ফাটা বাঁশ-বাঁশিতে হেফাজত
২১ নভেম্বর ২০২০ ২০:৪৮
অরাজনৈতিক দাবি করা হলেও ভোটে ফ্যাক্টর এবং রাজনীতিতে শক্তিধর হেফাজতে ইসলাম এখন নতুন সন্ধিক্ষণে। দীর্ঘদিনের আমীর মাওলানা শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর পর সংগঠনটির অন্দরের কলহ একেবারে সদরে চলে এসেছে। রাখ-ঢাকের কিছু নেই। এ বিরোধ চাঙ্গা হচ্ছিল তার জীবদ্দশাতেই। অনুসারীদের এক গ্রুপ ছিল তার দম ফুরানোর অপেক্ষায়। আরেক গ্রুপ ইয়া নফসিতে। মৃত্যুর পর শোকের আবহ না কাটতেই বিস্ফোরণ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ঘটা করে সম্মেলন। বহুল আলোচিত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীর করে হেফাজতের নয়া কমিটি ঘোষণা। মহাসচিব করা হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসেইন কাসেমী। হেফাজতের এই কমিটিতে নারাজি দিয়েছেন পদবঞ্চিত আল্লামা শফীর অনুসারীদের আরেক গ্রুপ। কেবল কমিটি প্রত্যাখ্যান নয়, আল্লামা শফীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগও ছুঁড়েছেন তারা।
গণভিত্তি বা জনসমর্থনহীন ইসলামিক রাজনৈতিক দল ও নেতাদের একটা জুতসই ঠাঁই হেফাজতে ইসলাম। টিকে থাকতে হেফাজতকে আঁকড়ে ধরে আছেন তারা। আহমদ শফীর নেতৃত্বে গঠিত হওয়ার প্রথম চার বছর হেফাজত সীমাবদ্ধ ছিল চট্টগ্রামে। বিএনপি-জামায়াতের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থনে দ্রুত শক্তিমান হয়ে ওঠে হেফাজত। ইসলাম অবমাননায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়নসহ ১৩ দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় সমাবেশ করে সংগঠনটি জাতীয়ভাবে আলোচনায় আসে। ওই বছরের ৫ মে সংগঠনের নেতাকর্মীরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন। মধ্যরাতে তাদের সেখান থেকে কঠোর হাতে খেদায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কখনো হাজার-হাজার, কখনো শত-শত কর্মীকে সেই রাতে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগও করে তারা। জুনায়েদ বাবুনগরীসহ কয়েকজনের মতিঝিলের সহিংসতার মামলায় জেল হয়। আহমদ শফীকে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ধীরে ধীরে হেফাজতের ইউটার্ন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিকে। ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা বিনিময়ের খবরও প্রচার হয়। অভ্যন্তরীণ ঘটনার পর ঘটনা, ভাগযোগের গোলমালে বরাবরই বাঁশের মতো ব্যবহৃত হেফাজত এখন নিজেই আস্ত বাঁশ। ব্যবহারকারী বৃহৎ দলগুলো এই বাঁশটিকে এরইমধ্যে ফাটিয়েও দিয়েছে। পূর্ব-অভিজ্ঞতার আলোকে টানাটানিতে বাঁশের দশাকে যায় যায় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না হেফাজতে ইসলাম এখন কার? ক্ষমতাসীনদের না বিরোধীমতের? আওয়ামী লীগের পদপদবিধারী দায়িত্ববান কারো কাছ এ প্রশ্ন দৃষ্টে এখন পর্যন্ত কোনো জবাব আসেনি। তবে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগ থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। তাদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব মুফতী মাসুম বিল্লাহর বিবৃতি এই প্রশ্নকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম আদর্শচ্যুত হয়ে মওদুদীবাদী জামায়াত ইসলামী সংগঠনের আদর্শে পরিণত হয়েছে। হেফাজতে পাকিস্তানের প্রেত্মাতা জামায়াত ভর করেছে।
সরাসরি জামায়াতের রাজনীতির কারো হেফাজতে প্রবেশ না ঘটলেও ওলামা লীগের করা অভিযোগ একেবারে বাতকেবাত নয়। হেফাজতের নতুন কমিটিতে ঢুকেছেন বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং খেলাফত মজলিসের দেড় ডজন নেতা। হেফাজতে পদ বাগিয়েছেন খেলাফত আন্দোলনের কয়েক নেতাও। বিএনপিবিরোধী, সরকার সমর্থক এবং সরকারের বিরুদ্ধে তুলনামূলক নমনীয় আলেমদের মোটামুটি বাঁশ দেওয়ার মতো সাইজ করা হয়েছে। আবার এক সময় বিএনপির খাস লোক মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের মতো লোকও ছিটকে পড়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইসলামী ঐক্যজোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেও বাদ পড়েছেন। আল্লামা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, চরমোনাই পীরের ভাই মুফতি ফয়জুল করীম, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা মিজানুর রহমান সাঈদেরও জায়গা হয়নি। ফাটা বাঁশে পড়েছেন হেফাজতের আগের নায়েবে আমীর ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমও। নতুন কমিটিতে রাখা হয়নি তাকে। বাদ পড়েছেন সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত আলেম মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ, মাওলানা রুহুল আমিনও। বাবুনগরীবিরোধী এবং আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর পক্ষের নেতারা সরকারের হার্ডকোরের বলে পরিচিত।
আহমদ শফীর পর কে হেফাজতের নেতা হবেন— তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই বিরোধ চলছে সংগঠনটিতে। তার জীবদ্দশাতেই গত জুনে আনাস মাদানীর সমর্থকরা হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্ব থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে সরিয়ে দেন। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তিনি আবার মাদ্রাসায় ফেরেন। অ্যাকশন হিসেবে আনাস মাদানী ও তার সমর্থকদের মাদ্রাসা থেকে তাড়ানো হয়। হেফাজতের নয়া কমিটিতে মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২০১৮ সালে আহমদ শফীর নেতৃত্বে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের সমালোচনা করে পদত্যাগ করেছিলেন মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। আলোচিত ওই সম্মেলনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমী জননী খেতাব দেওয়া হয়। সেই তারিখে একটি পাবলিক পরীক্ষা পেছনোর রেকর্ডও তৈরি হয় বাংলাদেশে।
ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মুফতি মুহম্মদ ইজহারের দুই ছেলে মুসা বিন ইজাহার ও হারুন বিন ইজাহারের নাম রয়েছে কমিটিতে। বিএনপি জোটের হয়ে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী মুফতি মুনির হোসাইন অর্থ সম্পাদক হয়েছেন। ধানের শীষ প্রতীকের সাবেক এমপি জমিয়ত নেতা অ্যাডভোকেট শাহিদুল পাশা চৌধুরী হয়েছেন আইন সম্পাদক। এ রকম বিদঘুটে অবস্থায় একবাক্যে বলার জো নেই হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের না বিরোধীদল বিএনপি বা জামাতের। হেফাজতকে বাঁশ বানিয়ে সামনে কে বাঁশি বাজাবে এখনই বলার অবস্থা হয়নি। অথবা হেফাজত নিজেই নতুন কোনো বাঁশ হয়ে দেখা দেয় কি-না? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বাঁশ থেকেই যে বাঁশি বানানো হয় সেটা কিন্তু নিশ্চিত। বাঁশ কেবল রডের বদলে নয়, এর ব্যবহার-অপব্যহারের ধুম সর্বত্র। পেশা, ধর্ম-কর্ম সবখানেই। রাজনৈতিক আঙিনায় বাঁশের ব্যবহার-অপব্যবহার আরেকটু বেশি। যে যেখান দিয়ে পারছেন দিচ্ছেন। যার যতোটুকু সম্ভব নিচ্ছেন। হজম করছেন। টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
বিভিন্ন জায়গায় রডের বদলে বাঁশের খবরে এখন আর তেমন তোলপাড় হচ্ছে না। এর তেমন নিউজ ভ্যালু নেই। কারণটা একেবারেই বাস্তব। বাঁশ ছাড়া বাঙালি জীবন কল্পনা করা যায় না। ১৯৬৪ সালেই ইউএস নেভি ইস্পাতের বদলে বাঁশ দিয়ে কংক্রিট বানানোর পরীক্ষা করেছে। ফলাফলটা জানা হয়নি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কিছু লেখালেখি আছে বাঁশ নিয়ে। ইস্পাতের বদলে বাঁশ ব্যবহার নিয়ে অধ্যাপক নজমুল হকের রয়েছে বেশ গবেষণা। তারা গবেষণা বা লেখালেখি পর্যন্ত থাকলেও আমাদের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন রডের কাজ বাঁশ দিয়ে করা যায়। টেকনোলোজিতে বিশ্বসেরা চীনও বাঁশকে এতো চমৎকারভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। দুনিয়ার সেরা বাঁশ উৎপাদনকারী দেশটির জন্য তা আফসোসের। আর বাংলাদেশের জন্য হেকমতের। চীনারা মুখ দিয়ে নিয়মিত বাঁশ খায়। আমাদের তা খাওয়ানো হয় অন্যভাবে, অন্যদিক দিয়ে। চীন আমাদের মতো বাঁশের এতো ইউটিলিটি ঘটাতে পারেনি। তাই আমাদের বাঁশ বিশেষজ্ঞদের শাস্তি নয়, অপরিসীম অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কারই তো পাওনা। তা পদার্থবিজ্ঞান, নয়তো অন্য কোনো ক্ষেত্রেও হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন