Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এবার রুখে দাঁড়াতে হবে


৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৩৮

মাদ্রাসার যেসব ছাত্র ‘না বুঝে’ই হইচই করছে. তাদের কিছু ঘটনা বলতে চাই। একই সঙ্গে সরকারের সদস্যদের, যারা হেফাজতসহ মৌলবাদী ইসলামী গোষ্ঠীকে প্রচ্ছন্নভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। দেশজুড়ে এতো আস্ফালন ঘটতো না। ‘না বুঝে’ একথাটা কেনো বললাম, তার সবিস্তার ব্যাখ্যায় যাবো না। আমরা ২০১৩ সালের ৫ মে’র ঘটনার কথা ভুলে যাইনি নিশ্চয়। সেখানে অসংখ্য ছাত্রকে ‘জিহাদি’ শক্তিতে বলিয়ান করে নিয়ে আসা হয়েছিল শাপলা চত্বরে। পরবর্তী সময়েও অনেক ছাত্রের বয়ানে আমরা সেটা পাই। অনেকটা জোর করে তাদের ধর্মীয়গুরুরা তাদেরকে বিভিন্ন ময়দানে নিয়ে আসে। এরা আক্রমণাত্মক আদর্শের অনুসারী এবং নিজেদের মতাদর্শকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেই শুধু ক্ষান্ত হন না, তারা সমাজে সেই মতাদর্শের প্রভুত্ব বা আধিপত্য কায়েমের জন্য সেই মতাদর্শের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র নিষ্ঠুর ক্ষমাহীন সংগ্রামের উন্মাদনা তৈরি করেন।

বিজ্ঞাপন

হয়রত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের (আরব ইতিহাসবিদ) লেখা দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বলছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আলফ্রেড গিয়োম। (প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৫২)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কাবা শরীফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে। যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি ছবি আঁকা। নবীজি (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘এই ছবিটা তোমরা নষ্ট করো না’। কাজটি তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। হয়রত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরীফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিলো। এতে কাবা শরীফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুণ্ণ হয়নি।

বিজ্ঞাপন

পারস্যের কবি, শেখ সাদি, তিনি হচ্ছেন সেই মানুষ, যার নাত এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মিলাদে সব সময় পাঠ করে। ‘বালাগাল উলা কি কামাললিহি/কাশাফাদ্দুজা বি কামালিহি … ’। মাদ্রাসার উত্তেজিত ছাত্ররা শুনলে হয়তো মন খারাপ করবে যে, শেখ সাদির মাজারে তাঁর একটি মর্মর পাথরে ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানকার ছাত্ররা তা ভাঙেনি।

কঠোর ইসলামিক দেশের একটির নাম লিবিয়া। রাজধানী ত্রিপলিতে বিশাল একটি মসজিদ আছে। মসজিদের সামনেই গ্রিকদের তৈরি একটি মূর্তি স্ব-মহিমায় শোভা পাচ্ছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা মূর্তিটা ভেঙে ফেলেনি।

কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি— বিষয়টি উদ্বেগের— হঠাৎ করে ‘হেফাজত ইসলাম’ নামে একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে নয়া বিতর্ক হাজির করেছেন। যা কিনা এদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের ভেতর একটি ‘রাজনৈতিক’ ও ‘ধর্মীয়’ মৌলবাদের উস্কানিটা জোরালো করার চেষ্টা করছে। মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে হেফাজত ইসলাম নামে এই গোষ্ঠীটি হইচই করছে, সঙ্গে সঙ্গে সরকারও নতজানু। আমরাও নতজানু। বুঝতে পারছি না, সরকার দেরি করছে কেনো? সব আলো নিভিয়ে অন্ধকারে প্রবেশ করলেই হয়।

কেউ কেউ বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার যে পথ তৈরি হয়েছে, এটার মূলে স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব বিনাশে আঘাত। আমি মনে করি, কেবলমাত্র এই একটি জায়গায় আটকে থাকলে চলবে না। বঙ্গবন্ধু নিয়ে এদেশে কাল্ট চর্চা বেড়েছে, শেখ হাসিনাকে নিয়েও রয়েছে। এটা আমাদের দেশের নতুন এক বাস্তবতা। কাল্ট চর্চার ফলে অন্ধভক্তি, মোসাহেবি, মুনাফা করার সীমাহীন প্রলোভন, আত্মসম্মান-মূল্যবোধ বিসর্জন ও লজ্জাহীন হয়ে ওঠার বাস্তবতা একদিক তৈরি হতে থাকে। ব্যক্তিপূজা দুর্বল না হয়ে, এই সময়েও লোপ না পেয়ে জোরালো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্তভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক-গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘ব্যক্তিপূজা বনাম গণতন্ত্র’ নামক এক প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘রেনেসাঁর সূচনা থেকে যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য জোরদার হতে থাকে, তখন এর প্রভাব অনেকটা কমে যায়। ব্যক্তিপূজা আরও দুর্বল হয়ে যায় উদারনৈতিকতা, যুক্তিবাদ এবং গণতন্ত্রের বিকাশের ফলে। আধুনিককালে সেটা লোপ পাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে লোপ পায়নি। কারণ রেনেসাঁ, উদারনৈতিকতা, যুক্তিবাদ এবং গণতন্ত্র সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বরং যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং গণসংযোগের উন্নতির দরুন কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতীতের তুলনায় ব্যক্তিপূজা আরও প্রবল হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের একটি বিরাট অংশ চুপ হয়ে আছে, যারা কিনা প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ধারণ করে। কেন চুপ হয়ে আছে, তা ভাবতে হবে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই। এখানে আরও অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমার মনে হয় রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বেরও আঘাত রয়েছে এখানে। বহু আগেই আওয়ামী লীগ শ্রেণিচরিত্র বিলোপের সাথে সাথে তা বেহাত করেছে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির এমন দৈন্যদশা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সরকার কোনো সংঘর্ষে যাবে না, যুক্তি দিয়ে বোঝাবে মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়’। তিনি কোনো মুসলিম দেশে ভাস্কর্য আছে সে বয়ানও দিলেন। তার মানে কি মূর্তি ভাঙ্গতে চাইলে ভাঙা যাবে? যেহেতু মূর্তি কোনো ভাস্কর্য নয়, সেহেতু তেঁতুলমনা বা বাবুমনা কেউ চাইলেই মূর্তি ভাঙ্গা কর্তব্য মনে করতে পারে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ কুষ্টিয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করলেন, এটাকে কল্পনার অতীত বললেন। কিন্তু এই ঘটনায় আমি বা আমরা মোটেই বিস্মিত হইনি। কারণ গত দশ বছরে বাংলাদেশে মৌলবাদী অপশক্তির আস্ফালন দেখেছি। ক্ষমতাসীন দল কিভাবে তাদেরকে আস্কারা দিয়েছে, তাও দেখেছি। সেই আস্কারার ফল আমরা এখন দেখছি। এই মৌলবাদী জঙ্গিরা সারা পৃথিবীর জন্য ভাইরাস। এরা আফগান, ইরাক, সিরিয়ায় কী করেছে, আমরা দেখেছি। এদেরকে কঠোর হাতে দমন করার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে শূন্যস্থান কখনো খালি থাকে না। বিরোধীদলগুলোর নিষ্ক্রিয়তার কারণে এই অপশক্তি শূন্যস্থান দখলের চেষ্টা করছে। এখন দরকার একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠীর ভোটের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি দেওয়ার ফলে আজ এই সাম্প্রদায়িক শক্তি উন্মাদনা সৃষ্টি করে চলছে। যা সরকারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র দুই-তিন দশকের মাথায় এসে শুনতে হলো যে, এদেশ বাঙালির না, বাংলাদেশির। ৫০ বছরের মাথায় এসে কথায় কথায় শুনতে হচ্ছে যে ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। তার মানে সবাইকে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দ অনুযায়ীই চলতে হবে। সব শিক্ষা, আধুনিকতা, রুচি, অধিকার, বিবেক, বুদ্ধি, পছন্দ, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়েই মুখ বুজে বসে থাকতে হবে। দিন দিন পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আর সবাই যেন বানে ভেসে এসেছে। কারো কিছু বলার নেই। বেশি কিছু বললে হয় জঙ্গিরা কোপিয়ে মারবে অথবা কেউ মামলা দিয়ে জেলে পাঠাবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাত্যভিমান নিয়ে বছর দশেক আগে আওয়ামী লীগ দেশে কোনো আদিবাসী নেই বলে যে রাজনীতি শুরু করেছিল, সেটা অচিরেই দেশে কোনো সংখ্যালঘু নেই রাজনীতিতে ঠেকতে পারে। সেই দিকেই কি যাচ্ছি না আমরা? ধর্মীয় সংখ্যালঘু না থাকলে, ‘মূর্তি হলে ভেঙে দিয়েন কিন্তু ভাস্কর্য ভাইঙ্গেন না ভাই’ এই রাজনীতি করা কতো সহজ হয়ে যাবে।

ভাস্কর্য শুধু সৌন্দর্য নয়, ইতিহাসকেও বহন করে। আর ইতিহাস হচ্ছে জ্ঞানের সর্বোত্তম উৎস। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ফেলতে চায়, তারা যে অপশক্তির বংশধর, এই ব্যাপারে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। তারা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে। তাদের সীমাছাড়া স্পর্ধায় নীরব থাকা এবং তাদের সঙ্গে আপসের পর আপস করার পরিণাম শুভ হবে না। দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু নয় শুধু, একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, লালন, নজরুল, জীবনানন্দ, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ মনীষীদের ভাস্কর্য নির্মাণ করে এই ধৃষ্টতার জবাব দিতে হবে। আস্কারা অনেক হয়েছে, এবার রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সমূলে উৎপাটন ব্যতিরেকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের উপর এতো বড় আঘাতের বিচার যথেষ্ট নয়।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর