পদ্মাসেতুর নাম হোক ‘শেখ হাসিনা সেতু’
১১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:০৬
ঢাকা থেকে মাওয়া। ৩৫ কিলোমিটারের এই পথটুকু পাড়ি দিতে আগে সময় লেগে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পথে পথে যানজট, রেলক্রসিং, ছোট আকারের সেতু-কালভার্ট এসব পাড়ি দিয়ে ঠিক কত সময়ে মাওয়া যাওয়া যাবে তা কেউ আন্দাজ করতেও পারত না। কিন্তু বর্তমানে দ্রুতগতির যানবাহনে এই পথটুকু পাড়ি দিতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। বলছিলাম ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা-মাওয়া অংশের কথা। সুপার এই এক্সপ্রেসওয়েতে বর্তমানে দ্রুতগতির যানবাহন চলছে নির্বিঘ্নে। আগে ছোট ছোট যানবাহনের জন্য যে বিঘ্ন ঘটত এখন তা একেবারেই নেই। তারা চলছে দু’পাশের সার্ভিস লেন দিয়ে। আর দ্রুতগতির গাড়িগুলো চলছে উভয়মুখী চারলেনের সড়ক দিয়ে। ফলে বড় গাড়িগুলোর নিজস্ব গতিতে চলবার ক্ষেত্রে নেই কোনো প্রতিবন্ধকতা। এদিকে রাস্তায় বেশ কিছু সেতু এবং কালভার্ট থাকার ফলে আছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই কিন্তু নেই কোনো ঝাঁকুনি, নেই কোনো খানাখন্দ। শুধু কি তাই, আরামদায়ক এ পথে চলতে চলতে পথের দু’পাশের পরিকল্পিতভাবে রোপণ করা গাছপালা আর রোড ডিভাইডারে ফুটে থাকা রঙবেরঙের ফুলের সৌন্দর্যে মন ভরে উঠবে যাত্রীদের।
ওপরের যে বর্ণনা তা এখন আর কল্পনার কোনো ব্যাপার না, এটাই এখন বাস্তব। আর পদ্মার ওপারে এই এক্সপ্রেসওয়ের বাকি অংশ পাচ্চর থেকে ভাঙ্গার ২০ কিলোমিটার পথ আরও বেশি নয়নাভিরাম। এ পথে চলতে গিয়ে যেকারো মনে হতেই পারে, এ কি আমাদের বাংলাদেশের কোনো অংশ নাকি কোনো উন্নত দেশের সড়ক ধরে ছুটে চলেছি! এ পথ ধরে ছুটে যেতে যেতে যেকারো মন ভরে উঠবে মুগ্ধতায়, আর নিজ দেশকে নিয়ে গর্বে ভরে উঠবে বুক।
বলা হলো পদ্মা নদীর এপার-ওপার দুপারের কথা। কিন্তু মূল পদ্মাসেতুর কী অবস্থা এতক্ষণে তা কারও জানতে বাকি আছে বলে মনে হয় না। মূল সেতুর ৪১টি স্প্যানের সর্বশেষ স্প্যানটি এরই মধ্যে বসে গেছে। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত মিলন ঘটেছে উন্মত্ত পদ্মার দুই পারের। একই সঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পুরো সেতুটি। আশা করা যায় খুব শিগগিরই দ্বিতল এই সেতুর ঢালাইয়ের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ ও ভায়াডাক্ট প্রস্তুত করা, রেলের জন্য স্ল্যাব বসানো শেষে যানবাহন চলাচলের উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্বপ্নের এই সেতুটি।
বাঙালির স্বপ্নের এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে একমাত্র বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসী মনোবলের কারণেই। কথা উঠতে পারে, শেখ হাসিনা না থাকলে কি পদ্মাসেতু নির্মাণ হতো না? হয়তো হতো, হয়তো হতো না। তবে এত তাড়াতাড়ি এবং সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে এই সেতু কোনোদিনই গড়ে উঠত বলে মনে হয় না। কারণ আর্থিক অনিয়মের কাল্পনিক অজুহাতে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হবে— তখন বাংলাদেশের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও বলেছিলেন, এটা অসম্ভব। এটা করতে গেলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কিন্তু তাদের কথায় দমে যাননি বঙ্গবন্ধুকন্যা। তখন শেখ হাসিনা ছাড়া দ্বিতীয় কেউ কল্পনাও করেছিলেন কি না যে সত্যিই বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব হবে, আমার ধারণা নেই। কিন্তু আজ সবাই দেখছে যে শেখ হাসিনা ওইসব বড় বড় অর্থনীতিবিদের চেয়েও বড় অর্থনীতিবিদ, প্রবল স্বপ্নবাজের চেয়েও বড় স্বাপ্নিক। তিনি যে স্বপ্ন দেখেন যে কোনো মূল্যে তা বাস্তবে রূপ দিতে জানেন। বিশ্বব্যাংক যখন অর্থায়ন থেকে সরে যায় তখন আরও কয়েকটি দেশ পদ্মাসেতুতে অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে। যদি তাদের সেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হতো অথবা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নেই পদ্মাসেতু নির্মিত হতো তাহলে কী হতো? লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলত। হ্যাঁ, আমরা হয়তো সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পার হতাম কিন্তু পঞ্চাশ-ষাট বছর কিংবা আরও বেশিদিন এই সেতুর যাবতীয় আয় নিয়ে যেত সহায়তাকারীরা। আজকে নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আগামীতে কী যে যুক্ত হতে যাচ্ছে তা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখার কোনো ব্যাপার নয়, এটা বিশ্লেষণ করতে পারবেন শুধু বড় বড় অর্থনীতিবিদরা। সাধারণ মানুষ এত কিছু বুঝতেও চায় না, তারা বাহ্যিক দিকটাকে এবং নগদ প্রাপ্তিটাকেই প্রাধান্য দেয়। আর পদ্মাসেতুর এই বাহ্যিক দিক এবং নগদ প্রাপ্তিটাও কোনো অংশেই কম নয়। এবং এ সবই সম্ভব হয়েছে, আবারও বলছি, একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যার অসীম সাহস আর অসাধারণ দূরদৃষ্টির কারণেই।
একটা কথা প্রচলিত আছে, যে কোনো ক্ষেত্রে সঠিক ইতিহাস সমসাময়িককালে লেখা হয় না। সঠিক ইতিহাস লেখা হয় যখন ইতিহাসের ওই ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপার না থাকে তখন। তাই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অবদানের বিষয়গুলোও বর্তমানকালের অনেকেই স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু তাকে নিয়ে একদিন ঠিকই সঠিক ইতিহাস লেখা হবে। সেদিন অনেক অনেক ভালো কাজের জন্যই তাকে স্মরণ করা হবে। সেসবের মধ্যে পদ্মাসেতুও হবে বিশেষ একটি বিষয়। তাই আমি মনে করি, পদ্মাসেতুর নামকরণ হতে পারে একমাত্র শেখ হাসিনার নামেই। কারণ এই সেতুকে ঘিরে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, যে পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, যে সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছেন, তা বর্তমানকালের আর কারও পক্ষে সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। তাই পদ্মাসেতুর নামকরণ একমাত্র শেখ হাসিনার নামেই হতে পারে।
ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন নামে এই সেতুর নামকরণের প্রস্তাব এসেছে। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সেতু পদ্মা নদীর নামে অর্থাৎ পদ্মাসেতু নামেই বিশ্বের কাছে পরিচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো চাচ্ছেন না নিজের নামে এই সেতুটির নামকরণের মাধ্যমে নতুন করে কোনো সমালোচনার তীর বিরোধীদের হাতে তুলে দিতে। কারণ সমালোচকরা তো শুরু থেকেই মুখিয়ে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মাসেতু করতে পারবে না, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ অসম্ভব, পদ্মাসেতু নড়বড়ে করে তৈরি করা হচ্ছে, আগামী পঁচিশ বছরেও বাস্তবায়িত হবে না পদ্মাসেতু— এমন হাজারো মন্তব্য নিন্দুকেরা এই সেতুকে ঘিরে করেছে। এই সেতু চালু হওয়ার পরেও হয়তো তাদের সমালোচনা বন্ধ হবে না। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে সমালোচকদের গ্রাহ্য করতে হয় না। পদ্মাসেতু তেমনই একটি বিষয়। নিজ নামে এই সেতুর নামকরণে অনীহা প্রকাশ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিশাল মানসিকতার প্রকাশ। কিন্তু তার ঘোর শত্রুরাও হয়তো স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু এত তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ লাভ করত না। তাই এই দাবি খুবই যুক্তিসঙ্গত যে, পদ্মাসেতুর নাম হবে শেখ হাসিনা সেতু।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক