ধর্ষকদের বীভৎস নৃত্য ও আমাদের ভয়ংকর আগামী
১৭ নভেম্বর ২০২০ ১৫:০৯
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে জঘন্য নারী নির্যাতনের কথা দেশের সচেতন মানুষ অবশ্যই ভালো করে জানেন। এ ব্যাপারে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আজ সারা দেশে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন এতটাই বেড়েছে যে, যা দেখলে কিংবা শুনলে মনে হয়, আমাদের, অর্থাৎ দেশের জনগণকে দেখে শুনে রাখার কেউ কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। কেন জানি মনে হয় ধর্ষকদের অপরাধ করে যাওয়ার জন্য অবাধ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এই ধর্ষণকারীরা ধর্ষণের মত যে কোনো কাজ অবাধে করে যেতে পারবে। আজ দেশে সত্তর বছরের বৃদ্ধা থেকে এক বছরের নীচের শিশুরা পর্যন্ত ধর্ষণকারীদের হাত থেকে মুুক্তি পাচ্ছে না। আবার নেতারা বলছেন কোনো ধর্ষণকারী যেন কোনো ধরনের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। কথাটা খুবই সুন্দর এবং বাস্তব সম্মত। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা আমাদের নারী সমাজকে মানুষ মনে না করে ভোগের বস্তু বলে মনে করে, তারা, অর্থাৎ জঘন্য ধর্ষণকারী অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েই তাদের অপরাধের ডালপালা বিস্তার করে থাকে।
আজ যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো জঘন্য অভিযোগ উঠেছে, তারা ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা দ্বারা লালিত-পালিত হওয়ায় অপরাধীর সংখ্যাই বেশি। কেউ কেউ বলছেন ধর্ষণকারীরা হচ্ছে মানসিক রোগী। তাদেরকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও। আবার আমাদের সমাজে এমন লোকজনও আছেন, যারা মনে করে একটা পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। যারা মনে করছেন, দেশে চলমান ধর্ষণের উৎসব সরকারের বিরুদ্ধে একটা পক্ষের ষড়যন্ত্র, তারা কিন্তু কথাটা জোর গলায় বলতে পারছেন না। কেননা তারা দেখছেন শাহবাগে ছাত্র-ছাত্রী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষজন নেমে স্লোগান দেওয়া শুরু করেছে। তাই তারাও মনে হয় মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলেছেন। আজ হয়তোবা বলা হচ্ছে ধর্ষণকারীরা যেন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি। একটা সমাজে যখন ধর্ষকরা মাথা উঁচু করে কোনো কিছু হিসাবের মধ্যে না নিয়ে চলাফেরা করে তখন আমাদেরকে বুঝে নিতে হবে, ধর্ষণকারীরা বুঝে নিয়েছে তারা যতই অপরাধ করুক না কেন, তাদেরকে কিছু বলার কারো সাহস নেই। অপরাধীরা এটাও বুঝে, যদি তারা প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপকর্মে লিপ্ত হয় মানুষ তাদের কিছু বলবে না। কেননা মানচিত্রের কর্তাব্যক্তিরা তাদের পক্ষে আছেন এবং তারাই তাদেরকে সময় মতো রক্ষা করবেন। আজ আমরা এমন এক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, যেখানে কোনো নারী বলতে পারবে না সে মুক্ত সমাজে বাস করছে— যেখানে সে নির্ভয়ে রাস্তা-ঘাটে, স্কুল-কলজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে কিংবা কোনো শপিং মলে চলতে পারবে ।
বলছিলাম ক্ষমতাবানদের কথা। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের নির্যাতিত নারীকে যে নির্যাতনকারী জঘন্যভাবে নির্যাতন করেছে, সেই দেলোয়ার খুবই ক্ষমতাবান। তাকে এলাকার সবাই ভয় পায়। পুলিশ থেকে শুরু করে কেউ তাকে কিছু নাকি বলে না। বলবে কেমন করে, এলাকার মানুষ দেখে দেলোয়ারের মত অপরাধীরা ক্ষমতাবানদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যায়। এলাকার মানুষ নিশ্চয়ই তা জানেন বলেই ভয়ে কিছু বলেন না। আশেপাশের মানুষ যখন দেখে এলাকার সংসদ সদস্যদের সাথে দেলোয়ারের মতো লোকদের ভালো সম্পর্ক, তখন দেলোয়ারের মতো লোকদেরকে সবাই ভয় পাবেই। তাকে কে ঘাটাতে যাবে। মানুষের ঘাড়ের উপরতো একটা মাথাই থাকে।
পত্রিকায় দেখলাম ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। বলা হচ্ছে তদন্তে কোনো ধরনের গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। এমনও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই যেন কোনো ধর্ষকের প্রতি সহানুভূতি দেখানো না হয়। আবার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়ানোও হয়েছে। যাবজ্জীবন পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকেই অনেক কথা বলবেন। কেউ হয়তোবা বলতে পারেন আইন করে কি কোনো অপরাধ বন্ধ করা যায়? দেখা যাবে এখন যেমন নারী নির্যাতন আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে, ঠিক তেমনি নতুন আইনেরও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। তবে এটা সত্য শাস্তির বিধান পরিবর্তন করে অপরাধ নির্মূল করা যাবে না। আমরাতো দেখলাম মাদকের নির্মূলের ব্যাপারে অনেক ক্রসফায়ার করা হলো। তাই বলে কি মাদকের নির্মূল হয়েছে। সবাই বলবেন হয়নি। বাজারে ঠিকই মাদকের ব্যবসা চলছে। রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ছেলেমেয়েদের হাতে ঠিকই ইয়াবা, ফেনসিডিলের মতো মরণঘাতী মাদক চলে আসছে। বরং এখন যেনো মাদক বহনের নতুন নতুন কৌশল বের হচ্ছে। এখন নাকি লাশের গাড়িতে করে মাদক পাচার হয়। তাহলে বুঝুন আমরা কোথায় আছি।
ক্রসফায়ার করতে গিয়ে আমরা দেশবাসী দেখলাম, প্রদীপ কিংবা লিয়াকতের মতো মানুষরা কিভাবে আমাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ আছে ক্রসফায়ারের অপব্যবহার করে অনেক মানুষই লাভবান হচ্ছে। মূল কথা হচ্ছে যারা সমাজে মাথা উঁচু করে অপরাধ করে বেড়ায়, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। তারা, অর্থাৎ অপরাধীরা জনপ্রতিনিধিদের ফুল দিতে পারে, জনপ্রতিনিধিদের আশেপাশে সব সময় চলতে পারে এবং এসব অপরাধীরা মাথায় বড় বড় মামলার পরোয়ানা নিয়েও এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারে যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য মতে, দেলোয়ার ভয়ংকর অপরাধী, তার বিরুদ্ধে কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে। এছাড়া সে চাঁদাবাজি, মারামারি মামলার আসামী। সে এসব মামলার পরোয়ানা নিয়েই এলাকায় ঘুরে বেড়াত। পুলিশ বলত দেলোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। এলাকার মানুষের ভাষ্য হচ্ছে– সে, অর্থাৎ দেলোয়ার মামলার পরোয়ানা নিয়ে ঠিকই এলাকায় ঘুরে বেড়াত। অভিযোগ আছে দেলোয়ার এলাকার ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় থেকে তার অপকর্ম করে যেত। কোনো অপরাধী যখন এলাকার কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের নিবিড় ছায়ায় থেকে তার অপকর্ম চালিয়ে যায়, তখন কি পুলিশের পক্ষে সম্ভব তাকে খুঁজে পাওয়া? সবাই এক বাক্যে বলবেন— পুুলিশের পক্ষে তাকে ধরা সম্ভব নয়।
আমাদের সকল রাজনৈতিক নেতারা যদি অপরাধীদের মাথার উপর থেকে ক্ষমতার ছাতা সরিয়ে ফেলেন তখনি সম্ভব হবে সকল অপরাধের নির্মূল করা এবং দেলোয়ারের মতো নারী-নির্যাতনকারী অপরাধীদের বিনাশ করা। এসব অপরাধীদের বিনাশ করলেই আমাদের আগামীকাল সুন্দর হবে। তাই বলছিলাম, শুধু আইনের পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না, তাতে অপরাধ নির্মূল হবে না। শুধু আইন পরিবর্তন করে যে অপরাধের বিনাশ হয় না। আবারও বলছি, তার প্রমাণ তো আমরা দেখেছি মাদক নির্মূলের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ দেখে। অনেক মাদক ব্যবসায়ীদেরকে ক্রসফায়ার করে মারা হলো। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের আগামীকাল কি কন্টকমুক্ত হয়েছে? আমাদের চারপাশ থেকে কি মাদকের নির্মূল হয়েছে? সবাই বলবেন হয়নি। ঠিক তেমনি করে ধর্ষণের মতো অপরাধ নির্মূল করতে হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের মাথার উপর থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের শক্ত হাতে ধরে রাখা ছাতাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। তবেই দেখা যাবে দেলোয়ারের মত লোকরা সাহস পাচ্ছে না কোনো নারীকে জঘন্যভাবে বিবস্ত্র উলঙ্গ করে নির্যাতন করার।
লেখক: আইনজীবী, কবি ও গল্পকার