তাহলে আবার ট্রাম্প!
১ নভেম্বর ২০২০ ১৯:২১
মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থাটাই এমন যে, এটির ফলাফল নিয়ে আগাম খুব একটা বেশি কিছু বলা যায় না। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থেকেও হতে পারেননি প্রেসিডেন্ট। সেসময় মার্কিন নাগরিকরা একজন নারীকে তাদের মূল নেতা হিসেবে বেছে নিতে রায় দিলেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একজন নারীর টিকে থাকাটা আর হয়ে ওঠেনি। শেষমেশ পুঁজিবাদের কাণ্ডারি ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের কাছেই চলে যায় ক্ষমতা। এতে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পরও হার মানেন হিলারি। আর ব্যবসায়ী ট্রাম্প রাজনীতির মাঠে নেমেই পূর্ণ স্কোর তুলে ঢুকে যান হোয়াইট হাউজে।
এবারও খেলাটাও একই রকম। মাঠের পরিস্থিতি দেখে তাই মনে হচ্ছে। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচন খুব কাছ থেকে দেখেছি। শীর্ষ একটি অনলাইনের কর্মী হিসেবে প্রতিনিয়তই সংবাদ প্রকাশ করেছি। এবারও একটি টেলিভিশনের আন্তর্জাতিক ডেস্ক থেকে বিষয়গুলো খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে হচ্ছে। হিলারির যেমন জনপ্রিয়তা দেখা গিয়েছিল গতবার, এবারও তাদের দলের প্রার্থী জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা দেখছি। হিলারির মতো বাইডেনও এগিয়ে প্রায় সব জরিপে। এমনকি মধ্যাঞ্চলীয় উইসকনসিন ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যসহ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। এতে তার জয়ের ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী। তার মানে কি রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেই যাচ্ছেন?
আদতে সমস্যা অন্যখানে, সুবিধাজনক অবস্থানটা ভোটারদের কেন্দ্র থেকে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ভাগ্য সরাসরি ভোটারদের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। হয় ‘ইলেকটোরাল কলেজে’। এখানে একদল ব্যক্তির পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ‘কলেজ’ শব্দটি বলতে একদল মানুষকে বোঝায়, যারা ইলেক্টর বা নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। তাদের সবার কাজ প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা। তাদের সংখ্যা ৫৩৮ জন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন দেশটির বিশাল আকার ও বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ কঠিন ছিল। ফলে জাতীয়ভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এছাড়া তখনও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয় ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি। অঙ্গরাজ্যগুলোও তাদের নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেক বেশি সোচ্চার। রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। পপুলার ভোটকে তাই ভয় হিসেবে দেখা হতো। তাই চালু হয়, ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ পদ্ধতি।
প্রত্যেক চার বছর পর পর, নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ পরে ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচকরা একত্রিত হন তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, এই পদ্ধতিতেই একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের আইনের জটিল এক সমন্বয়ের মাধ্যমে তৈরি। কোন রাজ্যের কতজন নির্বাচক থাকবেন সেটা নির্ভর করে ওই রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর। মোট ইলেকটোরাল ভোট ৫৩৮ এর অর্ধেক ২৬৯ এবং জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউজে যাওয়ার জন্য আরও একটি ভোট এভাবেই ২৭০টি ভোট পেতে হবে একজন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে।
গেলো বার নির্বাচনে ইলেকটোরাল ভোট বেশি পেয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারও তিনি সেই আশাই করছেন। ট্রাম্পের পক্ষে যারা বিনিয়োগ করেছেন, নির্বাচনি ব্যয় যুগিয়েছেন তারা সবাই শীর্ষ ব্যবসায়ী। আর বাইডেনের পক্ষে বিনিয়োগ করেছেন তুলনামূলক কম ধনী ব্যক্তিরা। তাই বড় বড় ব্যবসায়ীদের প্রভাবও নির্বাচনের মাঠে বড় ফ্যাক্টর। গেলো নির্বাচনে যে ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে এই নির্বাচনে। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক মন্দা দেশটিতে। তবুও থেমে নেই অর্থের খরচ। বড় বড় ব্যবসায়ীদের পকেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঠিক এসেছে এই মহামারিতেও। ফলে তারা চাইবেনও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রার্থীর জয়। সেক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ যে বাইডেন নয়, তা বলাই যায়। ট্রাম্প এক সমাবেশে বলেছেন, ‘জো বাইডেন বামপন্থি মানুষ। তিনি জিতলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন দেশে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ঘরানার নয়। এদেশে পুঁজিবাদের রাজত্ব থাকবে’। সুতরাং স্পষ্ট যে, ট্রাম্প কী ইঙ্গিত করেছেন।
আসলে সস্তায় মিলছে না বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন চাকরি। তার জন্যই এতো দৌড়ঝাঁপ। যা ট্রাম্প ভালো করেই বোঝেন। হোয়াইট হাউজে ঢুকতে বা থেকে যেতে অবশ্য বাইডেনও বড় ধরনের ব্যয় করছেন। স্বভাবতই ট্রাম্প এখানে শীর্ষে। আর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ বরাবরই রয়েছে যে, নিজে ধনিক শ্রেণীর মানুষ আর তিনি পৃষ্ঠপোষকতাও করেন ধনীদেরই।
এর আগে ২০১৬, ২০০০, ১৮৮৮, ১৮৭৬ সালে রিপাবলিকান প্রার্থীদের বেশি ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ার নজির আছে। সেই নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাটরা বেশি সাধারণ ভোট পেয়েও নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হন। কোভিড-১৯-এর এই সময়ে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটাতে নতুন কোনো প্রার্থীর চেয়ে তুলনামূলক অভিজ্ঞতা আছে এমন প্রার্থীকেই বেছে নিতে চাইবেন অনেকে। ভালো হোক, খারাপ হোক, মহামারির এক ধাক্কা সামাল দেওয়ার কিছু অভিজ্ঞতা ট্রাম্পের আছে। এছাড়াও অর্থের প্রাচুর্য থাকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম বলেও মনে করেন অনেক রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি। কারণ পরিস্থিতি ঠিক করতে চাই দ্রুত উদ্যোগ। নতুন কেউ দ্রুততা দেখাতে পারবেন না— এই কথা ট্রাম্প বারেবারে বলেছেনও। যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন তার মুখে এই কথাই স্পষ্ট হয়েছে। আর মাত্র চার বছরে কারো রাজনৈতিক দর্শন স্পষ্ট হয়ে যায় তাও মনে করেন না অনেকে। তাই বাইডেন সবদিক দিয়ে অভিজ্ঞ হলেও এ যাত্রায় তিনি পার নাও পেতে পারেন।
একবার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থেকে আরেকবার ক্ষমতা ধরে না রাখতে পারার মতো বোকা ট্রাম্প নন। তিনি জানেন, জয়ের কৌশলগুলো কী কী। কীভাবে কাজ করতে হয় তাও তার অজানা নয়। আর কথা ও কাজে ট্রাম্প এখনও কতটা পটু তা তার নির্বাচনি প্রচারণায় প্রমাণ মিলেছে। ‘ভদ্রলোক বাইডেন’কে পরাস্ত করতে কৌশলী ট্রাম্প তার সেরা চাল এখনও অবশিষ্ট রেখেছেন বটে।
যদিও উদার নীতির জন্য আশা করবো নতুন কিছু ঘটুক। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন নতুন এক মোড়কে তা মোটেও ভালো ভাবে নিচ্ছেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। বাইডেনের অভিজ্ঞতা আছে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে, ১৯৭২ সাল থেকে সিনেটর হিসেবে তিনি কাজ করছেন, অনেক কিছু বোঝেন-জানেন এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ (যদিও বয়সটা একটু বেশি বলে সমালোচনা আছে)। তাই একটা ‘চমক’ আসতেই পারে। যদিও শব্দটা চমক বলা ঠিক হবে না, কিন্তু ট্রাম্পকে হারাতে সত্যিকারের জাদুকরী কিছু বা কারিশমা ছাড়া আর কিছু সম্ভব নয়।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক ও টেলিভিশন সাংবাদিক