খাল নেবে ডিসিসি— ওয়াসা করবে কী?
১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:১৭
এবার শুকনো মৌসুমেই রাজধানীর খাল নিয়ে জম্পেশ আলোচনা। বর্ষার আলাপ শীতে উৎরে আসা একটু নতুনত্ব বটে। প্রতিবছর বর্ষায় জলাবদ্ধতায় আক্রান্তের জেরে ইস্যু হয় রাজধানীর খালগুলো। এ নিয়ে ক’দিন চলে গরম আলোচনা-পর্যালোচনা, পরামর্শ, নির্দেশনামা। হুমকি-ধমকি তো থাকেই। কিছু অ্যাকশনও শুরু হয় কাদামাটি-পানি মিলিয়ে। এবার তা হবে শুকনাতেই । তা আকস্মিক নয়। ঢাকার দুই মেয়র এক হয়েছিলেন এ নিয়ে। তাদের সরাসরি কথা ছিল ওয়াসা ব্যর্থ খালগুলো রক্ষণ-সংরক্ষণে। আর উদ্ধার তো আরও দূরে।
মেয়রদের কথা আমল পেয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আগামী জানুয়ারির মধ্যেই খালগুলোর দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। শনিবার এক অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্তটি জানানোর সময় মন্ত্রী ঢাকা ওয়াসার কাজের প্রশংসাও করেছেন। বলেছেন, সারাদেশে লকডাউন চলা অবস্থায়ও ঢাকা ওয়াসা রাজধানীতে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ করেছে।
রাজধানীর খালগুলোর খবরদারি ছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন এবং ওয়াসার হাতে। কিছু দায়দায়িত্ব ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও। বছর তিনেক আগে, এসব খালের কী অবস্থা? কাদের দখলে? উদ্ধারে কী করনীয়?— এ ধরনের কিছু হালনাগাদ তথ্য চেয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। জবাবে ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কী তথ্য জানিয়েছিলেন গণমাধ্যমে ফলোআপ সংবাদ সেইভাবে আসেনি। ২০১৬ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসন রাজধানীতে ৫৪ খাল চিহ্নিত করেছিলো। ৫৪টির মধ্যে ৩৭টি খালের অংশ বিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকসহ তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং আড়াইশর বেশি ব্যক্তি দখল করে নিয়েছেন। এর মধ্যে ২২টি খাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমানায় ও ২৫টিরও বেশি খাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়। সরকারি তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরের বাসাবো খালের প্রস্থ ৬০ ফুট। বাস্তবে এর প্রস্থ কোথাও ১৫ ফুট বা ২০ সর্বোচ্চ ২৫ ফুট। খালের ওপর বা পাড়ে টং ঘর, দোকান-পাট গড়ে তুলে দখলদাররা বহু আগেই খালের দেহ ভোগদখলে নিয়েছে। ১১০ ফুট প্রশস্ত রামচন্দ্রপুর খাল টিকে আছে ৪০-৫০ ফুট নিয়ে।
বাসাবো খালের মতো বেগুনবাড়ি খাল ও মহাখালী খালের প্রস্থ ৬০ ফুট থাকার কথা। এর বাস্তব অবস্থাও বাসাবো খালের মতোই। কোথাও ১৫, ২০, কোথাও ২৫ ফুট প্রস্থ। বাকি জায়গা দখলদারদের কবলে। ১০০ ফুট প্রশস্ত আবদুল্লাহপুর খাল এখন ৫০ ফুট প্রশস্ত নিয়েও নেই। ১২০ ফুট প্রশস্ত কল্যাণপুর খাল সংকুচিত হতে হতে ঠেকেছে ৬০ ফুটে। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সব কটি খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও। জেলা প্রশাসন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এখনো বেঁচে থাকা খালগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দ্রুত উদ্ধার না করলে সেগুলোও হারিয়ে যাবে।
বেদখলের কারণে খালগুলো ‘নাই’ হয়ে যাওয়া বা কিছু খাল থাকলেও পানি সরার অবস্থা না থাকার ঘটনা অনেকদিনের। বলার অপেক্ষা রাখে না সময়-সুযোগে খাল দখল করেছেন ক্ষমতাধররাই। যেখানে নদীই তারা খেয়ে হজম করে ফেলে, সেখানে খাল তেমন বিষয় নয় তাদের কাছে। এদের কব্জা থেকে খাল উদ্ধারের চেষ্টা যে হচ্ছে না বা হয়নি এমনও নয়। দুদক, আদালত নির্দেশনা দিয়েও কুল পায়নি। ২০১৭ সালের অক্টোবরে হাইকোর্ট খাল দখল বন্ধে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট রাজধানীর ৫০টি খাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতো অভিযান চলেছে দফায়-দফায়। কিন্তু, ফল বা প্রাপ্তি বড় নগণ্য।
ঢাকার খালগুলো কখনই পুরোপুরি দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযানে দখলদাররা গা ঢাকা দিয়েছে মাত্র। চোর-পুলিশ খেলার মতো আবার ফিরে এসেছে। দখলের বাইরে যথাযথ সংস্কার ও পুনঃখননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে অনেক খাল। সেটাও দখলবাজদের জন্য আশীর্বাদের। ভরাট করে দখল করতে হয়নি। ভরাট খালের জায়গা দখল করে নিয়েছে নিমিষে। ভূমি অফিস, সিটি করপোরেশন, ওয়াসার অসাধুদের একনিষ্ঠ সহযোগিতায় সেখানে তারা রাতারাতি দাঁড় করে ফেলে ছোট-বড় স্থাপনা। এই সম্পত্তির বৈধতা দাবি করার কাগজপত্রও হাসিল করেছে এরা। দখলদারিত্বে পিছিয়ে নেই সরকারি প্রতিষ্ঠানও। মিরপুর সার্কেলের বাউনিয়া খালের একাংশ ভরাট করে ফেলেছে রাজউক। একইভাবে আবদুল্লাহপুর খাল এবং দিয়াবাড়ি খালের কিছু অংশও ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিয়াবাড়ি খালের ভরাট অংশ রাজউকের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ঢুকে গেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার জিরানী (নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী) খাল দখল করে জেলা পরিষদ মার্কেট গড়ে তুলেছে।
খাল খাওয়ার এই ব্যারামের জেরে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতা-বন্যা। দিন দিন তা প্রকট থেকে প্রকটতর। সব খালের মালিক জেলা প্রশাসন। আর রাজধানীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য গড়ে তোলার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য নগরীর খাল ও ড্রেনগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় এই সংস্থাকে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে তাদের বুঝে নেওয়া খাল সংখ্যা ২৬টি। এর বাইরেরগুলোর খবরও রাখে না ওয়াসা। খবর রেখেই বা কী করবে? যেগুলো আছে সেগুলোর হালই করুণ। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খাল নিয়ে ঠেলাঠেলির ঘটনা রয়েছে। এখন সব ঠেলা আগ্রহের সঙ্গে বরণ করে নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। জনপ্রতিনিধির কাছে খালের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন আসবে বলে একটা আশা অনেকেরই। দুই মেয়র ওয়াসা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যর্থ দাবি করে ঢাকার খালগুলোর মালিকানা নিতে উদগ্রীব ছিলেন। তাদের আশা পূরণের পথে। দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাফল্য দেখানোর চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন তারা। এখন একদিকে তাদের চ্যালেঞ্জ জয়ের পালা। আরেকদিকে ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা জেলা প্রশাসন কী করবে— সেটাও দেখার বিষয়। খাল বিষয়ে তাদের দায়িত্ব কী হবে, সেটাও নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন