জমবে ভ্যাকসিন বেচাকেনা, কমবে করোনা
৮ নভেম্বর ২০২০ ১৩:৫৫
টিকা বা ভ্যাকসিন লাগবে না, করোনা এমনিতেই চলে যাবে— এ কথা থেকে সরে গেছি আমরা। এখন বলা হচ্ছে, করোনা আরও ধেয়ে আসছে। শীতে ধকল আরও বাড়বে। ভ্যাকসিন না এলে করোনা খেদানোর আশা নেই। জীবন রক্ষার প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। এই ঘরে থাকার অর্থও পরিষ্কার নয়। যারা এই পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের অনেকে নিজেরা ঘরে না থেকে জাগতিক সব কাজই করে যাচ্ছেন। বাদবাকিদের নসিয়ত করছেন ঘরে থাকতে। নইলে মরণ। এই দ্বীচারিতার জবাব বা ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।
কেবল আমরা নই, করোনা নিয়ে দেশে-দেশে কথামালা, বাৎচিত এমনই। যে যা পারছেন বলছেন। গেলাচ্ছেন মানুষকে। কেউ ভয় দেখাচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন ডেমকেয়ারের সবক। কোনোটাই এমনি এমনি নয়, সবই উদ্দেশ্যমূলক। মতলব নিয়ে যার যার নানা হিসাব। করোনা নিয়ে বাণিজ্য অনেক হয়েছে। এর ভ্যাকসিন নিয়ে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসাটা এখনও শুরু হয়নি— তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়। সাদা চোখেই আঁচ করতে পারছে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষ। এর আগ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনার মধ্যে দুধের মজা মাঠায় মেটানোর প্রতিযোগিতাটা বেশ জম্পেশ। এর আগে, কিট নিয়েও কম হয়নি। এখন ভ্যাকসিনের পালা। এই রেসে আগুয়ান ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অক্ষমরাও। কে কাকে শিকার করবে?—সেই পর্বও চলমান।
করোনায় ভয় বাণিজ্য এবং রাজনীতি-কূটনীতি হঠাৎ শুরু হয়নি। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, করোনার চিকিৎসা এখনো ধারনা ও গবেষণা-নির্ভর। এই এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়েই দেশে-দেশে মানুষ মরছে। আক্রান্ত হচ্ছে। ভুগছে। সেরেও উঠছেন অনেকে। শুরু থেকেই বলা হয়েছিল শরীরে এন্টিবডি থাকলে ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হলে বা গোড়াতেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে কণ্ঠনালী থেকেই এই ভাইরাস বিদায় করে দেওয়া যায়। এটা প্রাণঘাতী শুধু তখনই যদি তা ফুসফুসকে অকার্যকর করে দিতে পারে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি অন্য কোন জটিল রোগে ভুগে থাকেন। এ তত্ত্বের বিপরীতে বলা হয়েছে, করোনা আদতে কোনো ভাইরাসই নয়, এটি একটি ব্যাকটেরিয়া মাত্র। প্রতিরোধ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য কর্তৃপক্ষও বলছে, বার বার হাত ধুয়ে এবং একই সাথে যেসব জিনিস ধরা হচ্ছে সেগুলো বার বার জীবাণুমুক্ত করার কথা। সব ব্যবস্থাপত্র তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনা থেকে সেরে উঠে তিনি বলেছেন, এটা কোনো বিষয়ই নয়। করোনা তার কর্মশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়েছে—এই বার্তাও দিয়েছেন ট্রাম্প।
বাংলাদেশে করোনা থেকে সেরে ওঠা কেউ কেউ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, এ রোগ থেকে যিনি বা যারা মুক্ত হয়েছেন তারা আজরাইল দেখে এসেছেন। এর উল্টোটাও বলছেন অনেকে। ট্রাম্পের মতো তারাও বলছেন, করোনা আসলে কোনো রোগই নয়। শরীরে অন্য কোনো জটিল সমস্যা না থাকলে করোনা অন্যান্য সাধারণ জ্বরের চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু মানুষ দুর্বল হয়ে যায় মূলত মানসিক চাপে। আর এই চাপ আসে তার চারপাশ থেকে। যখনই তার পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে, তার বন্ধু-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা ফোন করে, এসএমএস দিয়ে বা ইনবক্সে যে সমবেদনা জানান, এমনকি যে সাহস জোগানোর চেষ্টা করেন, সেটিও রোগীকে সাহসী করার বদলে মানসিকভাবে আরও দুর্বল করে দেয়। করোনাকে তাই ‘ভয়ের ব্যবসা’ বলে শনাক্ত করার পক্ষে অনেকে। সত্যি সেটা হলে তো মহাবিপদ। করোনা ব্যবসার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ালে কোথায় যাবে পরিস্থিতি? ভবিষ্যতে এ ভয়কে পুঁজি করে কে কোনদিকে আরও কী ঘটাবে কে জানে?
স্বীকার বা অস্বীকারের বিষয় নয় যে, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সারাবিশ্বেই মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবসা এখন তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে মাস্ক রফতানি করে একচেটিয়া ব্যবসা করছে চীন। বিশেষ কার্গো বিমানে চীন থেকে ফেস মাস্ক নিয়েছে ফ্রান্স। ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালও চীন থেকে জরুরি মেডিক্যাল সামগ্রী আমদানি করেছে। অর্থাৎ করোনাকে ব্যবসার নতুন সুযোগ হিসেবে লুফে নিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদক ও সরবরাহকারী দেশ চীন। শুধু মাস্ক বা স্যানিটাইজারই নয়, বরং তারা চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী বা পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), করোনা টেস্টিং কিট ও কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়ার মেশিন ভেন্টিলেটরও সারা বিশ্বে সাপ্লাই করছে। করোনাকে পুঁজি করে বাণিজ্যিক ঢেউটা বাংলাদেশেও কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি। সব সাহেদ-সাবরিনারাই করেননি। তাদের বহু ফলোয়ার্স। করোনার প্রকোপ শুরুর পরে ফার্মেসিগুলো অন্তত মাস্ক আর স্যানিটাইজার বিক্রি করে যা ব্যবসা করেছে, গত এক বছরে সব ওষুধ বিক্রি করেও হয়তো সেই পরিমাণ লাভ করতে পারেনি। ওষুধ কোম্পানি এবং হাসপাতালগুলোর ব্যবসা এবং হয়রানি তো মামুলিই হয়ে গেছে।
এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ উদ্বেগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, করোনাকালে যেভাবে সারা বিশ্বেই, বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চালু থাকা দেশগুলোয় ইন্টারনেটের ওপর নজরদারি বেড়েছে, ভবিষ্যতে চীনের কঠোর নীতি অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশ নিজ নিজ নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়াতে পারে। এটা মানবাধিকার অবমাননা করার সামিল বলে মনে করেন তিনি।
করোনাকে ‘ভয়ের ব্যবসা’ মনে করে নির্ভয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করবে? স্বাস্থ্যবিধি মানবে না? করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে মোটেই দ্বিমত নেই। এতো মানুষের মৃত্যু কোনো গুজব বা গল্প নয়। আবার ডেমকেয়ার ভাবও কম নয়। রাস্তাঘাটে অফিসে আদালতে হাট-বাজার বাসে ট্রেনে আগের অবস্থা। এর মধ্যে করোনার ‘সেকেন্ড ওয়েভের’ ঢাক পেটানোর গতিও তীব্র। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রায় নিয়মিতই ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। সবাইকে সতর্ক করে চলছেন। মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকরের নমুনা করুণ।
আতঙ্কের বদলে পথে-ঘাটে গাছাড়া ভাব অনেকের। ব্যক্তি দূরত্বের বালাই নাই। হাটবাজারে আঙুলে জিহ্বার পানি দিয়ে টাকা গুনে নিচ্ছে, দিচ্ছে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বালাই নেই। এই শ্রেণি কিন্তু দিব্যি সুস্থই আছে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না-কি বরাবরই বেশি।
চীন-ভারত হয়ে রাশিয়া কে না বাংলাদেশের মতো দেশকে নিয়েও ভ্যাকসিন টিক্স-ট্রিক্স করেছে? আপডেট খবর হচ্ছে, প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশকে করোনার ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেবে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। করোনা মোকাবেলায় ভ্যাকসিন-টিকা লাগবে না, করোনা এমনিতেই চলে যাবে— এই বক্তব্যদাতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ হবে। এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। পক্ষ তিনটি হচ্ছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। চুক্তিই কিন্তু শেষ কথা নয়। র্যাঠা আরও রয়ে গেছে। চুক্তি কার্যকর হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পর। অর্থাৎ লেফট-রাইট পর্ব এখনও বাকি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন