীত দিকে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে খুবই আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। ইতিমধ্যে গত কয়েকদিনে ৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ফ্রান্সে। যা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে মাথায় রাখা দরকার ফ্রান্সের মতো দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশ বা ইন্দোনেশিয়ায় নাগরিকত্ব লাভের আশায় যান না। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মুসলমান প্রতিবছর ফ্রান্স, ও ইউরোপের নানা দেশে স্থায়ীভাবে থাকবার জন্য যান। আরও লক্ষ মানুষ যান কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে। এসব দেশ মুসলিমপ্রধান নয়, এবং মুসলমানদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সেসব দেশের অভিবাসীরা নানামুখী বিপর্যয়ের শিকার হতে পারেন। ‘Hate crime’ পশ্চিমা বিশ্বে খুব সাধারণ ঘটনা এবং মুসলমানরাই মূলত এর শিকার হন। এখন যেসব নিরীহ মুসলমান অভিবাসী নির্বিবাদে একটা শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে চান, তারাও কিছু উগ্রবাদী মুসলিমের নির্বোধ কর্মকান্ডের কারণে বিপদে পড়বেন।

ফ্রান্সের পণ্য বয়কট নিয়ে আমি তেমন বিচলিত না। আমি মনে করি যে কেউ চাইলে যে কারও কোন পণ্য বর্জন করতে পারেন, এটাই বরঞ্চ আমার কাছে স্বাধীন মত প্রকাশ বা প্রতিবাদের একটা অহিংস উপায় বলে মনে হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে ফ্রান্স যদি উল্টো আমাদের পণ্য বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় সেটি। ফ্রান্স হচ্ছে বিশ্ব ফ্যাশন বাণিজ্যের পুরোধা। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। ফ্রান্সের যে পণ্য বর্জনের কথা আমাদের দেশে আলোচনা হচ্ছে সেগুলো তাদের রফতানি বাণিজ্যের খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, অন্ততপক্ষে প্রতিবাদ করা মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর আমদানির হিসাব অনুযায়ী। তাদের মূল রফতানি পণ্য কেনে আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের মত দেশগুলো এবং এতে করে তাদের বাণিজ্য বৈষম্য ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই।

সবকিছুর উপরে ভাবছিলাম সহিষ্ণুতার কথা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট একটা উস্কানিমূলক অবস্থান নিলেও তাতে করে আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হবে এমন কি কোন কথা আছে? হযরত মুহম্মদ (সাঃ) মুসলমানদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি এবং তাঁর অবস্থান অন্য কারও কটূক্তি কিংবা অসম্মানে কোনভাবেই বিঘ্নিত হবার কথা না। কেউ যদি নবী (সাঃ)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে চায়, সেটি তার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার এবং তার চিন্তার অগ্রসরতাকেই বরঞ্চ প্রশ্নবিদ্ধ করে, নবী (সাঃ) এর ব্যক্তিত্বকে নয়। আমি মনে করি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং তার সরকারের কাছে অনেক কিছুই শেখার আছে। ফরাসি সরকার যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ধর্মের প্রধান ব্যক্তিকে আক্রমণে ব্যস্ত, তখন কানাডা সরকারের মন্ত্রীরা গতকাল কানাডা ও সারা বিশ্বের মুসলমানদের হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর জন্মদিন উপলক্ষে ইদ-ই-মিলাদুন্নবীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

কানাডার সরকারের কাছ থেকে শেখার আছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সরকারগুলোরও। বৈশ্বিক এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ নানা দেশের সরকার (শুধু মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর নয়) প্রধানদের উচিৎ ফরাসি সরকারের উস্কানিমূলক অবস্থানের প্রতিবাদ জানানো এবং একই সাথে নিজের দেশে মানুষদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করে একটা শান্তিপূর্ণ বৈশ্বিক সমাধানের দিকে এগুনোর চেষ্টা করা। সাথে সাথে ইসলামী জঙ্গিদের খুন-জখমের প্রতিবাদ করাও তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন যেখানে কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, সেখানে তার প্রতিবাদস্বরূপ মানুষ হত্যা হাজারগুণ বড় অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য। শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিচারিতা ও দৈন্যতা রাষ্ট্রগুলোতে এমন ধর্মীয় অন্ধত্বের জন্ম নিয়েছে যা ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে হচ্ছে না।

সবার কাছে অনুরোধ থাকবে নবী (সাঃ) এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে চাইলে তাঁর জীবনী পড়ুন, তাঁর রেখে যাওয়া উত্তম আদর্শগুলোর বাস্তবায়ন করুন। হত্যা-খুন-জখম ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে আপনারা ওই কিছু ব্যঙ্গ কার্টুনের চাইতে তাঁর ভাবমূর্তির অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করছেন।

শামীম আহমেদ, টরোন্টো, ক্যানাডা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর