জনপ্রতিনিধিদের মালিকানাবোধ না থাকা দুঃখজনক
৬ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৩৯
স্বাধীন দেশে একজন জনপ্রতিনিধির বড় যোগ্যতা তার মালিকানাবোধ(Ownership mentality)। যেহেতু আমাদের দেশপ্রেমিক পূর্বপুরুষরা এই মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্যই বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মালিকানাবোধের সঙ্গে দায়িত্বশীলতা (Responsibility) ও ব্যবস্থাপনার (Management mentality) অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকে। তারা জনসেবক হওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচিত হন এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ বাক্য পাঠ করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনে থেকে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা (ছোট সেবকরা) দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন। জনপ্রতিনিধিরা অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের কর্মচারীরা নিরপেক্ষভাবে ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন কি না, সেটা দেখাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে । কিন্তু কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রের কর্মচারীরা এখন জনপ্রতিনিধিদের কাজ করছেন।
দীর্ঘ ৪৮ বছরে কেন যে আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিকদের মনে মালিকানাবোধ জাগ্রত হলো না, তা রীতিমতো গবেষণার দাবী রাখে। সেটা কী দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল, নাকি রাজনীতিকদের সদিচ্ছার অভাব? গত ১২ অক্টোবর বেড়া উপজেলার সমন্বয় কমিটির সভা চলাকালে বেড়া পৌর মেয়র আব্দুল বাতেন উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাজির হাট ও নগরবাড়ি ঘাট তার পক্ষের লোকদের ইজারা দেওয়ার জন্য একটি লিখিত রেজুলেশন উপস্থাপন করেন এবং তা অনুমোদন দেওয়ার জন্য চাপ দেন। ইউএনও আসিফ আনাম সিদ্দিকী বিষয়টি সরকারি নীতিমালা বিরোধী বলে মন্তব্য করলে মেয়র তাকে গালিগালাজ করেন এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। পরদিন এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। বেড়া বর্তমানে ‘ক’ শ্রেণীর পৌরসভা। আব্দুল বাতেন ১৯৯৮ সালে মেয়র পদে নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হয়ে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের সঙ্গে সীমানা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ফলে ওই পৌরসভায় ১৭/১৮ বছর কোনো নির্বাচন হয়নি। ২০১৮ সালে মামলাটি খারিজ হয়ে গেলে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হন (এবারও তিনি আরেকটি মামলা দায়ের করে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেন)। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বহু অভিযোগ রয়েছে। দুদক তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে তিনটি মামলা দায়ের করে; যা এখনও বিচারাধীন রয়েছে। তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ম্যাব (Municipal Association of Bangladesh)- এর সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন।
একটি ইউনিয়নে চারটি শর্ত পূরণ হলে, সর্বোপরি আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করলে সেই ইউনিয়নকে পৌরসভা ঘোষণা দেওয়া হয়। পৌরসভা ইউনিয়নের চেয়ে বেশি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে এবং পৌরসভায় কর্মচারীর সংখ্যাও বেশি। সেজন্য মেয়রদের অধিক দায়িত্বশীল হতে হয়। কিন্তু কোনো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় প্রমাণ হয়, দলে যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ে গাফিলতি রয়েছে এবং ম্যাবও যথাযোগ্য ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচিত করছে না। অর্থাৎ, কোনো পক্ষই স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার জন্য আন্তরিকতার পরিচয় দিচ্ছে না।
আবার ১০ অক্টোবর ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মুজিবর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) সরকারি কর্মকর্তাদের গালিগালাজ করেন এবং হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করেন। তার অভিযোগ প্রশাসন ইচ্ছে করেই তার পক্ষের লোকদের গ্রেফতার ও হয়রানি করেছে। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক বলেন— প্রশাসন ইসি’র দেওয়া দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। অর্থাৎ, তিনি নিজে একজন আইনপ্রনেতা হয়েও আইন ভঙ্গের পক্ষে (নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করায় ইসি’র নির্দেশে স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন এবং বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন)।
গত ২৫ অক্টোবর রাতে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকা (দক্ষিণ) সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে বহনকারী একটি জীপের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ ঘটনার জের ধরে উভয়ের মধ্যে কাটাকাটি হয় এবং কাউন্সিলর ইরফান নৌ কর্মকর্তাকে মেরে আহত করেন। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে আছেন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। যতদূর জানা গেছে, ইরফানের শ্বশুর নোয়াখালী এলাকার সংসদ সদস্য এবং শাশুড়ি একজন উপজেলা চেয়ারম্যান। সেক্ষেত্রে একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব সম্পর্কে তার বেশি জানাশুনা থাকার কথা।
শুধু ওইসব ঘটনাগুলোই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ গত ১৫ অক্টোবর’২০ তারিখে ‘ ব্যুরোক্রেসির মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়— “কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিদের বেআইনি কথা না শোনায় কর্মস্থল থেকে পালাতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। কেউ কেউ তদবির করে অন্যত্র পোস্টিং নিচ্ছেন।”
এমতাবস্থায় জাতীয় ও স্থানীয় তথা, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন ছাড়া জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, জনসাধারণ কারোর মধ্যেই মালিকানাবোধ (Ownership mentality) জাগ্রত করা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিকদেরই সেই গণতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ব দিতে হবে। কারণ দায়িত্বটা তাদেরই।
লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক